আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোমল পানীয় না বিষের বাণিজ্য? (লিখেছেন-পাভেল পার্থ)

গভীর কিছু শেখার আছে ....

ভারতের সাগর আর পাহাড় ঘেঁষে এক্কেবারে দক্ষিণের রাজ্য কেরালা। এই কেরালার একটি আদিবাসী গ্রামের নামই প্লাচ্চিমাঢ়া। ২০০২ সালে কর্পোরেট কোকাকোলা কোম্পানি প্লাচ্চিমাঢ়া গ্রামের আদিবাসী কৃষি ও বসতজমি দখল নিয়ে প্রায় ৪০ একর জমির ওপর হিন্দুস্থান কোকাকোলা কোম্পানির কারখানা বসায়। তারা আদিবাসীদের বোঝায়, এতে আদিবাসীদের লাভ হবে, অনেক মানুষ কারখানায় কাজ পাবে, কারখানার বর্জ্য থেকে সার বানাতে পারবে। কোকোকোলা এ এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬ লাখ লিটার ভূগর্ভস্থ পানি তোলে, যা থেকে তৈরি করা হয় প্রায় হাজার লাখো বোতল তথাকথিত কোমল পানীয় নামের কোকোকোলা।

কিন্তু বছর না যেতেই দুর্দশা শুরু হয় প্লাচ্চিমাঢ়ায়। আদিবাসীরা প্রথম থেকেই কোকোকোলার বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিলেন প্রতিরোধ। দেখা গেল এখন ওই এলাকায় বৃষ্টি কম হচ্ছে, মাটির তলায় আর পানি নেই, চাষের জমি নেই, মানুষের নানা রোগ ছড়াচ্ছে। আদিবাসীদের কোকোকোলা বিরোধী আন্দোলনের দিকে দুনিয়া না তাকালেও সম্প্রতি দুনিয়ার মনোযোগ পড়তে বাধ্য হয়েছে কেরালাতেই আবার। কারণ এই কেরালাতেই নিষিদ্ধ হয়েছে কোক-পেপসি।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) ভারতের নানা এলাকায় ব্যবহৃত কোক-পেপসির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছে, এসবে ক্ষতিকর কীটনাশক আছে। ২০০৬ সালের ৪ আগস্ট ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে তুমুল আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী ভিএস অচ্যুতানন্দ সাংবাদিকদের জানান, কোকাকোলা ও পেপসিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক পাওয়া গেছে। এগুলো পান করা স্বাস্থ্যের জন্য তিকর। গবেষণা সংস্থাগুলো কী বলছে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) ২০০৩ সালে কোকাকোলা ও পেপসিসহ কোমল পানীয় হিসেবে বিক্রীত ১১টি ব্র্যান্ড নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখিয়েছিল, ওইসব পানীয়তে কীটনাশকের পরিমাণ অনেকগুণ বেশি।

গত বছর আবারো তারা ভারতের ১২টি রাজ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোকাকোলা ও পেপসিতে ৫ ধরনের কীটনাশক রয়েছে। ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডের (বিআইএস) নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় পেপসি-কোলায় এর পরিমাণ ৩০ গুণ বেশি এবং কোকাকোলায় এর পরিমাণ ২৫ গুণ বেশি। সিএসই কোক-পেপসির ৫০ শতাংশ বোতলেই ম্যালাথিয়ন বিষ পেয়েছে। এই বিষ শহর এলাকায় মশা ও পোকামাকড় মারার জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও লিন্ডেন, হেপ্টল্টাকোর, কোরপাইরিন এ বিষগুলোও কোক-পেপসিতে পাওয়া গেছে।

