আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাগ বিষয়ে...

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। দীর্ঘ ছয়টি বছর আমি সেখানে ছিলাম, সুতরাং জাহাঙ্গীরনগর এর সংস্কৃতি, শিক্ষার্থীদের মানসিকতা নিয়ে আমার মোটামুটি ভালই জানার কথা, এবং আমার ধারণা, আমি সেটা জানি... গতকাল জাবি ক্যাম্পাসে RAG দেয়া সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে পোস্টটা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম, হতভম্ব! এই কি সেই জাহাঙ্গীরনগর যাকে আমি চিনি? ছয়টি বছরের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত যে ক্যাম্পাসের নিঃশ্বাস আমি বুক ভরে টেনেছি! আমি বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাইনি। যে ক্যাম্পাসের কথা ভাবলে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি সেই ক্যাম্পাসে ঘটা এমন একটি বিকৃত ঘটনায় নিঃসন্দেহে শুধুমাত্র একটি নির্ঘুম রাত্রীই যথেষ্ট নয়। এবং সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ইনবক্স ভর্তি মেসেজ, সেই মেসেজগুলতে ব্যাক্তিগত অনেক খোঁচা যেমন আছে, অনেকেই আবার বিষয়টা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণও করতে চেয়েছেন, মতামত চেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে মতামত দিতে গিয়ে দিশেহারা ফিল করছি।

যারা এই পোস্টটি পড়ছেন, তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, পোস্টটি পুরোপুরি না পড়ে, না বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই এই ক্যাম্পাস সম্পর্কে অজস্র গাল-গল্প শুনেছি, তার মধ্যে আদি-রসাত্মক কাহিনী-ই বেশি। সেই গল্পগুলাতে এমনো রয়েছে যে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা হাফপ্যান্ট পড়ে রাস্তায় হাঁটে, জাহাঙ্গীরনগরের ল্যাম্পপোস্টে কোন লাইট থাকেনা, কারন সন্ধ্যার পর যাতে ক্যাম্পাসের চিপা-চাপা গুলা আরও অন্ধকার হয়ে যায়, এখানে মেয়েরা বোরকা পড়তে পারেনা, এখানে ছেলেদের হলে মেয়েদের অবাধ যাতায়াত, এখানে হলের ছাদে ছাদে গাঁজার চাষ হয় এমন আরও আরও আরও অনেক... সম্ভবত এমন একটি অবাধ রঙ্গিন দুনিয়ায় ভর্তি হবার লোভেই চিটাগং ইউনিভারসিটির বিবিএ রেখে জাহাঙ্গীরনগরের নৃবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু আফসোস! এইখানে মেয়েদের কোনদিন হাফপ্যান্ট পড়ে দূরে থাক থ্রী কোয়ার্টার পরেও রাস্তায় ঘুরতে দেখলাম না, আমার ক্লাশের ৪৫ জনের মধ্যে অন্তত ৭-৮ জন ছিলেন যারা বোরকা পরে ক্লাশে আসতো, এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি গলি ঘুঁজিতে পর্যন্ত ঝা চকচকে লাইট জ্বলতে দেখেছি, বাংলাদেশর যতগুলা পাবলিক ইউনিভার্সিটি রয়েছে, সম্ভবত জাহাঙ্গীরনগরের বিদ্যুৎ সুবিধাই সবচেয়ে বেশী নিরবিচ্ছিন্ন। শুধু তাই নয়, নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রোক্টরকে দেখেছি তার টিম নিয়ে সন্ধ্যার পরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস টহল দিতে। ছয় বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রবলভাবে অসুস্থ হওয়ার পরো কোন মেয়ে সহপাঠীকে দর্শনার্থী হিসেবেও ছেলেদের হলে ঢোকার প্রবেশাধীকার পেতে দেখি নি।

অথচ আমার এক মেয়ে কাজিন জাহাঙ্গীরনগরে চান্স পেয়েও উপরোক্ত ‘প্রতিষ্ঠিত প্রোপ্যাগান্ডার’ কারণে বাসা থেকে ভর্তির ছাড়পত্র পান নি... অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি... মোটেই তা না... লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়বেন... জাহাঙ্গীরনগরে যে সব ছেলে মেয়ে পড়ে, তারা কি আমেরিকা-ইউরোপ থেকে এসেছে? তাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি কি ভীন্ন? নাকি বাংলাদেশের আর দশটা অন্য সাধারণ পরিবার থেকেই তারা এসেছে? এবং সেই সকল পরিবারও কিন্তু দেশের আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতই একই মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ধারণ করে, তাহলে? তাহলে কোন সে জাদু মন্ত্রবলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাস ছয়েকের মধ্যে তারা একেক জন হয়ে যায় তথাকথিত ‘মুল্যবোধহীন’, ‘লাজ-লজ্জাহীন’, ‘অবাধ-নির্বিচার’ এইসব আচরণ অনুশীলনকারী?? কি?? অনেককেই বলতে শুনেছি, জাহাঙ্গীরনগরের সুনসান পরিবেশ, চিপা-চাপা, ঝোপ-ঝাড় এই জন্য দায়ী। খুবই হাস্যকর যুক্তি। একটি ছেলে মেয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তখন কিন্তু সে প্রাপ্ত বয়স্ক, এবং সে জানে তার কি করা উচিত কিংবা উচিত না... সুতরাং, সে কার সাথে কি করবে কিংবা করবে না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায় একান্তই তার, কোন নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের না। যারা রাবি, চবি, শাবিপ্রবি, ঢাবি, কিংবা বাকৃবি’র মতো বড় ক্যাম্পাসের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, এ বিষয়ে তারা ভালো বলতে পারবেন, আপনি ক্যাম্পাসের কোথায় কার সাথে যাবেন, সে বিষয়ে কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে কিংবা জবাবদিহি করতে আপনি বাধ্য? বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অর্ডিনেন্সে কি এই বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা আছে? না থাকা উচিত? বিশ্ববিদ্যালয়ে কম বেশী RAG er শিকার আমরা সকলেই হয়েছি। একটা বিষয় ক্লিয়ার করি, বাংলাদেশে যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, জাহাঙ্গীরনগরের সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক সম্ভবত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং গভীর।

