আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নতুন ধারার রাজনীতি!

এক

দেশের পরিস্থিতি যে ক্রমেই জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করানো হয়েছে যেখান থেকে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পরিস্থিতি পুরোপুরি জেনেবুঝে এবং সৃষ্টি করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঠে নেমেছেন। জনসভা করতে শুরু করেছেন তিনি। পাঁচ সিটি করপোরেশনে পরাজয়ের পর তা থেকে যথাযথ শিক্ষা নেওয়ার বদলে শেখ হাসিনা স্বভাবসুলভ নিজের পক্ষে একটি যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিলেন।

সেটা এরকম যে, তারা যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, তাদের প্রার্থীরা যোগ্যতর ছিল। কেবল প্রচারের দুর্বলতা ও সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতার কারণে তারা পরাজিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, তার কাছে তথ্য আছে, আগামী নির্বাচনে তারাই জিতবেন।

নির্বাচন কি হবে এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব আছে কেবল শেখ হাসিনার কাছে। বিরোধী দল বিএনপি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় তারা নির্বাচনে যাবে না।

সেক্ষেত্রে একপক্ষীয় একটি নির্বাচনের মহড়া হয়তো দেখা যাবে। যার পরিণতি সম্পর্কেও সবাই কম-বেশি নিশ্চিত। এদেশের মানুষ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং তার পরিণতি তো দেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে_ সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী জনসভা করে এই ধোঁয়া তুলছেন কেন? হতে পারে একটা বাতাস তো তৈরি করতে হবে, প্রধানমন্ত্রী সেই চেষ্টা করছেন। মজার ব্যাপার হলো, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকেও আমরা স্বল্প আয়তনে হলেও সেই কাজ করতে দেখছি।

৮ তারিখে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া নরসিংদীতে এক জনসভায় বক্তৃতা করেছেন। আগে বলা হয়েছিল, ওই দিন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু না। বেগম জিয়া তার ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় এ রকম কোনো কথা বলেননি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া ২১ বছর পরে প্রথম নরসিংদীতে গিয়ে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেবে, না হয় শেখ হাসিনা বিদায় নেবেন।

সরাসরি সরকার পতনের আন্দোলন ঘোষণা করেননি তিনি। কোরবানির ঈদের পরে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক থেকেও খানিকটা সরে এসেছেন। দেশের আটটি জেলায় জনসভা করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং বলেছেন, অক্টোবরের শেষে ঢাকায় জনসভার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হবে। ধরেই নেওয়া যেতে পারে, যে কোনোভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ভাবছে বিএনপি। নির্বাচনকালীন পদ্ধতি নিয়ে শেখ হাসিনা এক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন এ কথা মনে রেখেও বেগম জিয়া বলেছেন, সরকার সংলাপে ডাকলে তিনি সে ডাকে সাড়া দেবেন।

এ আমার আজকের লেখার ভূমিকা। ভূমিকা থেকে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, তাহলে কি উভয় দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কী কারণে এত জোর গলায় বললেন, বিএনপি যতই আন্দোলন আন্দোলন বলে গলা ফাটাক না কেন, তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। আমি এ প্রশ্নের জবাব জানি না। পত্রপত্রিকায় বিদেশি কূটনীতিকদের নানা রকম তৎপরতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো সবার চেয়ে একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা বলেছেন, সমস্যা সমাধানের পথ এদেশের নেতাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তার মানে পরিস্থিতি যে জটিল হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার মতো আলো এখন দেখা যাচ্ছে না।

দুই

তারপরও যে রাজনীতি এগুচ্ছে এটি আমার একটি উপলব্ধি। দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার মতামতকে উপেক্ষা করে সরকার একপক্ষীয় নির্বাচন করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে জনমতকে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে তার।

