আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোকাবাবু ষস্ঠবিংশ মূল আন্টোয়াঁ দ্যা সা এক্সউপেরী



কুয়োর পাশে ধংশ হয়ে যাওয়া কোন জনপদের শেষ সাক্ষী হিসাবে এখনো একটা দেয়াল দ্বাড়িয়ে আছে। পরের দিন সন্ধ্যায় খোকার কাছে যাচ্ছি। অনেক দূর থেকেই দেখলাম, খোকা সেই দেয়ালটার উপরে বসে পা দোলাচ্ছে। দূর থেকেই খোকার কথোপকথনের শব্দ কানে আসল। খোকা বলছে: অবশ্যই এটা নির্দিষ্ট দিন, কিন্তু নির্দিষ্ট স্থান নয়।

দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কাউকে দেখতেও পেলাম না। কারও কথাও শুনলাম না। তবুও খোকা আবার বলল: অবশ্যই! বালিতে তুমি আমার পায়ের চিহ্ন দেখতে পাবে। তুমি সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা কর।

আজ রাতে আমি সেখানে আসব। দেয়াল থেকে মাত্র হাত কয়েক দূরে থাকলেও, কিছুই দেখতে পেলাম না। একটু সময় বিরতি নিয়ে খোকা আবার বলল: আশা করি তোমার বিষ খুব ভাল। তুমিতো নিষ্চৎ! তোমার দংশনের পর আমার খুব বেশী সময় তোমার বিষের জ্বালা সহ্য করতে হবে না! বুকটা কেঁপে উঠল। আর এগুতে পারছি না।

কিন্তু কিছু ঠাহরও করতে পারলাম না। খোকা বলল: এখন যাও নীচে নামব। এবার দেয়ালটার গোড়ায় চোখ পরতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খারা হল। খোকার বিরক্তির কারণ একটা সাপ। হলুদ রং-এর এই সাপ গুলি মাত্র তিরিশ সেকেন্ডেই যে কাউকে ইহ জগৎ থেকে পর জগৎ-এ পৌঁছে দেয়।

পিস্তলটা পকেট থেকে বের করতে করতে ছুটলাম। কিন্তু এর মধ্যে সাপটা জলের ধারার মত বালির উপর দিয়ে গড়িয়ে ধংসস্তুপের পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোন রকমে, সময় মত দেয়ালটার কাছে এসে আমার মানিকটা, আমার সাত রাজার ধন খোকা বাবুটাকে কোলে তুলে নিলাম। তার মুখটা বরফের মত সাদা হয়ে গেছে। এসব কি হচ্ছে? তুমি এখন সাপের সঙ্গে গল্প কর? সোনালী মাফলারটা গলা থেকে খুলে খোকার মুখটা দুহাতে ধরলাম।

একটু জল দিলাম। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। গভীর দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দু"হাতে আমার গলা জরিয়ে ধরল খোকা। শ্বরবিদ্ব পাখির হৃদয়ের মত কাঁপছে খোকার বুক। খোকা: ভাল লাগছে, তুমি তোমার যন্ত্রটি মেরামত করতে পেরেছ।

এখন বাড়ি যেতে পারবে। সেটা তুমি কেমন করে জানলে! এই খূশীর খবরটা আমি খোকাকে বলতে যাচ্ছিলাম, যে সব দুর্ভাবনা কাটিয়ে আমি আমার উড়োজাহাজটি মেরামত করতে পেরেছি। আমার কথায় কর্ণপাত না করেই খোকা বলতে লাগল: আমিও আজ বাড়ি ফিরব। তার পর বেদনা ক্লিষ্ট কন্ঠে বলল: কিন্তু সে অনেক অনেক দূরের কঠিন দুর্গম পথ। বুঝলাম।

খোকার নিশ্চয়ই খুব কঠিন কিছু একটা হয়েছে। ছোট শিশুর মত আদর করে বুকে জরিয়ে ধরলাম। কিন্তু খোকা কোন গভীর খাদে নামার জন্য তার শরীরটা আমার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করতে চাইল। কিছুতেই তাকে ধরে রাখতে পারলাম না। তার দৃষ্টি অনেক দূরে।

সে যেন কোন অসীমে হাড়িয়ে যেতে চাইছে। আমি বললাম: এইতো তোমার ভেড়াটা। তার জন্য আমি একটি ছোট ঘর বানিয়েছি। ফুলটাকে যাতে খেয়ে ফেলতে না পারে, তার জন্য ভেড়াটার মুখে একটা ঠুলি এঁকে দিয়েছি। খোকা মৃদু হাসল।

