আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি শারীরিক ‘সুখের’ গল্প

ুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুু ‘আমাবস্যা পূর্ণিমায় ইউসুফ এই কাম করে না। আবার বৃষ্টি-বাদলায়ও এই কাম হয় না। শুকনা দেখে কাম করতে হয়। সাতদিন রাখব মাটির নিচের ঘরে। ’ ‘মাটির নিচের ঘরে।

’ ‘হ, আন্ডার গেরাউন্ডের ঘর। কমলাদিঘির উত্তরে সাতপাহাড় জঙ্গল। অই সাতপাহাড় জঙ্গলেই মাটির নিচের ঘর । ইউসুফ থাকে অই ঘরে। আমাবস্যা পূর্ণিমা ছাড়া বাইর হয় না।

দিনে বাইর হওয়া নিষেধ। ’ ‘কার নিষেধ?’ জয়নালের প্রশ্ন শুনে বিড়ি ধরায় মতি। গঞ্জে দাঁড়িয়ে দুইজন কথা বলছে। মতির গ্রামের নাম কমলাদিঘি--জয়নালের গ্রাম থেকে তিন গ্রাম দূরে। বিড়িতে টান দিয়ে মতি জয়নালের প্রশ্নের উত্তর দেয়।

‘ওস্তাদের নিষেদ। ইউসুফের ওস্তাদের নাম মন্তাজ। মন্তাজ মারা গেছে গত বছর। কুষ্ঠ হইছিলো। ইউসুফ কাজ শিখছে মন্তাজের কাছে।

মন্তাজ শিখছে ইনডিয়ার আসামে। মন্ত্র জানলে কাজটা এমন কঠিন কিছু না। মন্তাজ মারা যাওয়ার আগে ইউসুফরে মন্ত্র শিখাই গেছে। ইউসুফরে কুষ্ঠ ধরলে মন্ত্র দিব আমারে। মন্ত্র পাইলে আমারও কুষ্ঠ হইব।

এই লাইনের সবার মৃত্যু হয় কুষ্ঠ রোগে। এতে বিরাট লাভ হয়। কুষ্ঠ রোগীর শরীরে কোন পাপ থাকে না। মরার আগে সব পাপ কাইটা যায়। নিষ্পাপ হইয়া মরে।

’ মতি বিড়িতে আরো কয়েকটা টান দেয়। ‘শোন জয়নাল, তুমি রাজী থাকলে আমারে কও। আমি ইউসুফের সাথে কথা বলি। ইউসুফ আবার সবার কাজ করে না। তবে আমি বললে তোমার কাজ করে দেবে।

টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা কইরো না। যা দিবা একমাসে তার ডাবল তুলবা। ’ ‘ডাবল!’ ‘হ,ডাবল। কেন তুমি তো সুলেমানরে চেন। কী অবস্থা ছিল আর কী করছে।

বাড়ীতে পাকা ঘর করছে। ছোট মেয়েটা স্কুলে যায়। ছেলেটারে দুবাই পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছে। কয়দিন আর লাগলো। তুমিতো নিজের চখেই দেখতাছো।

’ ‘হ, দেখতাছি। ’ ‘তাইলে আর চিন্তা কী। বিসমিল্লা বইলা দিন তারিখ থিক কইরা ফেল। অমাবশ্যা পুর্নিমা বাদে। বেশিদিন লাগব না বুঝছ।

সাতদিনের মামলা। সব মাটির নিচের ঘরে। সাতদিন পরে তুমি পুরা সুস্থ। খালি একটা জিনিস নাই...জিনিস দিয়া কি অইব। জিনিস না থাকলেই লাভ।

’ ফুরিয়ে আসা বিড়িতে সুখটান দেয় মতি। জয়নাল কিছু না বলে চলে যায়। গঞ্জে এসেছিল সে একটা গামছা কিনতে। বাকিতে গামছা না পাওয়ায় গামছা না নিয়েই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। গঞ্জ থেকে তার বাড়ি প্রায় তিন কিলো।

পুরোটাই হাটা পথ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় জয়নালের। তার বউ ভাত নিয়ে বসে আছে। মেম্বারনীর বাড়িতে কাজ করে ভাত নিয়ে এসেছে তার বউ। ছেলেমেয়ে দুটি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মতির সাথে তার পরিচয় অল্পদিনের । মতির গ্রাম কমলাদিঘি। জয়নালের গ্রাম থেকে তিন গ্রাম দূরে। ইদানিং গঞ্জে আসলেই মতির সাথে দেখা হয়। মতি জয়নালের একটা উপকার করতে চায়।

