আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূরে কোথাও, দূরে দূরে

"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি"

১. বাংলাদেশের মানুষ ঘুরতে জানে না, তার উপর নারীরা তো নানা বাঁধায় কোথাও যাবারই সুযোগ পায় না। এ ট্যাবু, প্রতিরোধ নিজের চলমান জীবনে প্রতিদিন ভেঙ্গেছি, খুব সহায়তা এ ব্যাপারে পরিবার থেকে পেয়েছি বলা যাবে না। কিন্তু প্রকৃতি আমাকে পাগলের মতো টানে। আমার আনন্দ শোক যে কোনকিছু নির্দ্বিধায় যার সাথে ভাগ করতে পারি সে সবুজ গাছ, গহন সমুদ্র।

পাহাড় সেভাবে মাতায় না যেভাবে মাতায় সমুদ্র। বন বলতে যা দেখা ঝটিকা সফরে সে আমাদের ন্যাশনাল পার্ক, রাজেন্দ্রপুর, মধুপুর, ভাওয়ালের উদ্যান কাছাকছির মধ্যে। ভূগোল জ্ঞান তেমন ভালো না। আমার ইচ্ছে করছে না গুগলে সার্চ দিয়ে পুঙক্ষানুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা লিখতে। ৯৬ তে এইচএসসির যেনতেন রেজাল্টের কারণে বন্ধুমহলে আমার মূল্য গিয়ে তলানিতে ঠেকে।

আমার বান্ধবীরা যারা অনেক ভালো জায়গায় ভর্তি হয়েছে তারা আমাকে মোটামুটি আমার উড়াধুড়া চলাচলের জন্যে এড়ানো শুরু করে। প্রকৃতি কখনো শূন্যস্থান রাখে না। এ দলে না হলে আমি ও দলে, এ বন্ধুতে না হলে সে বন্ধুতে আমার দিনগুলো কাটতে থাকে। মীরপুর নামক উপশহরের সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে আমি তখন পরিচিত নাম। এখন ভাবতে গেলে অবাক লাগে কত শত মানুষের সাথে বিভিন্ন সময় আমার পরিচয় হয়েছে।

যেখানে গিয়েছি পরিচিত মানুষ বরে হয়েছে আজও হয়। যা বলছিলাম, ৯৮ এর ফেব্রূয়ারীর প্রথম সপ্তাহে বান্ধবী তুমাসহ মিশুকে করে যাচ্ছি নিউমার্কেট। ভ্যালেন্টাইনস ডে সমাসন্ন, বন্ধু বান্ধবদের জন্যে উপহার কিনব দুজনই। মানিক মিয়া এভিনিউ পার হবার আগে কেমন করে যেন মিশুক উল্টে গেল। তুমা এসে পড়লো আমার পায়ের উপর।

আমার পায়ের ছালনুন সব উঠে সারা। সাথে সাথে যে পায়ের উপর পড়েছে সে পায়ের পাতাও ফুলে গেল। তুমা আর মিশুকের ড্রাইভার কোন ব্যখা পায়নি। তুমা আমাকে একটা রিকশা করে বন্ধু সনির বাসায় নিয়ে এলো কাজীপাড়া। সনির বাবা ডাক্তার।

উনি পা টিপেটুপে দেখে ওষুধ দিয়ে দিলেন। আম্মু বাসায় আসতেই সমন জারী করলো-লোচন, তুই পা ভালো না হওয়া পর্যন্ত বাসার বাইরে যাবি না। একদিন যায় দুদিন যায়, গৃহবন্দী থাকা কি চাট্টিখানি কথা। বন্ধুরা ফোনে হা হুতাশ করে আমাকে ছাড়া কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে হচ্ছে ওদের আড্ডা সেসব বলে। এর মধ্যে কিভাবে কিভাবে যেন কমে একটা মাইক্রো ভাড়া পাওয়া গেল।

শুরু হলো মুহূর্মুহূ ফোন সবার। দোস্ত চল না, এত কমে গাড়ী পাওয়া গেছে। এই সেই। চল আমরা একটা পিকনিক করি। একসময় আমি সম্মতি দিয়ে ফেলি।