অনেক ক্ষন অপেক্ষা করলাম। কিন্তু খোকার জ্বর বেরেই চলেছে। মানিক তুমি খুব ভয় পেয়েছ? অবশ্যই ও ভয় পেয়েছে। কিন্তু মৃদু হাসিটা মুখে থেকে না সরিয়েই সে বলল: আজ সন্ধ্যায় আমি এর চেয়ে আরো বেশী ভয় পাব। পিঠের উপর দিয়ে একটা হিম শীতল ধারা নেমে গেল, এই ভয়ে যে, যা হবার তা হবেই, কিছুতেই ঠেকানো যাবে না।

এই হাসি দেখতে না পারার যন্ত্রনা, আমি কিছুতেই সইতে পারব না। এই ধূসর বালুকাময় মরুভূমিতে তার হাসীটা ছিল ঝর্ণা ধারার মত। পাজি ছেলে তোমার হাসিটা আমি দেখতে চাই। খোকা বলল: আজ রাতে এক বছর হবে। আমার তারাটা ঠিক সে যায়গাটার উপর আসবে, যেখানে আমি পৃথিবিতে প্রথম পা রাখি।

দুষ্ট ছেলে, এগুলি দুঃস্বপ্নের মত না? সাপের সঙ্গে গল্প এবং আজ সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করার কথা, এবং তোমার তারাটা আজ ঠিক সেখানে থাকবে, যেখানে এক বছর আগে ছিল? কিন্তু আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই সে বলল: গুরুত্বপুর্ণ জিনিস গুলিই কেই দেখতে পায় না। সেটা ঠিক বটে। আমি তার সাথে এক মত। খোকা আরো বলল: ব্যাপারটা অনেকটা ফুলের মত। যদি তুমি কোন ফুলকে ভালবাস, আর সে কোন একটা তারার বাসিন্দা হয়, তখন আকাশেল দিকে তাকাতে খুব ভাল লাগে।

সব গুলি তারাই তখন ফুলের মত মনে হয়। আমার সমর্থন পেয়ে খোকা বলে চললো: ধর জল। তুমি আমাকে যে জলটুকু পান করতে দিয়েছ, সেটি সংগীতের মূর্ছনার মত। কপিকল, দড়ি, বালতি... এদের মিলিত সংগীত, খুব ভাল লেগেছে। মনে পড়ে? অবশ্যই! আমি বললাম।

তুমি রাতে আকাশের তারা গুলি দেখবে। আমার বাড়ি, মানে আমি যে তারার অধিবাসী, সেটি এত ছোট, যে তোমাকে দেখাতে পারছিনা। সেই ভাল, এদের যে কোন টাকেই তুমি আমার তারা বলে ভাবতে পারবে আর সব কটাকেই ভালবাসতে পারবে। সব গুলি তারাই তোমার বন্ধু হবে। এবং তখন তোমাকে আমি একটা উপহার দেব।

বলতে বলতে খোকা মিটি মিটি হাসল। আমি বললাম: দুষ্টের শিরমনি লংকার রাজা! তোমার হাসিটা আমার খুব ভাল লাগে। সেই হাসিটাই হবে তোমার জন্য আমার উপহার। সেটা হবে এই কুয়োর জলের মত। তুমি কি বলতে চাও? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

খোকা বলল: তারা সবাই দেখতে পায়। কিন্তু সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখে। নাবিকদের জন্য তারা হচ্ছে পথ প্রর্দশক। কারো কাছে তারা ছোট ছোট আলোর কনা মাত্র। বৈজ্ঞানিকদের জন্য তারা হল সমস্যা।

আমার পরিচিত সেই ব্যাবসায়ী লোকটার জন্য তারা ছিল সোনা। কিন্তু এই সব গুলি তারা নীরব। তুমি তারা গুলি এমন ভাবে দেখবে যেভাবে আর কেউ দেখতে পাবে না। কি বলতে চাও তুমি? আমার ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। খোকা বলল: রাতের আকাশে চোখ মেলে তাকালে তুমি দেখবে সব গুলি তারা হাসছে।

কারণ এদের কোন একটায় থেকে আমি হাসব। শুধু তোমার তারারাই হাসতে পারবে। হেসেই খোকা বলে যেতে লাগল: তুমি নিজেকে যখন শান্ত করতে পারবে (সবাই নিজেকে শান্তনা দেয়), তখন আমার মত একজন বন্ধু পেয়েছিলে বলে খূশীই হবে। তুমি সব সময়ই আমার বন্ধু থাকবে। আমার সাথে তোমার হাসতে ইচ্ছে করবে।