রোগীর মৃত্যু যখন প্রায় নিশ্চিত তখন ডাক্তারের চিকিৎসা কোনো কাজে লাগে না। তার প্রেসক্রিপশনে ভুল হয়। সরকারের যখন জনপ্রিয়তা কমে যায় তখন প্রথমে তারা তা ধরতে পারে না। যখন বোঝে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন সরকারের অবস্থা অনেক ডাক্তারের মতো।

পৌনে পাঁচ বছরের শাসনে শেখ হাসিনা জনসমাবেশ করেছেন কয়টি? তার চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে তিনি সভা করছেন এখন। এসব সভায় জনগণকে তিনি জানান দিতে চাইছেন এই সময়ে কত উন্নয়ন করেছে তার সরকার। বিরোধী দলের সমালোচনাসহ আরও অনেক কথা বলছেন তিনি। কিন্তু সেগুলো এখন আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আমি খেয়াল করছি অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের রাজনীতিতে এজেন্ডা হিসেবে এক নম্বরে উঠে এসেছে।

নরসিংদীর জনসভায় বেগম জিয়া শেখ হাসিনার বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, কোথায় কী উন্নয়ন করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তো কেবল গুম, খুন, দুর্নীতি আর লুটপাটের রাজত্ব চালিয়েছেন। দুর্নীতিকে আমরা সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করি_ এ মন্তব্য করে বেগম জিয়া বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে তারা উন্নয়ন ও প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না। দুর্নীতি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দলের সংসদ ও মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হবে।

দেশের প্রধান দুটি দল তার প্রধান দুই নেত্রী এভাবে দেশের উন্নয়নের প্রশ্নে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলুন এটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক। এ দুটি দল তথা দুই নেত্রী তো একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করুন এটাই গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত। তাহলে সমাজ ও জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা প্রয়োজন রাজনীতিতে সেই উপাদানগুলো যুক্ত হবে। শেখ হাসিনাকে এখন বলতে হবে, সত্যি সত্যি কী উন্নয়ন তিনি করেছেন? খুবই চমৎকার কাভারে প্রায় দুই ফর্মার একটি বুকলেট তিনি ছাপিয়ে দিলেন দিনবদলের অঙ্গীকার হিসেবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দারিদ্র্যবিমোচন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অগ্রাধিকার ও অঙ্গীকারসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছিল তাতে। এখন শেখ হাসিনা তার সরকারকে, তার দলকে, তার জোটকে বলতে হবে এই প্রত্যয়গুলোর অবস্থা কী? সেটা গায়ের জোরে একপক্ষীয়ভাবে বলে গেলেই চলবে না। তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণসহ বলতে হবে। দেশের মানুষ শেখ হাসিনার বা খালেদা জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী কোনো কিছুতে বিশ্বাস করবে না। বিরোধী দলের নেতা যথার্থই প্রশ্ন করেছেন দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে।

এ সম্পর্কে মিডিয়া ও নাগরিকদের পক্ষ থেকে এর আগেও প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনা তার শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে বলেছিলেন, তার মন্ত্রীদের কেউ দুর্নীতিবাজ নন। কেউ তাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারবে না। তারপরে একজন মন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টা দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারিয়েছেন।

একজন মন্ত্রীর ব্যাগ থেকে কালো বিড়াল বেরিয়ে এসেছে।

দেশের লক্ষ-কোটি জনতার আঙ্গুল এখন তার অনেক মন্ত্রীর দিকে। কোনো কোনো মন্ত্রী এতদূরে অবকাশ যাপন করতে চলে গেছেন মানুষের আঙ্গুল ততদূর পেঁৗছাচ্ছে না। এমনকি এতদূর যেতে যেতে তাদের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই যে পাঁচ সিটি করপোরেশনের প্রার্থী নিয়ে তিনি এত বড়াই করেছেন তারা তাদের পৌনে পাঁচ বছরের মেয়াদে হিসাবের বাইরে যে কতগুণ সম্পদ আহরণ করেছেন তা তাদের নিজেদের প্রদত্ত তথ্যেই জানা গেছে। সুজনের প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের কোনো প্রতিবাদ আজ পর্যন্ত কোথাও দেখিনি।

