আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবুলের প্রথম প্রেম...



পুলিশের আনাগোনা। তাও আবার আবুলদের বাসায়। পাড়ার লোকজন ওদের বাসার সামনে জটলা পাকিয়ে-ঘুসুর-ঘুসুর, ফুসুর-ফুসুর করছে। সামনে এগিয়ে যেতেই থমকে গেলাম। দেখলাম আবুলের হাতে হাতকড়া, মাজায় রশি।

মেয়ে মানুষের মতো সে আহাজারি করে কাঁদছে। আর চোখের জল গাল বেয়ে টুপটুপ করে জামার বুক পকেটে পড়ছে। ওর বাবা-মাও কেঁদে-কেটে অস্থির। আবুলকে টেনে হিঁচড়ে পিক আপে উঠিয়ে নিয়ে গেলো পুলিশ। পাড়ার লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, এমন জঘণ্য কাজ করলে তো এই দশাই হবে।

ছি! ছি! ছি! ছেলেটা দেখতে হাবাগোবা হলেও আসলেই মিনকে শয়তান। মফিজ্যার বাসায় গিয়ে পুলিশ তাকে পায় নি। ধরা পড়লে মফিজ্যাও মজাটা টের পাবে। মাস দুয়েক আগের কথা। শুনলাম আবুল নাকি কবিতা লিখছে।

বড়ই চিন্তার বিষয়। ও তো কবিতার ক’ও জানে না। হলোটা কি আবুলের। আবুলের বন্ধু মফিজের সাথে দেখা হলো রাস্তায়। একটা সাদা মুলা কসমস করে খাচ্ছে সে।

আমাকে দেখে মফিজ মার্কা একটা হাসি দিলো। মফিজের কাছেই শুনলাম আবুল প্রেমে পড়েছে। ও পাড়ার ছলনার জন্য সে পাগল। ঘরে বসে কবিতা লেখে আর মফিজের হাতে পাঠিয়ে দেয় ছলনার কাছে। আবুল যে প্রেম করবে ভাবতেই হাসি পাচ্ছিলো।

সে তো লজ্জার বাদশা। মেয়েদের দেখলে ওর হার্টবিট বেড়ে যেতো। যাহোক লজ্জার বাদশা হলে যে প্রেম করতে পারবে নাÑ এমন তো কোনো কথা কোথাও লেখা নেই। তাই বলে আবুল? আমাদের শতচেনা বোকার হদ্দ আবুল? পরদিন দেখা হলো আবুলের সাথেই। নাকের ঠিক উপরেই একটা ব্যান্ডেজ।

মুখোমন্ডল পুরোটাই উঁচু-নিচু। খেলার মাঠের একপ্রান্তে বসে স্থানীয় একটি পত্রিকা পড়ছে। আমাকে দেখেই ও কেমন যেনো বিব্রতবোধ করলো। -কি রে আবুল তোর নাকের এ অবস্থা কেনো? কি হয়েছে, বলতো। ও ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

ছলনার ভাই শামসু আজ সকালেই ওকে একটু আদর করেছে। আর বলে গেছে ভবিষ্যতে তার বোনের কাছে কোনো কবিতা কিংবা চিঠি পাঠালে দুই পা কেটে ওর দুই হাতে ধরিয়ে দেবে। আজ স্যাম্পল দেখিয়ে গেছে মাত্র। আবুল অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাইজান এখন কি হবে? আমি ওর হাত থেকে পত্রিকাটা নিয়ে দেখলাম একটা কবিতা ছাপা হয়েছে। কবির নাম আবুল খাঁন।

-এটা কি তোর লেখা কবিতা? ও মাথা নাড়ালো। পড়লাম এক নিশ্বাসে। চৌদ্দ লাইনের মধ্যে আঠারোটি বানান ভুল। কবিতার মান সম্পর্কে আর কিছু না-ই বা বললাম। টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন আকারে কবিতাটি সে ছাপিয়ে নিয়েছে।

বুঝলাম ছলনার ভাই এমনিতে ক্ষেপে নি। হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো, ভাইজান ছলনাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি বললাম, আচ্ছা তুই আপাতত কান্নাকাটি বন্ধ কর। কি করা যায় আমি দেখছি। কয়েকদিন অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম।

এদিক সেদিক সেদিক তাকানোর কোনো ফুরসৎ পাই নি। সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে দেখা হলো মফিজের সাথে। ওর এক হাতে ব্যান্ডেজ। Ñ কি রে এ্যাক্সিডেন্ট করেছিস নাকি? ও কোনো কথা বলেই চলে গেলো। পরে শুনলাম ছলনাকে চিঠি দিতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলো মফিজ।

এজন্যই তার এই হাল। আবুলের বিষয়টি নিয়ে রাতে ভাবলাম। মনে মনে হাসলাম। সকালে ওদের দুজনকে ডাকলাম আমার রুমে। মফিজ আর আবুল যথাসময়ে আসলো।

আবুলের একটাই দাবি ছলনাকে বিয়ে করবে সে। ছলনা এবার এসএসসি পাশ করেছে। দেখতে চমতকার। মফিজকে বললাম, ছলনা কি আবুলকে ভালোবাসে? মফিজ ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো, জানি না ভাইজান, চিঠি কবিতা দিলে শুধু হাসে। আবুল লাফিয়ে উঠে বললো, ছলনা আমাকে খুব ভালোবাসে ভাইজান।