আমি আঠারো দিনপর বাসা থেকে বের হলাম। ১৮ ফেব্রয়ারী রিপন, শামীম, সোহাগ, মনোজ,জিমি, মনির,কাজলা,মাবরুকা এবং অবশ্যই আমি মাইক্রোতে চেপে বসি। কথা ছিল মীরপুর ১০ নম্বরের মুসলিম বিরিয়ানি থেকে খাবার নেবার। কিন্তু অত সকালে (সকাল ৯টা) খাবার তেরী হয়নি। মুসলিমের মামা বললেন, গতকাল কেন বলিনি, বললাম মামা, হঠাৎই প্রোগ্রাম।

ভেবেছি এলেই পাব। মনোজ বললো, ঐখানে আশপাশে খাবার পাওয়া যাবে। আমরা রাজেন্দ্রপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। কোন ছোটবেলায় আব্বুর অফিস থেকে শফিপুর পিকনিকে গিয়েছিলাম। আমার ঝাপসা ভাবে রাস্তা মনে পড়ছে।

মনোজ ঐখানকার এলাকার পোলা, সে বেশ এ চিনে সে চিনে করে মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে ডিরেকশন দিচ্ছে। কাছাকাছি গিয়ে বুঝা গেল বুকিং না থাকলে যে গেটে পৌঁছেছি সে গেট দিয়ে ঢুকতে দিবে না। আমরা ঘুরতে ঘুরতে আরেক গেটে গেলাম। অবশেষে চেষ্টা সফল হলো আমরা ঢুকলাম জাতীয় উদ্যানে। হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে শীতের সকালে ধূলোমাখা গাছগুলোর রোদ তাপানো দেখতে দেখতে আমরা কেন যেন ন্যাড়া একটা মাঠে বসে পড়লাম।

এমন পরিবেশে মনে হয় কথা বলতে ভালো লাগে না। তখনো কাটা ধানের গোড়ায় শিশির জমে আছে। আমরা স্যান্ডেল জুতো খুলে এক জায়গায় রেখে দিলাম। জিমি মাথার নীচে সোয়েটার ভাঁজ করে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। আমাদের ভেতর তখন বই বের হয়েছে এমন কবি সাইফুর রহমান জিমি।

সুতরাং ওকে ওভাবে শোয়া মানায় এ ব্যাপারে আমাদের কোন দ্বিমত থাকলো না। রিপন পৃথিবীর সব অলসদের প্রতিযোগীতা হলে প্রথম দিকের একটা স্থান পাবে- এমন তার দক্ষতা। রিপনকে শামীম বললো চল দোস্ত আমরা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি। এমন একটা লুক রিপন শামীকে দিল যে শামীম হাতে ধরা সিগারেট আরেকটু হলে উল্টাই জ্বালাতো। আমি, মাবরুকা, কাজলা, মনোজ, মনির খেলতে নেমে গেলাম।

এতদিন পর দৌড়-আমাদের দম বের হয়ে যাবার যোগাড়। মনোজ আমাদের বললো মানুষ সব শীতের সময় আসে রাজেন্দ্রপুরে, কিন্তু গাছের আসল রূপ খোলতাই হয় বর্ষায়। আমরা যতটুকু হাঁটা যায় ততোটুকু হেঁটে গাছপালা দেখতে লাগলাম। বারোটা সাড়ে বারোট নাগাদ সবার পেটে টান পড়লো। এরমধ্যে মনোজের এক বন্ধু মনোজের বাইক নিয়ে এসেছে, আমার সেই বন্ধুর নাম মনে নেই।

মনোজ এবং তার বন্ধু আমাদের জন্যে খাবার কিনতে চলে গেল। রোদ ও বেশ আমরা মাঠ থেকে সরে গেলাম গাছের ছায়ায়। অনেকক্ষণ পর তেহারি আর ভাত নিয়ে মনোজ এলো। কিছু খাবার খাওয়া গেল, কিছু না, কয়েকটা খাবার গন্ধ হয়ে গেছে। ভাগাভাগি করে খাবার খেয়ে আমরা ফিরতি রাস্তা ধরলাম।