এবং 'এই RAG কিংবা RAG না, কিছু সুস্থ এবং সহনশীল ও মজাদার বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা' কালচারের একটা শক্তিশালী ভূমিকা এতে আছে, এক্সকিউজ মি, আমি RAG'র পক্ষে কোন সাফাই দিচ্ছিনা। আমি বলতে চাইছি, সেই RAG বা সুস্থ এবং সহনশীল ও মজাদার বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা কতটা উপভোগ্য আমাদের কাছে ছিল। সেটা অনেকক্ষেত্রে অনেক কনষ্ট্রাকটিভ এবং মজারও ছিল। কিন্তু শেষ কিছু দিন থেকে বিষয়টি ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল, এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকাই নিয়েছিল। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই বিষয়ে সতর্কতামূলক পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট টাঙিয়েছে, এমনকি, রুমে রুমে গিয়ে লিফলেট পর্যন্ত দিয়ে এসেছে... এবং RAG erআধিক্য কিন্তু ক্রমশই কমে যাচ্ছিল... অনেক সিনিয়রদেরই বলতে দেখেছি, ধুর! এখনতো RAG-ই হয় না।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, ঘটনাটা হচ্ছে এমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু একজন মেয়ে শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কয়েকজন বড় আপু’ মেয়েটির ক্লাশের সিনিয়র ভাইয়েদের কাছে গিয়ে তার ব্রেস্টের মাপ দিয়ে আসতে বলেছে!! ঘটনাটি কতটুকু নোংরা সেটি বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই বড় আপুরা কারা? আপনি যদি একজন মেয়ে হয়ে এই লেখাটি পড়ে থাকেন, আমার প্রশ্ন, একজন মেয়ে হয়ে আপনি আরেকটি মেয়েকে উপরের কথাটি বলতে পারেন কিনা! কিংবা আদৌ কোন মেয়ে পারে কি না! আমার ধারণা, যেই মেয়েগুলো ওই ‘কাজটি করেছে’ তারা আপনার মতোই একটি পরিবার, পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে এসেছে, এবং একজন মেয়ে হিসেবে কিছু সহজাত বোধও তাদের থাকার কথা! সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ছয় মাস-একবছর-দেড় বছরের মধ্যে তাদের সেইসব বোধ কই গেল? কিভাবে গেল?? আদৌ গেল কিনা? তারা আসলে কি বলেছে? উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে সধারানত ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থীরাই RAG দিয়ে থাকে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় লাইফে কোন মেয়ে শিক্ষার্থীকে ‘সেই অর্থে’ বড় ধরনের RAG'র শিকার হতে দেখি নি, যেগুলোর সাথে কিংবা কাছাকাছিও সাম্প্রতিক এই ঘটনাটিকে দাড় করানো যায়! জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাশ করে গেছেন এমন আপু-রা এক্ষেত্রে ভালো বলতে পারবেন। তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, বিষয়টি হেলা-ফেলা করে এড়িয়ে যাবেন না। ইস্যুটা অনেক বড়।

একজন জাহাঙ্গীরনগরিয়ান হিসেবে প্রায়ই কিছু নেতিবাচক এবং অগ্রহনযোগ্য অনেক মন্তব্যই আমাদের শুনতে হয়, এবং এর পেছনে আমাদের নিরব ভুমিকাও কোন অংশে কম দায়ী নয়... উপরের ঘটনাটির যারা ভুক্তভোগী, যারা ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার, তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, অভিযুক্তদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত এবং যথাযথ তথ্য দিন, আমরা যারা জাহাঙ্গীরনগরকে ভালোবাসি, যারা চাই না জাহাঙ্গীর নগরকে নিয়ে কোন সত্য-কিংবা মিথ্যা নেতিবাচক প্রচারণা ছড়াক, আমরা আমাদের সরবচ্চ চেষ্টা করবো বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানর এবং প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের। কিন্তু দয়া করে কোন ধরনের অথেনটিক এবং সুস্পষ্ট তথ্য না দিয়ে ফেসবুক/ ব্লগের মতো জনপ্রিয় পাবলিক ডোমেইনে ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন প্রচারণা চালাবেন না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.