আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বধ্যভূমির অভিজ্ঞতা-২

অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি

রাত প্রায় একটার সময় পাশের ঘরে রাইফেলের গুলি লোড করার শব্দ এবং লোকজনের ফিস ফিস করে আলাপের শব্দ শুনতে পেলাম। সারা শরীরে আমার ভয়ের হিমস্রোত চকিতে ভরে উঠল। খানিকপর একটা লোক এসে আবার আমাদের দেখে গেলো। তারো খানিকপর কয়েকজন লোক আমাদের ঘরে ঢুকল। তারাই আমাদের ঘরের বাইরে নিয়ে এল।

এরপর বদর বাহিনীর একেকটি পশু আমাদের দুজন দুজন করে ধরে সিড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনল। তিনটি বাসে তারা আমাদের সবাইকে নিয়ে তুলল। তাদের হাবভাব, ফিসফিস করে কথাবার্তা শুনে মনে হলো- আর রক্ষা নাই। বাস ছেড়ে দিল, বাসের সব কটি জানালা উঠানো। বুঝতে পারলাম, আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর বাস এসে থামল কতগুলো ঘরের পাশে। ঘরের দরজা বেশ বড় বড় এবং কোনাকুনি লাঠি দিয়ে আটকানো। কিন্তু তারা আমাদের ঘরে না ঢুকিয়ে ধরে নিয়ে চলল। কৌশলে চোখের বাঁধন আলগা রাখার সুযোগ হলো বলে দেখতে পেলাম সামনে বিরাট এক বটগাছ, তার সমুখে একটি বিরাট বিল, মাঝে মাঝে কোথাও পুকুরের মত রয়েছে। বটগাছের আরো কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম ১৩০ থেকে ১৪০ জন লোককে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

এর মাঝে এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে আমি আমার পরনের লুঙি হাটুর উপর উঠিয়ে রেখেছি। চোখ বাধা অবস্থায়ও আমি যে দেখতে পাচ্ছি তা বদর বাহিনীর লোকেরা বুঝতে পারেনি। বদর বাহিনীর লোকজনের হাবভাবে স্থির নিশ্চিত হলাম, আমাদের হত্যা করার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে। আমি এখন আমার সমগ্র চেতনা কেন্দ্রীভূত করে ভাবছি- কি করে বাঁচা যায়। দেখতে পেলাম- বদর বাহিনীর পশুরা আমার সামনের লোকদের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধছে।

আমাদের মতো বন্দি একজন চিৎকার করে বলে উঠলেন- আপনারা বাঙালী হয়ে আমাদের মারছেন! কোনো পাঞ্জাবি যদি মারত তাহলেও না হয় বুঝতে পারতাম, কেন আমাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আমরা কি অন্যায় করেছি? ভদ্রলোকের গায়ে রাইফেলের এক ঘা দিয়ে বদর বাহিনীর এক জল্লাদ গর্জে উঠল- চুপ কর শালা। কে যেন একজন বলে উঠল- আমাকে ছেড়ে দিন, দশ হাজার টাকা দেব। কোন এক মহিলা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন- আপনারা আমার বাপ, ভাই। আমাকে মারবেন না। চারিদিকে মাতম, আহাজারি, তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই।

সামনের লোকদের দলে দলে ভাগ করে তারা ফাকা মাঠে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। আমার সারা শরীর যেন ভয়ে জমে যাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে আমি বাচার আশায় পালাবার সম্ভাব্য সব উপায় ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে- কোন উপায় আর নেই। আবার মনে হচ্ছে, বাচার কি কোনো উপায় নেই! জল্লাদদের একজন আমার কাছে এসে দাঁড়াল।

আমার পেছনের লোকের গেঞ্জির সঙ্গে সে আমার গেঞ্জি ভালো করে বেধে দিল। হঠাৎ সে সময় পেছনের লোকটি বলে উঠল- আজিজ ভাই তুমি! তুমি আমাকে মারতে নিয়ে এসেছো! তুমি থাকতে আমাকে মেরে ফেলবে! আপসোস। রাইফেলধারী লোকটি কোন কথা না বলে চলে গেল। এদিকে বেয়নেট দিয়ে জল্লাদের দল তাদের হত্যালীলা শুরু করে দিয়েছে। ছুড়ছে গুলি।