২. বন্ধুদের একটা গ্রুপ শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তো। ওদের সাথে আমার পরিচয় বান্ধবী কাজলার মারফত। নোমান, মৃদুল ছোটবেলার বন্ধু। ওদের সাথে মনি। আবার নোমানদের ছেলেবেলার বন্ধু আরিফ, রানা।

ইউনিভার্সিটি লাইফের অনেকটাই পাবলিক লাইব্রেরীতে আড্ডায় কেটেছে ওদের সাথে। মৃদুলদের ডিপার্টমেন্ট থেকে পিকনিকে যাওয়া হবে। আমি, আরিফ, রানা আমরা বহিরাগত হলেও আমাদেরকে মৃদুলদের ক্লাসমেটরা তো চিনতোই এমন কী টীচাররাও খুব ভালো চিনতো। রানার উপর দায়িত্ত পড়লো বাস ভাড়া করার। নবীদা (পরবর্তীতে গায়ক পথিক নবী) আমাদের আমন্ত্রিত শিল্পী।

দুটা বাসে করে চানখাঁরপুল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো ৯৮ সালের ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। আমার বাসায় কিছুই জানে না। আমি নোমানদের সাথে বাসের ছাদে বসলাম গীটার সহ। বাতাসে আমার অনেক লম্বা চুল উড়ছে, জট পাকাচ্ছে, আমার অত্যধিক ফিনফিনে শরীর এ বুঝি ছাদ থেকে পড়ে যায়, আমার পাঞ্জাবী পত পত করছে। পাশ দিয়ে যে বাস ট্রাকই যাচ্ছে আমাকে দেখছে।

বাস এক জায়গায় সামান্য থামতে নবীদা বাসের জানলা দিয়ে মুখ বের করে দিলো আমি কে জানতে, নিজেই বললো এটা কি লোচনের ভূত? এক গা ধূলা, মাথা ভর্তি জট নিয়ে আমরা সবাই নামলাম রাজেন্দ্রপুর গিয়ে। মেয়েরা কয়েকজন মিলে আমার চুলের জট ছাড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকলো। নবীদা এক সময় গান ধরলো, খালি গলায়। কারণ বাসের ছাদ থেকে পড়ে গীটার ফেটে গেছে। কিঞ্চিৎ ধুনটুন খেয়ে অনেকেরেই ক্ষুধায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

ছোট ছোট রিকশা ভ্যানটাইপ এতে করে বনের ভেতর দিয়ে মানুষ চলাচল করতে দেখলাম ১০মাস পরে এসে। কতজন কত দিকে হেঁটে চলে গেছে প্রাইভেসীর খোজেঁ। কারণ ডিপার্টমেন্টে বেশ কয়েকটা কাপল আছে। আমরা তাস পেটাতে থাকলাম। খেয়ে দেয়ে রওনা দিতে সেই ৪টা বেজে গেল।

বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরেনো রাত। সত্য মিথ্যা বলে কোনরকমে বাসা থেকে উদ্ধার তবু ঝাড় সেদিন কম খাইনি। ৩. জীবনে উন্নতি সাফল্য এগুলোর কিছু গৎবাঁধা ছক আছে । এর বাইরে গেলে মানুষ অন্যকে সফল ভাবে না। অনেকে করুণার চোখে থাকে।

অনেকসময় পরিবারের সদস্যদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা মূল্য কমে যায়। বয়সের সাথে সাথে বুঝেছি অর্থের জোর একটা বড় জোর মানুষের। ৯৮ তে ঢাকা ইউনিভার্সিটির দর্শনে ভর্তি হলাম। বরাবরের সায়েন্সের ছাত্রী অতি অল্পদিনেই টের পেলাম এই ভয়াবহ মুখস্ত করা আমার জন্যে কি দুষ্কর। পরবর্তীতে যদিও আমি এ বিদ্যা রপ্ত করব এবং উতরে যাব।

