আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘হিন্দি’ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা?!

সূর্যস্নানে চল.... অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি করে ফেললাম। আমার পিচকুটা নিশ্চয় আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আসে। আমার পিচকুটার নাম রিহান, আমার একমাত্র ছেলে। মাত্র ৪ বছর বয়স। প্রত্যেকদিন রাতের বেলা আমাকে ছাড়া সে খায় না।

বাসায় ঢুকতেই দৌড়ে আমার কাছে এল। “বাবা… আমি সেই কতক্ষন ধরে তোমার জন্য ওয়েট করছি তুমি আসছই না। তুম ইতনা লেট কিউ হো??” “বাবার অফিসে অনেক কাজ ছিল যে তাই দেরি হয়ে গিয়েছে। চল আমরা খেতে বসি। ” খেতে গিয়েই বেধে গেল বিপত্তি।

তাকে খাওয়ার সময় ডোরেমন কার্টুন দেখতে দিতে হবে নয়ত সে খাবে না। বিপত্তিটা শুধু আজকের না বেশ কিছুদিন থেকেই। সারাদিন সে কার্টুন দেখে দেখে ইতমধ্যে চোখে সমস্যা বাধিয়ে ফেলেছে। ডাক্তার সতর্কও করে দিয়েছে। কিন্তু কি আর করা যাবে, ডোরেমন কার্টুন দেখতে না দিলে তাকে খাওয়ানো যায় না।

বাধ্য হয়েই টিভির সামনে তাকে নিয়ে বসতে হয়। সেদিন অফিসের এক কলিগের বাসায় দাওয়াত ছিল। রিহান আর তার মা কে নিয়ে গিয়েছিলাম। অফিসের অন্যান্য কলিগরাও তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে গিয়ে রিহান কিছু খেলার সাথী পেয়ে গেল।

আমরা নানা রকম গল্পের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম রিহান ও অন্যান্য বাচ্চারা খেলছে এবং নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলছে! আমি বেশ অবাকই হলাম। রিহান কার্টুন দেখে দেখে কিছু হিন্দি শিখেছে জানি কিন্তু সে যে এভাবে কথা বলতে পারে তা ভাবি নি। আর অন্যরাও যেভাবে কথা বলছে তাতে বোঝাই গেল অন্যদেরও একই অবস্থা। সকলেই পাকা হিন্দি বলতে পারে।

ব্যাপারটি আমাকে বেশ চিন্তিত করে ফেলল। রিহানকে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্লেতে ভর্তি করিয়েছি। ইংরেজিটা ভালই শিখছে। আর বাসায় ডোরেমন কার্টুন দেখে দেখে হিন্দি শিখছে। অবস্থা এমন দাড়িছে যে ইংরেজি আর হিন্দির চাপে বাংলাটাই ঠিকমত শিখতে পারছে না সে।

বাংলায় যেভাবে দক্ষ হয়ে ওঠা উচিত সেভাবে হচ্ছে না। সেদিনকার ঘটনা চিন্তা করে বুঝলাম এমনটা খালি রিহানের ক্ষেত্রেই হচ্ছে এমনটি নয় এর ব্যাপকতা আরো বেশী। বিষয়টি আমাকে বড্ড বিচলিত করে ফেলেছিল তাই এর পিছে কারন খোজা শুরু করলাম। সাধারন দৃষ্টিতে যা যা পেলাম সেগুলো এরকম: ১. আমাদের শিশুদের জন্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ, খেলাধুলা, আনন্দ প্রকাশের পরিবেশ দিতে পারছি না, তাই শিশুরা ঘরে আটকে থাকছে। একধরনের জেলখানার পরিবেশ যেন; ঘরের ভেতরই তাদের জগৎ, তাদের বিচরণ।

খেলার মাঠ, বন্ধুবান্ধবের বিকল্প টিভি গেম, কার্টুন। ২. আমরা বাংলা ভাষায় বিনোদনমুলক অনুষ্ঠান বানাতে পারছি না, আর করলেও খুব সীমিত। ৩. হিন্দি ভাষাটি বাংলার খুব কাছাকাছি হওয়ায় তারা সহজে সেটা বুঝতে পারছে এবং শুনতে শুনতে ভাষাটি রপ্ত করে ফেলছে। ৪. বাচ্চারা যে ব্যাপক আকারে হিন্দি শিখছে এব্যাপারে আমাদের বিশেষ কোন মাথা ব্যাথা নেই। ৫. ডোরেমন কার্টুনটি এমনভাবে তৈরী যা বাচ্চাদের জন্য সহজবোধ্য এবং নানা রকম কল্পকাহিনী দ্বারা তৈরী যা বাচ্চাদের জন্য আকর্ষনীয়।