জয়নালকেও সে সুলেমানের মতো বড়লোক বানাতে চায়। ভাত খাওয়ার সময় জয়নাল চুপচাপ ভাবতে থাকে মতির কথা। জয়নালের মাথায় মতির একটা কথাই বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমন কথা বলল মতি। জিনিস দিয়া কি অইব।

জিনিস না থাকলেই তো লাভ। কথাটা কি সত্য বলল মতি। খাওয়া-দাওয়ার পর জয়নাল মতির প্রস্তাবটা নিয়ে আবার ভাবতে থাকে। মতির প্রস্তাবটা কি মেনে নেবে সে। জয়নালের ঘরে চাল চুলো বলতে কিছুই নেই।

জয়নালের বউ মানুষের বাড়ীতে কাজ করে ভাত নিয়ে আসে। সেই ভাত জয়নাল ও তার ছেলেমেয়েরা খায়। জয়নালের আয়-রোজগার কিছুই নাই। প্রচুর টাকা দেনা হয়েছে বিভিন্নজনের কাছে। ভিটে মাটি বন্ধক দেয়া আছে মহাজনের কাছে।

ঋণ শোধ করতে না পারলে ভিটে মাটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে। আপাতত ঋণ শোধ করার কোন উপায় জানা নেই জয়নালের। ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত অন্ধকার। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে না পারলে ওদের অবস্থাও তার মত হবে। জয়নাল চায় না তার ছেলে মেয়েরা তার মত গরীব থাকুক।

কিন্তু ছেলেমেয়েদের ইশকুলে পড়ানতো দুরের কথা ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থাও করতে পারে না সে। জয়নালের গ্রামের সুলেমানের অবস্থাও একসময় জয়নালের মত ছিলো। ঠিক জয়নালের মত ছিল বললে ভুল হবে ওর অবস্থা বরং আরো খারাপ ছিল। ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে সে ভিটে মাটি সব হারিয়ে পথে বসেছিল। পরে বউ ছেলে-মেয়েকে গ্রামের এক গৃহস্থের বাড়ী রেখে সে মতির বুদ্ধিতে ঢাকা চলে যায়।

ঢাকা যাওয়ার পর সুলেমান আর গ্রামে ফিরে নাই। । তবে বাড়ীতে প্রতি মাসে টাকা পাঠায়। প্রচুর টাকা কামাই করে সে এখন। মহাজনের ঋণ শোধ করে ভিটে মাটি সব ফিরে পেয়েছে।

ওর বউ ছেলেমেয়ে খুব সুখে আছে। ঢাকায় সে কি করে তা গ্রামের কেউ জানে না। জয়নালের গ্রামের তিন গ্রাম পরে মতির গ্রাম। মতি জানে সুলেমান ঢাকায় কি করে । মতির কথা শুনলে জয়নালও সুলেমানের মতো প্রচুর টাকা কামাই করতে পারবে।

ছেলেমেয়েদের ভাত কাপড়ের জন্য আর চিন্তা করতে হবে না তাকে। ভিটে-মাটিও রক্ষা পাবে। জয়নালের খুব শখ তার ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করবে। তার খুব খারাপ লাগে বউকে মানুষের বাড়ীতে কাজ করতে দেখে। বউকে সে সুখী করতে পারেনি।

সে চায় তার বউও সুলেমানের বউয়ের মতো সুখী হোক। সুলেমান তার পরিবারের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছে। অবশ্য পরিবারের সুখই তার সুখ। জয়নালও সুখী হবে তার পরিবার সুখী হলে। সুখের বিনিময়ে মতি জয়নালের কাছে একটা জিনিস চায়।

শুধু জিনিস চাইলে দেওয়া যেত কিন্ত মতি টাকাও চায়। টাকা দেওয়ার সামরথয জয়নালের নাই। পরের দিন জয়নাল আবার মতির সাথে গঞ্জে দেখা করে। ‘মতি ভাই, টাকা দেওনের সামর্থ্য আমার নাই’ ‘আমি জানি টাকা দেওনের সামর্থ্য তোমার নাই। কিন্তু টাকা ছাড়া এই কাম হয় না।

