সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ!
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একজন অদ্ভুত মানুষ। উনাকে যত পড়ছি। তত মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। নারীদের জন্য তিনি বাস্তব জীবনে কিছুই করেন নি। সারাজীবন ড্রিংক করেছেন, ধার করেছেন, বৌ বাচ্চাকে কষ্ট দিয়েছেন কিন্তু উনি যা করেছেন নারীদের জন্য তা আর কোন লেখক করেন নি।
কি অদ্ভুত লাগছে?
ঠিক একই সময় অর্থাৎ আঠারো শতকে বিদ্যাসাগর নারী দের জন্য এখানে সেখানে গাল খাচ্ছেন। বিধবা বিবাহ দেবার চেষ্টা করছেন। বাল্য বিবাহ রোধ করার চেষ্টা করছেন, বহু বিবাহ রোধ করতে প্রানপনে মানুষকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। বিধবা বিবাহ দিতে গাঁটের পয়সা খরচ করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মধুসূদন তার লেখনীর মধ্যে দিয়েই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন।
নারীদের সামনে এনেছেন একজন আধুনিক অধিকার সচেতন মানুষ হিসেবে।
আমি যখন মধুসূদন কে নিয়ে লিখব ভাবছি,ঠিক তখনি ঠিক করেছি আমি আমার মত করে আনন্দ নিয়ে লিখব। উনি একজন আপাদমস্তক আধুনিক মানুষ। সমাজ বিদ্রোহী। শুধুমাত্র নিজেকে আধুনিক করে তুলতে তিনি বোতলের পর বোতল শেষ করেছেন।
বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। অষ্ট বর্ষীয়া এক জমিদার কন্যার সাথে। শুধু মাত্র বিদ্রোহ করতেই তিনি বেঁকে বসলেন। এত ছোট মেয়ে বিয়ে করার কোন অর্থ হয়না। তখন তিনি বাইরন ,কীটস,শেলী, শেকসপীয়র, পড়ে ফেলেছেন।
নারী যে শুধু ঘরের পুতুল না নারীকে যে মনের মানুষ করতে হয় তখন তিনি অনুধাবন করছেন। মূলত এই বিবাহ রোধ করতেই তিনি মাইকেল হয়ে বসলেন। তবে অন্যদিকে বড় কবি হবার ও গুপ্ত বাসনা ছিল।
মজার ব্যাপার কি জানেন উনি মাত্র একুশ বছর বয়সে বলেছিলেন আই মাস্ট বি এ রাইটার। সেই সময়ের কথা ভাবলে আপনাকে বলতেই হবে এত অল্প বয়সে একথা তার অহংকারী সত্ত্বাকেই প্রমান করে।
কিন্তু এখন ভাবলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে তিনি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সেই অল্প বয়সেই ছিলেন ভীষণ রকম আত্মবিশ্বাসী।
আমি ভাবছিলাম মধুসূদনের লেখনীর যে ধারা তা কেন স্টপ হয়ে গেল। এর পরে আর কোন লেখক তা কন্টিনিউ করতে পারেনি। এর একটা মাত্র কারন মধুসূদনের মত প্রতিভা শতাব্দিতে একটাও আসে কিনা সন্দেহ! হ্যা এটাই সত্য। উনি যে ফর্মে হাত দিয়েছেন সেখানেই সাফল্য ।
সেই ফর্ম তার হাতে সার্থক রূপ লাভ করেছে। তিনি বাংলার ম্রিয়মান কাব্যভাষা ব্যাবহার করতে চাননি। পাশ্চাত্য লেখনী তাকে অনুপ্রানীত করেছে আধুনিক চেতনায়। বড় কবি হবার তৃষ্ণায় পয়ারের করি , ত্রিপদীর কবি হতে চাননি তিনি।
নজরুল কে আমরা যে অর্থে বিদ্রোহী কবি বলি সে অর্থে মধুসূদন নন কিন্তু তিনিই প্রথম প্রচলিত ছন্দ বা বৈশিষ্ট্যের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহ করলেন।
মজার ব্যাপার মধুসূদনের প্রায় সকল লেখায় নারী চরিত্র প্রধান। বীরাঙ্গনা কাব্য পুরোটায় নারী প্রধান। পাশ্চাত্য কবি ওভিদের The Heroides or Epistle of the Heroins কাব্যের অনুসরনে একুশ টি পত্র কাব্য লিখতে চেয়েছিলেন মধুসূদন। কিন্তু পারেন নি। এবং শেষ পর্যন্ত এগারোটি পত্র কাব্যের সমন্বয় এই বীরাঙ্গনা কাব্য।