প্রতিবছর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া হবে এই মর্মে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। সরকারে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সেই ওয়াদা প্রতিপালন করেনি। এসব নিয়ে কথা তো উঠবেই। রাজনীতি আর কেবল অতীত চিবানুর ব্যাপার থাকবে না।

বিরোধীদলীয় নেতা নরসিংদীর জনসভায় এ কথাগুলো বলেছেন।

যদিও তিনি বলেছেন, তারা দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন। ক্ষমতায় গেলে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করবেন, তা খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না মানুষের কাছে। তারাও তো এর আগে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তখন তারা কী করেছেন সেটা তো মানুষ জানে। শেখ হাসিনা তো প্রায়শই হাওয়া ভবনের উদাহরণ দিচ্ছেন।

বেগম জিয়া বা তার দল যতই বলুন না কেন যে, বর্তমান সরকার জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে চায়, সে জন্যই তার দুই ছেলের নামে মিথ্যা সব অভিযোগ আনা হচ্ছে। তা কিন্তু জনগণের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে কনিষ্ঠ ছেলে কোকোর সম্পর্কে যে অভিযোগ উঠেছে তার যথাযথ জবাব বিএনপি দিতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না।

এ কথা ঠিক, আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ থেকে মানুষ এখন বিএনপির দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না এসব কথা তারা বিশ্বাস করছে।

এগুলো হলো এক ধরনের নীতিবাচক সমর্থন। এসব সমর্থন যে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির কাজে আসে না তা অভিজ্ঞতা থেকে দুটি দলেরই শেখা উচিত। তারা তা শিখেছি কি?

২৪ জুলাই বিরোধী দলের নেতার ছেলে তারেক রহমান লন্ডনের এক হোটেলে ইফতার মাহফিলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক বক্তৃতা দেন। যাকে পর্যবেক্ষক মহল বিএনপির আগামী নির্বাচনের ইশতেহারের আউট লাইন হিসেবে মনে করছেন। পর্যবেক্ষক মহল এও মনে করছেন যে, দুই নেত্রী তাদের দুই সন্তানকে রাজনীতির সামনে এবারই উপস্থাপন করবেন।

সে হিসেবে এই দুই উঠতি নেতার বক্তব্যই গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করা দরকার উভয়েই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছেন।

বিরোধী দলে আছে বলেই বিএনপি অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে; কিন্তু আমি বলছি সেই সুবিধা শর্তহীন নয়। বেগম জিয়াও জানেন জনগণের মধ্যে উত্থিত প্রশ্নেরগুলোর জবাব তাকে দিতে হবে। বিএনপি কি সে ব্যাপারে প্রস্তুত? মনে হচ্ছে না।

বেগম জিয়া বলেছেন, বিএনপি জোট এবার ক্ষমতায় গেলে পরিবর্তনের রাজনীতি করবে। নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার গঠন করবে। বিরোধীদলীয় নেতা এ কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও নতুন ধারা কী, এখনই তা জানাতে চাননি। তিনি বলেন, এখন জানালে দেখা যাবে আওয়ামী লীগ সেটাই বলতে শুরু করেছে। যথাসময়ে এটা জানানো হবে।

খুবই হাস্যকর নয়? উনার কথা যদি আওয়ামী লীগ বলে সেটা তো ভালো। তাতে দেশের লাভ, বিএনপির লাভ, আওয়ামী লীগের লস নেই। সত্যি কি নতুন ধারার কিছু আছে বেগম জিয়ার অাঁচলে! মানুষ সেটা দেখতে চাইবে। শূন্য কলস বেশি বাজছে না তো? অথবা নতুন বোতলে পুরনো মদ চালিয়ে দেওয়া হবে?

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.