হয়ত কোন এক রাতে তুমি জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকাবে, আর তোমার বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখবে, তুমি হাসছ! তুমি বলবে: হ্যাঁ, তারারা আমাকে সব সময় হাসি উপহার দেয়। তারা ভাববে তুমি একটা পাগল! আমি তোমার মনে একটা সুরের ঝংকার তুলব। খোকা এখনো হাসছে। তোমার মনে হবে আমি তোমাকে তারা নয়, এমন এক গুচ্ছ সুর দিয়েছি, যেগুলি হাসতে জানে। হাসিটা এখনো তার মুখ থেকে মিলিয়ে যায়নি।

কিন্তু একটু গম্ভীর হয়ে বলল: এই রাত্রিটা আর কখনো ফিরে আসবে না, তা জান? তোমাকে আমি ছেড়ে যাব না। বললাম আমি। মনে হবে, যেন আমি অসুস্থ, খুব বেশী নয়, এই এতটুকু, মনে হবে যেন মরে যাচ্ছি। এতটুকুই। এরকমই।

সেটা দেখতে এসোনা। এর জন্য কষ্ট... আমি তোমাকে ছেড়ে কোথ্থাও যাব না। বললাম দৃঢ় কন্ঠে। কিন্তু খোকা খুব চিন্তিত ভাবে বলল: আমি তোমাকে আসতে বারণ করছি সাপটার কারণে। আমি চাইনা সে তোমাকেও কামড়ায়।

সাপ গুলি খুব পাজী। নিজের মনের আণন্দের জন্যও কামড়াতে পারে। আমি আবার বললাম: তোমাকে আমি কিছুতেই ছেড়ে যাব না। কিন্তু আমার কথা না শুনে ঊদবিগ্ন হয়ে কি যেন ভেবে বলল: তাই তো! দ্বিতীয় ছোবলেল জন্য তো তাদের বিষ থাকে না! টেরও পেলাম না রাতের বেলায় কি ভাবে নিরবে নিঃশব্দে সে চলে গেল। টের পেয়ে, পিছন পিছন ছুটে যখন খোকার কাছা কাছি এলাম তখন খোকা দ্রুত অথচ দৃঢ় পদ ক্ষেপে এগুচ্ছে।

আমার পায়ের শব্দ পেয়ে বলল: ওহ, তুমি। বলেই আমার হাত ধরল। কিন্তু তাকে খুব ব্যাথিত মনে হল। সে বলল: আমার পিছু নেওয়া তোমার ঠিক হয়নি। তুমি অযথা কষ্ট পাবে।

তোমার মনে হতে পারে, যে আমি মরে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। খোকা বলল: বুঝতেইতো পারছ! সেটা অনেক দূরের যাত্রা। সে যাত্রায় এই মাটির দেহ সঙ্গে জায় না।

সে যাত্রার পক্ষে এই মাটির দেহ অনেক ভারী। আমি থ হয়ে গেলাম। খোকা বলে যেতে লাগল: এই মাটির দেহ এখানেই পরিত্যাক্ত খোলসের মত পরে থাকবে। এমন শূন্য খাঁচার জন্য শোক করে লাভ কি? আমি অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছি। একটু ভীত হয়েছে খোকা, নিযেকে সামলে নিয়ে বলল: জান! খুব ভাল হবে।

আমি তারা গুলি দেখব। সব গুলি তারাই কুয়োর মত মনে হবে। সবাই আমাকে তৃষ্ণায় জল দেবে। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ব্যাপারটা খুব মজার হবে।

তুমি পঞ্চাশ কোটি সুর পাবে যারা হাসতে যানে, আমি পঞ্চাশ কোটি কুয়ো পাব যাদের জলে রাগিনীর মূর্ছনা ঝংকৃত হয়। এবার খোকাও কিছু বলতে পারল না। কারণ; সে কাঁদছে। এই সে জায়গা। এ কয়েক পা আমাকে একাই যেতে দাও।

এই বলে ভয়ে খোকা বসে পরে বলল: জানতো! আমার ফুলটি! তার সব দায় দায়ীত্ব আমার। সে খুবই দুর্বল এবং কিছুটা ছেলে মানুষী আছে তার। এই সমস্যা সংকুল জীবনে বেঁচে থাকার জন্য তার মাত্র চারটা কাঁটা আছে, যে গুলি আসলে কোন কাজেরই না। দ্বারিয়ে থাকতে না পেরে বসে পরলাম। খোকা বলল: এইতো... এখানেই সব কিছুর... একটু সময় নিল কিন্তু তার পর ঊঠে পড়ল।

এক পা এগোল। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পায়ের গোড়ালিতে একটা হলদে ঝলক মাত্র। আর কিছুই না। কিছু ক্ষন নিথর হয়ে রইল।

একটুও কাঁদল না। পাতার মত ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল। বালিতে এতটুকু শব্দও হল না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।