পুরানের বিভিন্ন নারী চরিত্র এই পত্রগুলি লিখেছে। শকুন্তলা, তারা,রুক্সিণী, কৈকেয়ী, সূর্পনখা,ভানুমতি,দ্রৌপদী,দুঃশলা,জাহ্নবী,উর্বশী,জনা এই এগারোজন নারী পত্রগুলি লেখেন স্বামী অথবা প্রেমিকের উদ্দ্যেশ্যে।
দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকানাথের প্রতি রুক্সিণী, দশরথের প্রতি কৈকেয়ী, লক্ষণের প্রতি সূর্পণখা, দূর্যোধনের প্রতি ভানুমতি, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা,শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী,পুনরবার প্রতি উর্বশী,নীলধ্বজের প্রতি জনা।
প্রতিটি নারী চরিত্রই আধুনিক হয়ে উঠেছে মধুসূদনের হাতে। পুরানে যেভাবে দেখানো হয়েছে ঘটনা অথবা চরিত্র অনেক জায়গাতেই তিনি তাতে বিদ্রোহী ছিলেন।
আমি জানিনা পুরো লেখাটা কন্টিনিউ করতে পারব কিনা কিন্তু আমার ইচ্ছে পুরানে চরিত্রটি কেমন আর মধুসূদন তাতে কি করে আধুনিকতা আরোপ করলেন তা দেখানোর। এবং সে সময়ের তুলনায় মধুসূদনের এই নারী চরিত্র কি করে একজন অত্যাধুনিক মনো আচরন সম্পন্ন হলেন তা সত্যিই বিস্ময়ের। এসব নারী উনিশ শতকের নব জাগরনের বৈশিষ্ট্য ধারন করেছে। এ কাব্যের নায়িকারা আভিধানিক অর্থে যুদ্ধ করেন নি কিন্তু যদি গূঢ় অর্থ দেখা যায় তাতে স্বীকার করতেই হয় তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন বীরাঙ্গনা। শ্বাশ্বত বাঙালী নারী চরিত্র বা সামাজিক গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলেই তারা বীরাঙ্গনা।
মধুসূদন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করলেন তাদের। প্রতিটি পত্র বিষয়ে পড়ার পর ই এই ধারনা যে কত সত্য তা বুঝতে পারবেন পাঠক।
প্রথম পত্র:
দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা:
শকুন্তলাকে আমরা সবাই চিনি। ইন্টার মিডিয়েটে এই বিষয়ক বিদ্যাসাগরের লেখাটি পাঠ করার সুবাদেআর যারা জানেন না তাদের বলি শকুন্তলা বিশ্বামিত্র মুনির কন্যা। মেনকা নামক এক অপ্সরীর গর্ভে তার জন্ম।
অপ্সরীদের জন্ম বিষয়েও মজার কাহিনী আছে। পরে কোন এক সময় শোনাব।
যাই হোক শিশু অবস্থায় পরিত্যাক্ত হয়ে শকুনের পাখার তলে আশ্রিতা ছিলো এবং পরে তাই তার নাম শকুন্তলা হয়। কণ্বমুনির কাছে বড় হন। রাজা দুষ্মন্ত শিকারে আসে এবং মনিবরের অনুপস্থিতিতে রাজার অতিথি সৎকার করে শকুন্তলা।
তার রূপে মুগ্ধ হয়ে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করে কিছুদিন পর চলে যায় রাজা। আমি খুব সংক্ষেপে বলছি।
এরপর রাজা ভুলে যায় শকুন্তলাকে।
আচ্ছা এখানে কেন ভুলে যায় তা নিয়ে বলার লোভ সামলাতে পারছিনা।
শকুন্তলা একদিন বসে বসে রাজার কথা ভাবছিলেন।
এমন সময়
দূর্বাশা মুনি এসে পানি চাইলেন। শকুন্তলা শুনতে পেলেন না। এতটাই গভীর হয়ে তিনি দুষ্মন্তের কথা ভাবছিলেন। অন্যদিকে মুনি ভাবলেন তাকে অবহেলা করছে শকুন্তলা। অভিশাপ দিলেন যার কথা ভেবে শকুন্তলা আনমনা সে যেন শকুন্তলাকে ভুলে যায়।
বেচারা দুষ্মন্ত বা শকুন্তলা কেউ ই জানেনা এই অভিশাপের কথা।
তৎকালীন সত্য যুগের একজন নারী সে বিরহ যাপন করবে ,সে স্বামী যা ইচ্ছা আচরন করবে কিন্তু তার কিছু বলার থাকবেনা। সে মুখ বুজে মেনে নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় নারীর চির আনুগত্যের প্রতিক নয় বরং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতিক হিসেবে শকুন্তলা স্বামীর প্রতি অভিযোগ দিলেন। অভিমান করে বললেন,
''কিন্তু বৃথা ডাকি কান্ত।
কি লোভে ধাইবে
আর মধুলোভী অলি এ মুখ নিরখি,-
শুখাইলে ফুল,কবে কে আদরে তারে?''
