আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনাগত অন্ধকার

১. অফিসের কাজগুলো গুছিয়ে দুপুরে ইন্টারনেটে ক্লিক করতেই বিরক্ত লাগলো। হোমপেজ এরর। আবারো গেছে নাকি? দুদিন পরপর এ এক হ্যাপা। কখনো ফাইবার কেটে যায়, কখনো আইএসপির ইউপিএস জ্বলে গেছে, কখনো সার্ভার ডাউন। আইটিতে ফোন করলাম।

আইটির ছেলেটা এসে দেখে বললো, আপনার হোমপেজ সমস্যা। হোমপেজে ফেসবুক ছিল। ফেসবুক নাকি কোথাও খুলছে না। ওটা বদলে হোমপেজ গুগল করে দিল। এবার খুলছে।

আমি তেমন রেগুলার ফেসবুকার নই। তাই পাত্তা দিলাম না ব্যাপারটাকে।
পরদিন পত্রিকায় দেখলাম, সরকার ফেসবুক ব্যান করেছে বাংলাদেশে। ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দিয়ে লেখালেখি হচ্ছিল ফেসবুক স্ট্যাটাসে। এবার নড়ে চড়ে বসলাম।

ঘটনা তাহলে এই? এতক্ষণে মনে পড়লো ফেসবুক না থাকায় আমি দশ দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয় বন্ধু পরিবারের কাছ থেকে আংশিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এখন একটু খালি খালি লাগতে শুরু করেছে।
২. ফেসবুক না থাকাতে স্কাইপে চালু করলাম অনেকদিন পর। রাতে বাসায় ফিরে স্কাইপেতে কথাবার্তা আড্ডাবাজি করি প্রবাসী বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনের সাথে। তেমন অসুবিধে হলো না।

রাতে ঘুমোবার আগে, ঘন্টাখানেক লেখালেখি করি ব্লগে। সেও এক আড্ডাবাজিই বলা চলে। গত কয় বছরে নেশা হয়ে গেছে। ফেসবুকের চেয়ে এখানেই যেন আমার স্বস্তি বেশী। পরিবারের বেরসিক লোকজন বলে এটা নাকি আমার ব্লগাটাইটিস রোগ।

সপ্তাহখানেক পর একদিন দেখলাম, ব্লগটা খুলছে না। আরেকটা ব্লগে ক্লিক করলাম, সেও খোলে না। যতগুলো ব্লগ আছে তালিকায় সবগুলোই এরর দেখালো। ঘটনা কি? তালিকার বাইরের দুটো ব্লগের ঠিকানা জানা ছিল সেখানে ক্লিক করে দেখলাম খুলছে। ওই ব্লগে কখনো যাই না কেবল ফুল পাখি ইহকাল পরকাল রান্নাবান্না ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে।

দেশ পরিস্থিতি কিছু নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ওই ব্লগগুলো খোলা, বাকীগুলো বন্ধ, ব্যাপার কি।
জানা গেল সরকার কমিউনিটি ব্লগের একটা কালো তালিকা করে ব্যান করেছে সাইটগুলো। আমি খুব আহত হলাম। ভার্চুয়াল জগতে আমার চিন্তাভাবনাগুলো প্রকাশের একটা আশ্রয় হয়ে উঠেছিল ব্লগ।

আজ থেকে সেই খোলা জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল?
৩. স্কাইপে আর জিমেইল চ্যাটে আমার সবচেয়ে ভালো সময় কাটে রুবিনাকে নিয়ে। ওর সাথে এত বিষয়ে কথা বলা যায়, এত বৈচিত্র থাকে আড্ডায়, যেটা আর কারো সাথে হয় না। কবিতা গান সিনেমা রাজনীতি দর্শন শিল্পকলা রাস্তার যানজট, পরিবেশ দুষণ, আকাশ বাতাস ফুল পাখি চাঁদ মহাকাশ নীহারিকা, দুনিয়ার হেন জিনিস নেই আমরা কথা বলি না। অনেক বিষয়ে মিল পাওয়াতেই হয়তো রুবিনার সাথে জমে উঠলো আমার। দুজনে ভিন্ন দেশে থাকলেও প্রতিদিনের যোগাযোগের কল্যানে মনে হয় এই তো পাশের বাড়ির মেয়ে।