অনেক খরচের ব্যাপার আছে। তবে টাকা কোন বিষয় না। তুমি টাকা ধার করো। ঢাকা গিয়া একমাসে শোধ দিবা’ ‘মতি ভাই, আমারে গ্রামের কোন লোক ধার দিব না। ’ ‘অসুবিদা নাই।

তোমার গেরামে টাকা ধার না পাইলে আমার গ্রামে পাইবা। আমি সব ব্যবস্থা কইরা দিমু। ’ ‘কিন্তু শোধ দিমু কেমনে, আমার তো এমনিতেই দেনা অনেক’ ‘দেনা নিয়া চিন্তা কইর না। ডান হাতে কামাই করবা, বাম হাতে দেনা মারবা। সুলেমান পারছে, তুমি পারবা না ক্যান।

সুলেমানের দেনা ছিল তোমার চাইতে অনেক বেশি’ ‘কিন্তু… ঢাকা শহরের কিছুই তো আমি চিনি না । ’ ‘তোমার কিছুই চিনন লাগব না। সর্দার আছে—সর্দারের দলে থাকবা। গলায় সুর থাকলে গান গাইবা। সুর না থাকলে খালি আল্লা আল্লা করবা – মসজিদ- মাজারে ঘুরবা।

যা কামাই করবা দুই ভাগ পাইব সর্দার আর বাকি সবাই এক ভাগ কইরা। অতি সহজ কাজ। ’ কাজটা অতি সহজ হলেও কাজের প্রস্তুতি মোটেই সহজ না। জয়নালের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো বউ ছেলেমেয়েকে ছেড়ে যাওয়াটা। টাকা পয়সার অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি নাই জয়নালের সংসারে।

। বউ ছেলেমেয়েকে সে অত্যন্ত ভালোবাসে। শরীরের মায়া ছাড়তে পারলেও সংসারে মায়া ত্যাগ তার জন্য অত্যন্ত কঠিন। জয়নাল ঘরে ফিরে আবার চিন্তামগ্ন হয়। চিন্তা করে সে কোন কুল খুজে পাচ্ছে না।

গ্রামের সরল লোকদের কাছে যুক্তির চেয়ে আবেগ বড়। আবেগ দিয়ে তারা মাঝে মাঝে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আবার আবেগের কারনে অনেক বড় কাজ তারা করতে পারে না। জয়নাল যুক্তি, আবেগ দুটাই কাজে লাগায়। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে সে পৌছাতে পারে না।

এটা এমন বিষয় যা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করা যাবে না। বউয়ের সাথে তো না-ই। জয়নাল সারারাত ঘুমাতে পারে না। একা একা ভাবতে থাকে। বিবিধ ভাবের উদয় হয় তার মধ্যে।

জয়নাল একবার ভাবে-- সংসারের মায়া বড় ক্ষতিকর মায়া। এ মায়ায় পড়লে জীবনে সুখ নাই। আবার ভাবে—সংসার ছাড়া জীবনে সুখ নাই। সংসারের মায়াই আসল মায়া। ভাবতে ভাবতে জয়নাল ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়।

ঘোরের মধ্যে সে কমলাদিঘির মতির কথা ভাবে, সাতপাহাড় জঙ্গলের ইউসুফের কথা ভাবে, তার গ্রামের সুলেমানের কথাও ভাবে। মতিকে একটা জিনিস দিলেই সে সব দিতে পারে। টাকা-পয়সা, সুখ-শান্তি, দেনার টাকা, শোধের টাকা সবই মতির সন্ধানে আছে। জয়নালকে শুধু দিতে হবে তার একটা শরীরের একটা অঙ্গ। একটা অঙ্গ কেটে ফেললেই সে সুলেমানের মতো ঢাকা শহরে ভিক্ষা করে প্রচুর টাকা কামাতে পারবে।

তার সংসারে সুখ আসবে, দেনার টাকা শোধ হবে, ভিটে মাটি রক্ষা পাবে, ছেলেমেয়েরা মানুষ হবে, বউকে আর কষ্ট করে মানুষের বাড়ী কাজ করতে হবে না। এক ধরনের ঘোরের মধ্যেই জয়নাল সুবহে সাদিকের সময় কমলাদিঘির উদ্দেশ্য ঘর ছাড়ে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.