আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়াহিদুল হক

ফালতুপ্যাচাল

প্রিয় মানুষের প্রতি শেষ ভালবাসা ঢাকা, জানুয়ারি 28 (নফহবংি24.পড়স)-- ঢাকার সাত মসজিদ রোডে এমনিতেই সকালবেলাটায় প্রচুর ভিড় থাকে। কর্মস্থল আর স্কুল-- কলেজে যাওয়ার চরম ব্যস্ততায় সরগরম চারপাশ। এতোসবের মাঝেও শংকর বাসস্ট্যান্ডের কাছে নবনির্মিত ছায়ানট ভবনের ভিড়টা ছিল চোখে পড়ার মতো। একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল ভিড়টাতে। এখানে উপস্থিত সবার মুখ থমথমে, চোখ ভেজা।

কেউ ফুঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে, কেউবা ডুকরে কাঁদছেন। যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন বিদগ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ, সেই সঙ্গীত দিয়েই তার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি তর্পণ করে চলেছেন ছায়ানটের শিল্পীরা। উপস্থিত অনেকেই তাদের সুরে সুর মেলাচ্ছেন, 'আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে...এ জীবন পূণ্য করো ... দহন দানে। ' সবাই এখানে জড়ো হয়েছেন তাদের প্রিয় এক শিল্পীকে, এক সংগঠককে সর্বোপরি মহান বাঙালীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি ওয়াহিদুুল হক।

তার স্বপ্নের ছায়ানট ভবন প্রাঙ্গণে ফুলে ফুলে শোভিত হয়ে তিনি শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। কথা ছিল সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ওয়াহিদুল হককে ছায়ানট ভবনে রাখা হবে। সময়ের আগেই নামে মানুষের ঢল। ছেলে--বুড়ো সবার হাতেই ফুল। চুপচাপ সবাই আসছেন, ফুল দিচ্ছেন আর নীরবে চোখের জল ফেলছেন।

কেউ কেউ নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন। সে কান্না ঢুকে যাচ্ছে সবার ভেতর। ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। এভাবেই সারাদিন জুড়ে বাংলার পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনই কেঁদেছে তার এই চলে যাওয়ায়।

লাল সবুজের চাদরে ঢাকা কফিনটা যেন ভেসে আছে ফুলের সাগরে। সারা জীবন যার রক্তে খেলা করেছে সংস্কৃতিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ধ্যান--ধারণা, তিনি আজ কফিনের মাঝে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি নিয়ে শুয়ে আছেন চুপচাপ। একজন বৃদ্ধা সেই সকাল থেকে কফিনের এক কোণা ধরে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছেন। তাকে কোনো অবস্থাতেই সরানো যাচ্ছে না। একটু পর পর চোখ মুছছেন আর ফুঁ দিচ্ছেন কফিনে।

ছয়তলা ভবনের ভেতরের দিকের সবতলা জুড়েই রেলিং ধরে দাঁড়ানো সব থমথমে মুখ। সবার দৃষ্টি নীচের দিকে। অন্তরে হয়তো বাজছে রবীন্দ্র সঙ্গীতেরই সুর "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে। " দোতলায় চলছিল রবীন্দ্র সংগীত। যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সে সঙ্গীতের হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছিল ভবনের সর্বত্র।

ছায়ানটের শিল্পীরা একে একে গাইছিলেন, "দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে...যে কোনো ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করে ধরিব হে..." "দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে..", "অন্তর মম বিকশিত কর ....", "আছে দুঃখ, আছে মৃতু্য..", "কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো..." ইত্যাদি। মিলনায়তনে শোকবই খোলা হয়েছে ছয়টি। শ্রদ্ধা জানাতে আসা সবাই লাইন ধরে লিখছেন তাদের শোকগাঁথা। ওয়াহিদুল হক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ 'নালন্দা' পড়ুয়া একটি ছোট্ট মেয়েও কলম ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু লিখবে বলে। কাঁদতে কাঁদতে সে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।

এক হাতে বাবার শার্ট ধরে রেখেই লিখতে শুরু করলো। কিন্তু প্রিয় দাদুকে বিদায় জানাতে সে পারলো না, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মিলনায়তনের বাইরের বারান্দায় মনের আনন্দে একাই নাচছিল ছোট্ট মেয়ে রাইসা। পাশের বেঞ্চে বসে কাঁদছেন রাইসার আম্মু। আম্মুর কান্না দেখে রাইসা এগিয়ে গেলো সেদিকে।