আমি আবুলকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, ছলনা আবুলকে কোনো চিঠি দিয়েছে কি না। মফিজ বললো, চিঠি দেয় নি। তবে আবুলের মোবাইলে কয়েকদিন ফোন করেছিল। - ফোন করে কি বলেছিলো? - তেমন কিছু না ভাইজান। ও আবুলের কাছে একটা মোবাইল ফোন চেয়েছিলো।

কিন্তু মোবাইল ফোন কিনে দেয়ার পর ছলনা বলে ওটা তার ভাই ভেঙে ফেলেছে। আমি করবো ভেবে পেলাম না। ওদের বললাম, তোরা যা কি করা যায় আমি ভেবে দেখি। আর শোন আবুল তুই এসব ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় মন দে। বেশ কয়েকদিন ধরে আবুলের সাথে আমার দেখা হয় নি।

একদিন বিকেলে আবুল এলো আমার বাসায়। চোখে মুখে অন্যরকম আনন্দ রেখা। শুনলাম ছলনা আগামীকাল মফিজকে সাথে নিয়ে কাজী অফিসে যেতে বলেছে। ও বললো, ভাইজান, এই শুভদিনে তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে। টাকাপয়সা রেডি করছি।

কোথায় টাকা পেয়েছে সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না। শুধু বললাম, এই ঝামেলায় যাস নে। ও রাগ করে উঠে চলে গেলো। পরদিন আমি চলে গেলাম অফিসে। কাজের চাপে আবুলের কথা আমার মনে হলো না।

আবুল আর মফিজ বিয়ের সরঞ্জামাদি নিয়ে কাজী অফিসে উপস্থিত হলো। ছলনা আগেই এসে বসে আছে। ছলনা ওদেরকে বসতে বলে বার বার কোথায় যেনো ফোন করছিলো। আবুল কাজী সাহেবকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বিয়ের কাজ শুরু করতে বললো। ছলনা আবুলের গালে হাত বুলিয়ে বললো, না একটু অপেক্ষা করতে হবে সোনা।

আবুল ভ্র“ কুঁচকিয়ে বললো, কেনো, দেরী করতে হবে কেনো? ছলনা আবুলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোনে কাকে যেনো ট্রাই করতেই থাকলো। ছলনার আচরণে কাজী সাহেব কিছূটা ভয় পেয়ে গেলেন। দুই হাজার টাকার অপ্রাপ্ত বয়স্কা ছলনার বিয়ে পড়িয়ে দিতে রাজি হয়েছেন তিনি। তার না আবার কোনো বিপদ হয়। আবুল আর মফিজও দুঃচিন্তায় পড়লো।

তারা ভাবলো, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে না তো? ওরা মনে মনে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলো। এমন সময় একটা সুঠামদেহী যুবক কাজী অফিসে এলো। ছলনা দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললো, এতোক্ষণে তোমার আসার সময় হলো? ছেলেটি বললো, হুট করে বিয়ে করতে চাইলেই হলো? টাকা তো নেই। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা সাক্ষীও ম্যানেজ করতে পারলাম না। ছলনা মুচকি হেসে আবুলের দিকে তাকিয়ে বললো, চাচাজান আপনার আসতে তো কোনো কষ্ট হয় নি? এই সোহাগ এসো চাচার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।

এইটা হলো আমার আবুল চাচা, যিনি বিয়ের সব খরচাপাতি করছেন। আর উনি হলেন আবুল চাচার ঘণিষ্ট বন্ধু। একথা শুনে আবুলের চোখমুখ একেবারে চুপসে গেলো। মফিজও কেমন যেনো হতভম্ব হলো। আবুল বললো, একি বলছো ছলনা? - চাচাজান ঠিকই তো বলছি, তুমি না থাকলে আমাদের বিয়েটা কিভাবে হতো।

তোমার ঋণ আমরা কোনো দিনও শোধ করতে পারবো না। আবুল আর মফিজ চলে যেতে লাগতেই ছলনা বললো, দাঁড়াও চাচাজান সাক্ষীর ঘরে দুজনে দুটা স্বাক্ষর করে জামাইকে দোয়া করে যাও। একদিন দেরী করলে ব্যবসার এমন কোনো ক্ষতি হবে না। জানো চাচা সোহাগ মাস্তান হলেও খুবই ঈমানদার। মাস্তান শুনে আবুলের বুক ধরফর করতে লাগলো।

তারপর যা হবার তা হলো। আবুল আর মফিজ সাক্ষী হিসেবে খাতায় সাক্ষর করে কেঁদে-কেটে বাসায় চলে এলো। বিয়ের পর সোহাগের সাথে ছলনা পগারপার হয়ে গেলো। খবরটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। ছলনার বাবা তার বিয়ের অনুপোযুক্ত অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েকে ফুসলিয়ে বিয়ে করার অভিযোগে মামলা করলেন।

বিয়ের খাতায় সাক্ষী হিসেবে আবুল ও মফিজের নাম থাকায় তাদেরকেও মামলার আসামি করা হলো। উপরন্তু তাদের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলাও দায়ের করা হলো। আবুলকে নিয়ে যখন পুলিশ ভ্যানটি চলে গেলো তখন কেনো জানি নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হলো। আমি একটু সতর্ক হলে হয়তো এমন কান্ড ঘটতো না। বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখা উচিত ছিলো।

মফিজ নাকি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গছে। আর লজ্জার বাদশা আবুল প্রেম করতে গিয়ে কি ধরাটাই না খেয়ে গেলো। সেটাও আবার ওর জীবনের প্রথম প্রেম। শুনেছি প্রথম প্রেমের স্মৃতি ভোলা যায় না। আবুল কি তার প্রথম প্রেমের স্মৃতি আদৌ ভুলতে পারবে?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।