অফিসের কাজেই গিয়েছি রাজশাহীতে। উঠলাম এক আত্বীয়ের বাসায়। সে আত্বীয়ের ছেলেটি আমাকে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকল। যেহেতু কয়েকদিন ধরেই আমি ‘ডোরেমন’ বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত সেহেতু আমি ছেলেটিকে একটু পরীক্ষা করার সুযোগটি হারালাম না। অল্প কিছু কথা বলেই সে আমার সাথে ফ্রি হয়ে গেল।

সে জানালো তার নাম সুমন, ক্লাস ফোর এ পড়ে। ডোরেমন কার্টুন তার খুবি প্রিয়। ডোরেমনের জিয়ান চরিত্রটি তার সবচেয়ে বেশী প্রিয় কারন জিয়ান অনেক শক্তিশালী, ওর উপর দিয়ে কেউ কথা বলতে পারে না। ও সবাইকে পিটাতে পারে। যেদিন চলে আসব সেদিন দেখছি সুমন আর তার বন্ধুরা বাসার সামনের ছোট মাঠটিতে খেলছে।

হঠাৎ আমার কানে একটি কথা আসল। “হেই সুমন, তুম কিউ বল নেহি পাকাড়রেহে হো? ধেয়ানসে খেলো!” তারই বন্ধু তাকে উদ্দেশ্য করে বলল। তার বন্ধুটিও ফোর ফাইভে পড়ে এমন বয়সী হবে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমি যতটুকু ভেবেছিলাম ব্যাপারটি তার থেকেও অনেক বেশী গুরুতর ও ভয়ানক।

এবং আমি যে কারনগুলো ভেবেছিলাম তার প্রথমটিও এখানে ব্যার্থ। এখানে বাচ্চারা খেলাধুলার সুযোগ ও পরিবেশ পাওয়া সত্ত্বেও ডোরেমন আসক্তিতে রয়েছে। ঢাকায় ফিরেই ইন্টারনেটে ‘ডোরেমন’ সম্পর্কে কি কি লেখা আছে খোজ করলাম। দেখলাম বিভিন্ন ব্লগ এবং সংবাদপত্রে সচেতনতা মুলক অনেক লেখাই রয়েছে। ডোরেমন কার্টুনটির ক্ষতিকারক দিক গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

কিন্তু হাটে ঘাটে মাঠে বাজারে ঘরে এই লেখাগুলোর কোন প্রভাবই পড়েনি। এবং আমার এ লেখাটিরও কোন প্রভাব থাকবে বলে আশা করি না। তবে যারা লিখেছেন তাদের প্রচেষ্টা স্পষ্ট, তাদের প্রচেষ্টায় কোন কমতি নেই। তবে ডোরেমন সম্পর্কে যে ধারনা পেলাম তা মোটামুটি এরকম: কার্টুনটির মূল চরিত্র নোবিতা, যে একজন অলস ছেলে আর তার অলসতার কারণে তাকে প্রতিদিন নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। ডোরেমন নামের এক এলিয়েন তার সাথে থাকে এবং তাকে নানা গেজেট(সুপার পাওয়ারফুল বস্তু বা ক্ষমতা) দিয়ে সাহায্য করে।

এর সাথে সেমি ভিলেন সেমি বন্ধু হিসাবে থাকে জিয়ান এবং নবিতা-জিয়ানের পার্শচরিত্র হিসাবে থাকে একটি মেয়ে সিজুকা ও একটি ছেলে সোনিও-এই হলো মোটামুটি এর সেটিংস। আপাতদৃষ্টিতে এর ভেতর খারাপ কিছু নেই। তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে এর ভেতর এমন অনেক শিক্ষা রয়ে গেছে যা থেকে সহজেই বাচ্চারা ভুল জিনিস কিংবা ভুল বার্তা পেতে পারে। যেমন, স্কুলের পড়া বা হোমওয়ার্কের প্রতি নবিতার বিষোদগার, মায়ের আদেশ না শোনা বা না মানার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, পরীক্ষায় খারাপ করে খাতা লুকিয়ে ফেলা, বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে অবাস্তব সুপার পাওয়ারের প্রতি আসক্ত হয়ে ঘোরের ভেতর থাকা ইত্যাদি। উদ্বেগজনক শিক্ষার এই ঘটনাগুলো যদি সামান্য সময়ের জন্য এরা পেতো তাহলে তা অতটা প্রভাব ফেলতে পারতো না।

কিন্তু এই কার্টুন মোটামুটি দিনব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় শিশুরা টেলিভিশনের ‘পোকা দর্শক’-এ রূপান্তরিত হচ্ছে। যখন এগুলো প্রতিদিন তাদের মাথায় ঢুকবে তখন তা সবার অজান্তেই তাদের মন মগজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। আর এরকম কার্টুনের প্রভাব যতটা সহজে একটি শিশুর উপর পড়ে, বাবা-মা, শিক্ষক ও অন্য গুরুজনদের উপদেশ ততোটা সহজে প্রভাব ফেলতে পারে না। ‘ডোরেমন’ কার্টুনটিতে যে শুধুমাত্র খারপই আছে আমি তা বলছি না। বিষয়টি হল আমাদের একটা স্বভাব- মানুষের খারাপটা নেয়া।