লোভী ভ্রমর যেমন মধু খাবার পর ফুল শুকালে আর ফিরে দেখেনা তেমনি দুষ্মন্ত আজ শকুন্তলাকে ভুলেছে! ভেবে দেখুন আপনার প্রেমিকা ঠিক এভাবেই আপনাকে অভিযোগ দেয়।
দ্বিতীয় পত্র:
সোমের প্রতি তারা:
সোম অর্থ চাঁদ। বৃহস্পতির স্ত্রী তারা। সোম শিক্ষা গ্রহনের জন্য দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে গেছেন। গুরুপত্নী তারাদেবী তার অসামান্য সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়লেন।
শিক্ষা শেষ করে গুরুদক্ষিনা দিয়ে সোম ফিরে আসতে চাইলেন যখন তখন তারা আর নিজেকে সম্বরন করতে পারলেন না। সতীত্বধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে সোমদেবকে পত্র লিখে বসলেন।
নবজাগরনের জোয়ার আধুনিক সময়ের বৈশিষ্ট্য। ভালবাসার কাছে সব তুচ্ছ হয়ে যায়। তারা একটি দুঃসাহসিক নাম যৌক্তিক বিচারে।
পুরানে বলছে তারা সোমের দ্বারা ধর্ষিতা বা অপহৃত হয়েছিল।
কিন্তু মধুসূদর দুঃসাহসের পরিচয় দিলেন লেখায়। কাহিনী আর চরিত্র নিলেন পুরান থেকে কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্য বদলে গেল তাঁর হাতে। সোমের প্রতি তারাই আকৃষ্ট হয়েছিলো বলে লিখে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন। একজন গুরুপত্নী মায়ের মত।
এবং তারা যখন চিঠি লিখছেন তিনি এ ব্যাপারে বিব্রত। কিন্তু সোমের প্রতি তার যে উন্মাদীয় প্রেম তা কিছুতেই তিনি অস্বীকার করতে পারছেন না। প্রেম বাঁধন বয়স পাত্র মিত্র মানেনা। শ্বাশ্বস সমাজ বিরুদ্ধ ভাবনা কাজ করেছে মধুসূদনের মনে।
''গুরুপত্নী বলি যবে প্রনামিতে পদে,
সুধানিধি,মুদি আঁখি,ভাবিতাম মনে,
মানিনী যুবতী আমি,তুমি প্রানপতি,
মান-ভঙ্গ আশে নত দাসীর চরণে!
আশীর্বাদ ছলে মনে নমিতাম আমি!''
সোম যখন শ্রদ্ধায় নত হয়ে গুরুপত্নীকে আশীর্বাদ নেবার জন্য প্রনাম করছে তারা তখন ভাবছে যেভাবে একজন অভিমানী স্ত্রীর মান ভাঙানোর জন্য প্রেমিক চরনে নত হয় তেমনি সোম তার অভিমান ভাঙাতে নত হয়েছে।
আচ্ছা পাঠক এবার বলুন আপনারা কিভাবে মানিনী যুবতীর মান ভাঙান?
পোষ্ট বড় হয়ে যাচ্ছে। আগামী পোষ্টে অন্য চিঠি গুলো নিয়ে বলবো। সবাইকে ধন্যবাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।