কেবল কোকোকোলা বা পেপসিকো নয়, নেসলের পিওরলাইফ, পেপসিকোর অ্যাকোয়াফিনা, পার্লের বিসলারি পানিতেও (মিনারেল ওয়াটার হিসেবে যা ব্যবহৃত হয়) পাওয়া গেছে এসব ভয়াবহ বিষ। জনগণ খারিজ করছে বহুজাতিক বিষাক্ত সব বিলাসী পানীয় আমেরিকার নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত কয়েক বছর ধরে কোক-পেপসির বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলন শুরু করেন। ক্যাম্পেইন টু স্টপ কিলার কোকের (সিএসকেসি) আন্দোলনের ফলে নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের সদস্য হিরাম মনসেরেটের সহযোগিতায় ২০০৫ সালের ১২ ডিসেম্বর এই বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোক-পেপসি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে দণি ভারতের কর্নাটক রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর অশোক এবং শিক্ষামন্ত্রী বি হোরাত্তি জানান, কোমল পানীয়তে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশক রয়েছে, তাই রাজ্যের সরকারি সংস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোক-পেপসিসহ ১৬টি কোমল পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করা হলো। পাঞ্জাব সরকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ৭৩ বোতল কোক-পেপসি পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নিয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অম্বমনি রামদাস বলেছেন, সিএসইর রিপোর্ট সঠিক হলে কোক-পেপসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু জানিয়েছেন, কেরালায় ঠান্ডা পানীয় খেয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ছত্রিশগড় রাজ্যের সরকারি অনুষ্ঠানে এ জাতীয় পানীয় ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নিয়ে ভারতে কেরালা, কর্নাটক, পাঞ্জাব, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশের স্কুল ও কলেজগুলোতে কোক-পেপসির বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের আইনকানুন মেনে কোকাকোলা, পেপসিকো এবং ক্যাডবেরিকে কাজ করতে বলেছেন কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি।

২০০৬ সালের ৩ আগস্ট সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত লোকসভায় কোক-পেপসি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য সম্পাদক কে নারায়ণ খেলোয়াড় ও অভিনেতাদের এসব পানীয়ের বিজ্ঞাপনে অংশ না নেওয়ার অনুরোধ জানান। কেরালার প্লাচ্চিমাঢ়ার আদিবাসীরা যেমন এসব বহুজাতিক পানীয় সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করে জানবাজি রেখে লড়াইয়ে নেমেছিলেন, তেমনি এই প্রতিরোধ আজ ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দুনিয়ার নানা জায়গায়। বারানসির মেহেন্দীগঞ্জের লোক সমিতি ২০০৬ রাখিপূর্ণিমার দিন কোক-পেপসির বিরুদ্ধে গাছের গায়ে রাখি পরিয়ে এর প্রতিবাদ করেন। তাদের দাবি ছিল কোক কারখানাকে অবশ্যই মেহেন্দীগঞ্জের মাটি ছেড়ে যেতে হবে।

তারপরও কি বলছে কোক-পেপসি জনগণের প্রাণের দাবিকে তোয়াক্কা না করে নির্লজ্জ এই বহুজাতিক কোম্পানি দুটি শুধু তাদের মুনাফাই দেখছে। তাই বলিউডের বাণিজ্যিক ছবির জনপ্রিয় নায়ক শাহরুখ খানকে দিয়ে বলাচ্ছে পেপসি ভালো, আর আমির খানকে দিয়ে বলাচ্ছে কোক ভালো! ২০০৬ সালের ৯ আগস্ট দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় পেপসিকো-ইন্ডিয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে, পেপসি নিরাপদ। কিন্তু পেপসি স্বীকার করেছে, তাদের পানীয়ে কীটনাশক আছে এবং এর মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত। ২০০৬ সালের ১১ আগস্ট একই দৈনিকে কোকাকোলা বিশাল বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে, কোকাকোলা সর্বদা নিরাপদ আর তরতাজা। তারা বলেছে, কোমল পানীয়গুলো সাধারণত তৈরি হয় চিনি, জল, সুগন্ধি এবং মসলা দিয়ে।