রুবিনা আমার প্রিয় বন্ধু। কিন্তু তার বাইরেও কিছু কি গড়ে উঠেছে যা এখনো কেউ প্রকাশ করিনি?
থাক সেকথা। বরং রুবিনা আমাকে নতুন একটা জগত চিনিয়েছে সেটার কথা বলি। সংক্ষেপে বলতে গেলে রুবিনা আমার সিনেমাগুরু। দুনিয়ার হেন সিনেমা নেই সে দেখেনি।

ওই জায়গায় আমি অকাট মুর্খ। স্টার মুভিজ আর এইচবিওর দুচারটে ইংরেজী ছবি, আর কখানা উপমহাদেশীয় হিন্দি বাংলা ছবি বাদে আমার দেখা ছবির তালিকা বিশটাও হবে না। রুবিনার সাথে পরিচয় হবার পর সে আমাকে ইউটিউবে সিনেমা খুঁজতে শেখালো। আমাকে একেকদিন একেক লিংক দেয় আর আমি খুঁজে পাই হলিউড বলিউডের বাইরে বিশাল একটা জগত। এশিয়া ইউরোপ ল্যাটিন আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার অঘোর জঙ্গলে তৈরী ছবিও আমি পেয়ে যাই ইউটিউব খনিতে।

অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল সপ্তাহে অন্ততঃ চারটা মুভি দেখা। বিষুদবার রাতে দুটো, শুক্রবার দিনে দুটো।
গত বিষুদবারে ইউটিউব খুলতে গেলে আটকে যাই। একটা মেসেজ আসে, দিস সাই্ট ইজ আনএভেলবল ইন বাংলাদেশ। ইউটিউবও ব্যান? আমার সিনেমা দেখা বন্ধ হয়ে গেল।

রুবিনাকে বলে দিলাম আর যেন লিংক না পাঠায়।
৪. ব্লগ, ফেসবুক, ইউটিউব বন্ধ হবার পর একমাত্র খোলা জানালা জিমেইল আর স্কাইপে। সেখানে আছে বেশ কজন বন্ধুবান্ধব। আছে সবচেয়ে প্রিয় রুবিনা। মা সেদিন রুবিনার কথা জিজ্ঞেস করলো।

জিজ্ঞেস করা ভঙ্গিতে কিছু একটা অনুমান করলাম। কিছুদিন ধরেই মিনমিন করছিল বয়স ত্রিশ পার হয়ে যাচ্ছে আর আমি এখনো কোন ভবিষ্যত চিন্তাভাবনা করছি না। তিনি না থাকলে আমাকে দেখবে কে। একমাত্র সন্তান হলে যা হয়।
আমি মাকে আগেই বলেছিলাম আমার একজন বন্ধু আছে লণ্ডনে পড়ছে।

কোন ইঙ্গিত দেইনি। তবু মা কি ভেবেছেন কে জানে। তবে রুবিনাকে মার অনুসন্ধানের কথা বলাতে সে হেসে ফেললো, বললো - চাচীকে বলে দিও আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এখানকার এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। তাহলে কিছু সন্দেহ করবে না।
রুবিনার কথাটা শুনে আমার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলেও আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম।

কথাটা সত্যি কিংবা হেঁয়ালী সেটা যাচাই করতে গেলাম না।
সেদিন রুবিনা স্কাইপেতে বলছিল, তোমাকে একটা পিডিএফ ফাইল পাঠিয়েছি জিমেইলে চেক করে দেখো তো। ওটায় কিছু ডেটা আছে আমাকে ওয়ার্ডে কনভার্ট করে দিতে হবে।
আমি জিমেইল খুলতে গিয়ে সেই মেসেজটা পেলাম, দিস সাই্ট ইজ আনএভেলবল ইন বাংলাদেশ। জানলাম গুগলের সকল সার্ভিসই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে।