আর তাই ডোরেমন দেখে বাচ্চারা ডোরেমনের উপদেশের চেয়ে নোবিতা বা অন্যদের খারাপটাই নিচ্ছে বেশি। হিন্দি ভাষার এ বিনোদন তাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিচ্ছে। মায়ের ভাষা বাংলা ভাল করে শেখার আগেই শিশুরা হিন্দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ কার্টুনটির সঙ্গে আমার কোন দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু এ কার্টুনের ফলে বাচ্চারা মাতৃভাষা না শিখে অন্য আরেকটি ভাষায় প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

এতে আমাদের বাচ্চাদের মাতৃভাষা শেখার দিকটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে আমি মনে করি। শিশুরা হলো নরম কাদার মতো, তারা অনুকরনপ্রীয়। ছোটবেলাতে তাদের যেভাবে গড়ে তোলা হবে, বড় হলে তার ছাপই তাদের জীবনে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। কার্টুনের বিভিন্ন চরিত্রের পোশাক-আশাক, প্রকাশভঙ্গি ইত্যাদি অনুকরণ করছে শিশুরা। অনেকে বাসায় হিন্দিতে কথা বলে, খাওয়া দাওয়া অঙ্গভঙ্গিতে বিচিত্র আচরণ করে।

বলা যায়, সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ডোরেমন ক্রেজ’। আর শিশুদের জন্য এটা এক ধরনের আসক্তি। আমাদের বাবা-মায়েরা যথেষ্ট মোরাল দিয়ে আমাদের গড়ে তুলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের আদর ও শাসন দুটোই ছিল যথার্থ। আমরা যারা আজ ছোট বাচ্চাদের বাবা-মা’র আসনে বসে আছি এখন এসেছে তাদের পালা।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই বিপর্যয়কর যুগে যেখানে আমাদের হওয়া উচিৎ ছিলো এসব ব্যাপার নিয়ে আরো অনেক বেশী সচেতন, তখন আমরা সন্তানদের টিভির সামনে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের যতটুকু ভয় পেয়েছি বা সম্মান করেছি আজ আমাদের সন্তানদের থেকে ততটা কেন পাচ্ছি না তার হিসাব মেলানোর সময় এসে গেছে। আমরা যদি এখনো উদাসীন থাকি তাহলে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের জন্য শুধুমাত্র বৃদ্ধাশ্রমের নিষ্ঠুর দরজাই হয়তো খোলা থাকবে। আমাদের বাংলা ভাষার একটি রক্তাক্ত ইতিহাস রয়েছে। প্রানের বিনিময়ে এ ভাষাকে জাগ্রত ও সমুন্নত রেখেছি।

আর এ নতুন প্রজন্মকে যদি আমরা আমাদের ভাষার মর্যাদা-মহত্ব-স্বকিয়তার চেতনায় গড়ে তুলতে না পারি তবে তা হবে আমাদের জন্য বিশাল এক ব্যার্থতা। এ ‘ডোরেমন প্রজন্ম’(!) হিন্দি ভাষাকে আপন করে নিয়ে অন্তরে লালন করে এক ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে বড় হয়ে উঠবে। স্বাভাবিকভাবেই তারা বাংলা ভাষার প্রতি মমত্বহীন হবে। ইতিহাসে দেখেছি, “স্পেনের উপনিবেশের কারণে পুরো লাতিন আমেরিকায় স্থানীয় ভাষার বিলোপ ঘটেছে। লাতিন আমেরিকানরা এখন স্প্যানিশ ভাষাকেই নিজেদের ভাষা মনে করে।

” এখন যারা ৫-৬ বছর বয়সী তারাই একদিন পরিনত বয়সে পৌছবে। কে জানে তখন তারা হিন্দিকেই নিজের ভাষা মনে করবে না? কে জানে তারা হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুলবে না? কে জানে তারা আবার হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেওয়ার জন্য আন্দোলনে নামবে না??? বিশেষ দ্রষ্টব্য: ১। এ লেখাটির প্রধান উদ্দেশ্য সচেতনতা বৃদ্ধি। নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই কাম্য। চাইলে লেখাটি শেয়ার করতে পারেন।

২। লেখাটিতে প্রথমে যে ঘটনার বর্ননা করা হয়েছে তা কাল্পনিক। তবে খোজ নিলে দেখবেন বাস্তবতা এর থেকে কিছুমাত্র কম নয়। ৩। লেখাটি তৈরীতে বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং ব্লগের সাহায্য নেয়া হয়েছে।

কিছু কিছু কথা হুবহু কপি-পেস্ট করেছি। ‘ডোরেমন’ সম্পর্কে আরো জানতে নিচের লিংকগুলো দেখুন। এখানে ক্লিক করুন এখানে ক্লিক করুন এখানে ক্লিক করুন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.