কোকাকোলার কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের জন্য বিআইএস স্ট্যান্ডার্ডটি নাকি বিশ্বের কঠোরতম স্ট্যান্ডার্ড অর্থাৎ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্ট্যান্ডার্ডের সমতুল্য। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিলাসী পানীয় ভারতে কোক-পেপসি নিয়ে বিতর্ক ওঠায় এর বিক্রি প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গেছে। ভারতে ২০০৪ সালে সংশোধিত খাদ্য বিনষ্টিকরণ প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী বোতলবন্দি ঠান্ডা পানীয়ে ৮৯-৯২ শতাংশ সোডাজল ব্যবহার করার কথা। ভারতীয় সরকার খাদ্যে ভেজাল রোধ আইনের (১৯৫৪) মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এলাকায় ২০০৬ সালের ১৪ আগস্ট থেকে কোক-পেপসি, মিরিন্ডা, লিমকা, স্প্রাইট, মাউন্টেন ডিউ, ডায়েট পেপসি, ফান্টা, থামসআপ, সেভেনআপ, মিরিন্ডা লেমনসহ ১১টি ব্র্যান্ডের তথাকথিত কোমল/ঠান্ডা/নরম (মূলত বাণিজ্যিক বিলাসী পানীয়) পানীয় প্রায় রাজ্যেই নিষিদ্ধ করেছে। এসব পানীয়ে যেসব বিষ ব্যবহার করা হচ্ছে তা আমাদের শরীরের নানা অসুখসহ পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ভয়াবহ সর্বনাশ করছে।

হঠাৎ মুটিয়ে যাওয়া, হাড় ও দাঁতের ক্ষয়, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, ব্যথা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অপুষ্টিসহ নানা নিত্যনতুন অসুখ। জনগণের মাটির তলার পানি বোতলে ভরে ভরে রং আর চিনি দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে আজ গ্রামের মানুষকে ঢালিউডের নায়ক, কাল বলিউডের নায়িকা, পরশু হলিউডের ভিলেন বানানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এসব কোম্পানির কারখানার জন্য আমাদের কৃষকরা তাদের চাষের জমি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত ও বিক্রীত কোক-পেপসিসহ কর্পোরেট পানীয়গুলোও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া জরুরি। কোক-পেপসি পানের ভেতর দিয়ে আমাদের শরীর ও পরিবেশ কীভাবে বিষাক্ত হচ্ছে, কী হচ্ছে না তা জানার অধিকার জনগণের আছে।

কোক-পেপসি বিষয়ে একটি জাতীয় সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়েই আমরা তা শুরু করতে পারি। যে সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জয়ী, সেই দেশের বীর যোদ্ধাদের সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টও আজ দখল করে রেখেছে এই বহুজাতিক পানীয় কোম্পানিগুলো। আমাদের নিজেদের পানীয় আছে আর আমাদের পানীয় আমাদের অধিকারে থাকার মাধ্যমেই জনগণের সার্বভৌত্ব এর বিষয়টি নিশ্চিত থাকে। আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় পানীয় কি বাঙালিদের নানা জাতের শরবতসহ আমাদের জনপদের নানা প্রান্তে, নানা সমাজে, নানা আয়োজনের পানীয় রীতি চালু আছে। এসব পানীয় কেবলই খাবার উপকরণ নয়, এসবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে স্থানীয় প্রতিবেশ-বৈচিত্র্য আর রকমভিন্ন জীবনযাপনের স্থানীয় মানুষদের বহুপীয় জ্ঞান-অভিজ্ঞতা।

আজ স্থানীয় মানুষের পানীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে বহুজাতিক পানীয় দাপটের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। দেশের কোনো কৃষক-জুমিয়া কেউ বহুজাতিক বিষের ব্যবসা চায় না। এ বিষ কেউ জমিতেও ঢালতে চায় না, এ বিষ কেউ নিজের গলায়ও ঢালতে চায় না। আসুন, আমরা জনগণের প্রাণসম্পদে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে বহুজাতিক পানীয় বিষয়ে জাতীয় সিদ্ধান্ত নিই এবং সংগঠিত হই। আশা করি, দেশব্যাপী খাদ্যে ভেজাল, তিকর খাদ্য, ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার বিষয়ে যে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই এসব কর্পোরেট পানীয় বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারব এবং আমাদের জনগণের ভেতর প্রচলিত পানীয় রীতিকেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগে আরো জোরদার কায়দায় যুক্ত করতে পারব।

# লেখক : গবেষক, জনউদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ # [ গতকাল দৈনিক সমকালের উপ-সম্পাদকীয়তে এই লেখাটি পড়ে তা বর্তমান সময়ের জন্য খুবই যুগোপযোগী বলে মনে হয়েছে। শেয়ার করলাম লেখাটি অন্যদের সঙ্গে। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।