৯৭ এর ডিসেম্বর আর জানুয়ারী মিলিয়ে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলে কম্পিউটার স্টাডিজের ডিপ্লোমার ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। তারপর ঢাবিতে আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দর্শনশাস্ত্র পেলাম। ঢাবিতে ক্লাশ শুরু হতে হতে আমার বিকম পরীক্ষা দেয়া সারা। দর্শনে দ্বিতীয় বর্ষে উটতে উঠতে আমি বিআইবিএম এ ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সেটা ২০০০ সাল।

বিআইবিএম থেকে আমার জীবনের মোড় ঘোরা শুরু। বন্ধুরা আমাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করলো। এখানে আমি অত্যন্ত ভালো দুজন বান্ধবী পেলাম-শাবান এবং তানিয়া। জীবনের এক পর্যায়ে আমি বিআইবিএম এর সহপাঠীকে বিয়ে করব। যাই হোক বিআইবিএম এর কম্পিউটার টিচার ছিলেন আলম স্যার।

উনি ২০০১ এর বর্ষ শুরুর পিকনিক তথা ফিফথ ব্যাচ এবং চলমান ফোর্থ ব্যাচকে নিয়ে যাবার সার্বিক তত্ত্বাবধান পেলেন। পিকনিক পার্টি যাবে মধুপুর। সেবার শীতও পড়েছে। সকালবেলা সোয়েটার ফোয়েটার পরে আমরা আমাদের ক্যাম্পাসের হোস্টেলের সামনে চলে এলাম। বাসের একদম পেছনের সীটে বসলাম আমি শাবানা আপু তানিয়া এবং আমাদের আরেক সহপাঠী সোমা।

বাস ঢাকা ছাড়ালো। ১১টা বেজে গেল ঢাকা ছাড়তেই। আমি ভাবলাম আর অল্পক্ষণেই মধুপুর ঢুকে যাব। আমাদের সাথে বিআইবিএমের বাবুর্চিরা তাদের রন্ধন সামগ্রী নিয়ে। গিয়ে রান্না হবে।

ওরে বাবা গো, আলম স্যার আমাদের সবগুলা বাস নিয়ে শুধু চক্বর আর চক্বর , উনি কোনদিক দিয়ে ঢুকতে হবে ভুলে গেছেন। আমরা দুপুর দেড়টায় বাস থেকে নামলাম। আমরা যে কজন ঘনিষ্ঠ তার মধ্যে দীপু আর সাগরের স্বাস্থ্য একটু ভালো, শাবানা আপুরও তেমন। এরা কয়জন ক্ষুধায় বেশি কাতর। কেউ এক পাও হাঁটতে রাজি না।

আমি ওদেরকে আমার ব্যাগে থাকা আপেল সাধলাম খাবার জন্যে। ওরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। ওরা আপেল খুবই অপছন্দ করে তবু শাবানা আপু এবং তানিয়াকে বিআইবিএমে পড়ার দুবছর নিষ্ঠার সাথে আপেল খাইয়ে গেছি। যা ওরা আজও ভোলে না। সাড়ে তিনটার সময় আমরা খাবার পেলাম।

এখনো প্লেট হাতে আমাদের সেই ছবি আমার কাছে আছে। শীতকালে গাছপালা ঘেরা জায়গা সবই ঊষর, মধুপুর কি তার ব্যতিক্রম হবে! একজন আরেকজনকে ছেলেরা ওয়ার্নিং দিচ্ছে সিগারেট এর অবশেষ কেউ যেন জঙ্গলে না ফেলে কারণ পাতা টাতা সব শুকিয়ে মচমচ করছে। খেয়ে, একটু লটারি ফটারি করে আমরা তাড়াতাড়ি বাসে চড়ে বসলাম। মধুপুর, রাজেন্দ্রপুর, ন্যাশনাল পার্ক বলি বা শফিপুর আনসার ক্যাম্প আমার কাছ থেকে বিদায় ২০০১ সালে। আমি আবার এ এলাকায় যাব ২০১২ সালে জমি কেনা যায় কিনা এ উদ্দেশ্যে।

গিয়ে যে অবস্থা দেখব তাতে দেশের উন্নতির চাকা কোথায় পৌঁছেছে ভেবে যারপরনাই পুলকিত হব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.