আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাহুক --ফররুখ আহমদ :: ৮৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে

...

আজ কবি ফররুখ আহমদের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী । সেই উপলক্ষে এই পোস্টটি । ডাহুক রাত্রিভর ডাহুকের ডাক... এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির । দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি । ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক, ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি, কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক ।

তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে ক্রমাগত ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে, অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে স্বপ্নের প্রবাল । অবিশ্রাম ঝরে ঝরে পড়ে শিশির পাখার ঘুম, গুলে-বকৌলির নীল আকাশ মহল হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম, নিভে যায় কামনা-চেরাগ; অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক । কোন ডুবুরির অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখির সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে, ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে । তুমি কি এখনো জেগে আছ? তুমি কি শুনছ পেতে কান? তুমি কি শুনছ সেই নভঃগামী শব্দের উজান? ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী! চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী, মন্থর হাওয়ায় । সাথী তন্দ্রাতুর ।

রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া পড়ে যায় ডাহুকের সুর । শুধু সুর ভাসে বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষয়ে আসে রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্নাচ্ছন্ন সাঁতোয়া আকাশে । মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর! তবু জানি তুমি সুর নও, তুমি শুধু সুরযন্ত্র! তুমি শুধু বও আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর অপরূপ সুর... অফুরান সুরা... ম্লান হয়ে আসে নীল জোছনা বিধুরা ডাহুকের ডাকে । হে পাখি! হে সুরাপাত্র! আজো আমি চিনিনি তোমাকে । হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা, বিচিত্র তুলিতে আঁকা বর্ণ সুকুমার ।

কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনার যার ব্যথা-তিক্ত রসে জমে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ সেই সুর পারি না চিনিতে । মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী পাত্র ভরা সাকী । উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি বনপ্রান্তে নিভৃত একাকী । হে অচেনা শারাবের ‘জাম!’ যে সুরার পিপাসায় উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম সূর্যের অজানা দেশে তারার ইশারা নিয়ে চলিয়াছ একমনে ভেসে সুগভীর সুরের পাখাতে, স্তব্ধ রাতে বেতস প্রান্তর ঘিরে তিমির সমুদ্র ছিঁড়ে চাঁদের দুয়ারে যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চল উত্তাল পাথারে, প্রান্তরে তারার ঝড়ে সেই সুরে ঝরে পড়ে বিবর্ণ পালক, নিমিষে রাঙায়ে যায় তোমার নিস্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক, তীর-তীব্র গতি নিয়ে ছুটে যায় পাশ দিয়ে উল্কার ইশারা, মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রর নীল ঝড় তুলে যায় সাড়া উদ্দাম চঞ্চল; তবু অচপল গভীর সিন্ধুর সুদুর্গম মূল হতে তোলা তুমি রাত্রিভরা সুর । ডাহুকের ডাক... সকল বেদনা যেন, সব অভিযোগ যেন হয়ে আসে নীরব নির্বাক ।

রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখি! যাও ডাকি ডাকি অবাধ মুক্তির মতো । ভারানত আমরা শিকলে, শুনিয়া তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে তুনমন করি যে আহত । এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও, তুমি বও তোমার শৃঙ্খল-মুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবনমৃত্যুর পরিপূর্ণ সুর । তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক, পূর্ণ করি বুক রিক্ত করি বুক অমন ডাকিতে পারো । আমরা পারি না ।

বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা, ক্রমে তাও থেমে যায়; প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায় গাঢ়তর হল অন্ধকার । মুখোমুখি বসে আছি সব বেদনার ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে । রাত্রি ঝরে পড়ে পাতার শিশিরে... জীবনের তীরে তীরে... মরণের তীরে তীরে... বেদনা নির্বাক । সে নিবিড় আচ্ছন্ন তিমিরে বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কন্ঠ ঘিরে দূর বনে ওঠে শুধু তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক । ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।