এমনকি তার পরদিন থেকে স্কাইপে ইয়াহু সহ সকল কমিউনিকেশন টুলস ব্যান। আমার দৈনিক রুবিনাপর্ব ওখানেই খতম বলা যায়।
৫. আরো তিন মাস পর।
দেশে এখন ইন্টারনেট নেই। ইমেইল নেই।

সীমিত মোবাইল সার্ভিস আছে যাতে শুধু কথা আর টেক্সট চলে। সবাইকে বলা হইছে কম্পিউটারে শুধু টাইপ করা চলবে। কোন রকম তসবির(ছবি) রাখা চলবে না। তসবির দেখা গেলে কম্পিউটারের মালিককে তিন বছরের জেল দেয়া হবে। ভিডিও দেখা গেলে যাবজ্জীবন।


মুছে ফেলা হলো কোটি কোটি ডিজিটাল ছবি ভিডিও। টিভি স্টেশানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। ছবি তোলার স্টুডিওগুলো বন্ধ হয়ে গেল। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী বন্ধ। অফিস আদালত কোথাও নারী নেই।

মিডিয়ার মধ্যে শুধু চালু থাকলো রেডিও। আর রেডিওতে শুধু তেলাওয়াত আর সংবাদ। সংবাদে আখেরী মন্ত্রনালয়ের বাণী প্রচার করা হয়। তথ্য মন্ত্রনালয়ের নাম বদলে আখেরী মন্ত্রনালয় বানানো হয়েছে। যারা মানুষকে শুধু আখেরাত সম্পর্কে বয়ান করবে।

দোজখের ভয়ভীতি প্রচার করবে। আমার রেডিও নাই। সেদিন সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় নীচতলার খোলা দরজা দিয়ে রেডিওর খবর ভেসে আসছিল, ওখানে কে একজন বলছিল, "বিগত সরকার দেশকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে নিয়ে গিয়েছিল, শুধু একটা কাজের জন্যই তাদের ধন্যবাদ দেয়া যায়, সেটা হলো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার সংশোধনী.........." আমি সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলায় উঠে গেলাম, বাকীটা শোনা হলো না।
বাসায় ফিরে খাওয়া সেরে রাতে শোবার আগে ভেন্টিলেটর থেকে একটা চটের বস্তা নামালাম, ওখানে কিছু পুরোনো বইপত্র, পত্রিকা। তার ভেতর একটা চানাচুরের ঠোঙ্গার মধ্যে সিমবিহীন এণ্ডরয়েড মোবাইল ফোন লুকোনো।

দেশে ছবি দেখা যায় এমন সব মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আমি সাহস করে এটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। দরোজা ভালোমতে আটকে ফোনটা খুলে চার্জে দিলাম খাটের নীচে। রুবিনার কয়েকটা ছবি আছে এটায়, আজ ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। কতদিন কথা হয়না।

দেশে এখন নারী পুরুষের মধ্যে ফোনে কথা বলাও নিষিদ্ধ। কয়েক বছর আগে দেখা আফগানিস্থানের ছবি ওসামার কথা মনে পড়লো। ওটা দেখে হেসেছিলাম। এখন নিজেকে দেখে হাসছি।
আয়নার দিকে তাকিয়ে আমার সত্যি হাসি পায় নিজেকে দেখে।

পুরুষের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুশকিল হলো আমার দাড়ি দিতে কিপটেমো করেছে প্রকৃতি। আমার কেবল থুতনিতে একগোছা দাড়ি আছে । ওগুলো লম্বা হবার পর নিজেকে ছাগলের মতোই লাগছে দেখতে। রুবিনা আমাকে দেখলে সত্যি সত্যি ছাগু বলেই ডাকতো হয়তো।


সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.