চারদিকে আর্তচিতকার, মাঝে মাঝে জল্লাদদের কেউ চিতকার করে বলে উঠছে- শালাদের খতম করে ফেল। সব ব্যাটাদের খতম করে ফেলব। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে আর্তচিৎকারের সঙ্গে পৈশাচিক হাসি। এমন নারকীয় তান্ডবলীলার মধ্যে আমি জীবনপণ করে আমার হাতের বাঁধন খুলে ফেললাম। আমার সামনের প্রায় তিরিশজনকে ততক্ষণে সামনের মাঠে খতম করে ফেলেছে বদর বাহিনীর পশুরা।

এক হাতে আমি আমার গেঞ্জির গিট খুললাম। বাঁহাতের দড়ির বাঁধন খুলে দড়িটা হাতের নিচে চাপা দিয়ে রাখলাম। হাত আবার পেছনে দিয়ে রাখলাম। বদর বাহিনীর এক দস্যু আমার সামনের কয়েকজন লোক নিয়ে তখন ব্যস্ত। কে যেন বলে উঠলেন- আল্লাহর কাছে তোরা দায়ী থাকবি।

লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লহ। মাগো...। আমি আমার চোখের বাধনের কাপড়টি সরিয়ে ফেলে খুব জোরে দৌড় দিলাম। প্রায় হাত কুড়ি যাওয়ার পর এই এই বলে হাঁকডাক শুনতে পেলাম। আমার তখন কোনো দিকে খেয়াল নেই।

শুনতে পেলাম গুড়ুম গুড়ুম করে দুটো আওয়াজ। অন্ধকারে প্রায় ৪০ গজ যাওয়ার পর সামনে পড়ল কাদা। কর্দমাক্ত জায়গাটি পার হওয়ার সময় আবার দুটি গুলির আওয়াজ শুনলাম। কিন্তু অন্ধকারে তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। আমি কাদার মধ্যে পড়ে গেলাম।

প্রায় ৩ ফুট গভীর পানি। সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে আমি পানি ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। খানিকক্ষণ চেষ্টার পর শুকনো জায়গা পেলাম। উঠে আবার দৌড়ানো শুরু করলাম। দূর থেকে আমার দিকে টর্চের এক ঝলক আলো ভেসে এলো।

আবার দুটি গুলির শব্দ। সাথে সাথে আমি কাত হয়ে পড়ে গেলাম। গড়াতে গড়াতে পড়ে গেলাম আবার পানির মধ্যে। প্রাণপনে সাতার কেটে এগিয়ে চললাম। এরপর শুকনো বিল আর নদী পেরিয়ে এগিয়ে চললাম।

গায়ে শক্তি নেই, কিন্তু তখন আমি দিকভ্রান্ত। নিরাপত্তার জন্য নদীর পারে না উঠে উজানে এগিয়ে চললাম। রাতের তখন বেশি দেরি নেই। খানিক পর উঠে পড়লাম নদী থেকে। বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলাম নদীর তীরে এক ঝুপড়িতে।

সকালে রোদ ওঠার পর চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। বুঝতে পারলাম না কোথায় এসেছি। গ্রামের আভাস যেদিকে পেলাম সেদিক পানে এগিয়ে চললাম। খানিকপর শুনলাম কারা যেন আমাকে ডাকছে। প্রথমে ভয় পেলেও পরে বুঝলাম এরা গ্রামবাসী।

তাদের সব বললাম। বটগাছের বিবরন দিতে তারা বলল- ওটা রায়ের বাজার ঘাটের বটগাছ। সেখান থেকে পরে আমি আটির বাজারে মুক্তিফৌজের কমান্ডারের সাথে দেখা করি। তিনি আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। দু’দিন পর ফিরে এলাম স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে।

তখনো বুঝিনি, এখনো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে যে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সত্যি কিভাবে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। (শেষ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।