"আম্মু তুমি এতো কাঁদছো কেন?" বলে রাইসাও শুরু করলো কান্না। সাড়ে এগারোটায় ওয়াহিদুল হককে নেওয়ার কথা শহীদ মিনারে। পৌণে এগারোটার দিকে এলেন সন্জিদা খাতুন। অশ্রুসজল কন্ঠে দাঁড়ালেন কফিনের সামনে। সবার সঙ্গে গলা মেলালেন, "আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে....।

" সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে শুরু করে নানান শ্রেণীর লোকজন একে একে তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানান। সব শেষে সম্মিলিত জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শেষবারের মতো তিনি বিদায় নিলেন ছায়ানট ভবন থেকে। এখানে তার পায়ের চিহ্ন আর পরবে না, কিন্তু তাকে মনে রাখবেন সবাই। শহীদ মিনারে শোকের মিনার শহীদ মিনার এমনিতেই শোকের জায়গা। 11টা 40 মিনিটে ওয়াহিদুল হককে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি সেখানে পেঁৗছামাত্রই বাষ্পরুদ্ধ হাহাকারে ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস।

সারিবদ্ধভাবে একে একে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সেই কাতারে ছিলেন এদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় সবাই। সেখানেও একইভাবে ছায়ানটের শিল্পীরা পরিবেশন করেন কিছু নির্বাচিত রবীন্দ্র সঙ্গীত। শহীদ মিনারে উপস্থিত বিশিষ্ট শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার বলেন, "আমরা তার কাজ শেষ হয়ে গেছে বলবো না। তিনি যে কাজ শুরু করে গেছেন তা আমাদের শেষ করতে হবে।

আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। " সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, "সংস্কৃতির সকল অঙ্গনে আমরা তাঁকে পেয়েছি। তিনি সেসব অঙ্গনকে আমৃতু্য সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। আজ তাঁকে হারিয়ে আমরা যেন সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি। " শেষবারের মতো প্রেসকাবে "বাঙালি চেতনার উজ্জল জ্যোতিষ্ক ওয়াহিদুল হকের মৃতু্য নেই প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ওয়াহিদুল হক থাকবেন চিরঞ্জীব।

" প্রয়াত সাংবাদিক ও কলাম লেখক ওয়াহিদুল হকের জন্য প্রেসকাবে রাখা শোক বইয়ে এভাবেই তার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী শাহরিয়ার কবির। একইভাবে আরও অসংখ্য প্রিয়জন, ভক্ত, শিার্থী, সহকর্মী, সাংবাদিক ও সর্বস্তরের মানুষ লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের ভালোবাসার কথা। দুপুরে নির্দ্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই সাংবাদিকরা প্রেসকাব প্রাঙ্গণে প্রতীায় ছিলেন দেশ বরেণ্য এই ব্যক্তিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। ঠিক দেড়টায় এই গুণীর মরদেহ নিয়ে আলীফ পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করে প্রেসকাব প্রাঙ্গণে। দর্শণার্থীদের জন্য 1 টা 40 মিনিটে শেষবারের মতো তার মুখ দেখানো হয়।

সারিবদ্ধভাবে সবাই এগিয়ে যান তার মরদেহের দিকে। নিথর মুখটি দেখে অনেকেই স্মৃতিকাতর ও আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। সাংবাদিকসহ অনেক শুভানুধ্যায়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তি তাকে শেষ বিদায় জানাতে হাজির হয়েছিলেন প্রেসকাবে। এসেছিলেন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, সাবেক সাংসদ মোসাদ্দেক আলী ফালু, আসাদুজ্জামান নুর, প্রেসকাব সভাপতি রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক এবিএম মুসা, আতাউস সামাদ, কামাল লোহানী, গোলাম সারওয়ার, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মনজুরুল আহসান বুলবুল, শিাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরও অনেকে। সর্বশেষ তার মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে।

প্রেসকাবে উপস্থিত অবজারভার ও মর্নিং নিউজে কর্মরত ওয়াহিদুল হকের সহকর্মী ও বন্ধু প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা বলেন, "খন্ডকালীন ক্রীড়া প্রতিবেদক হিসেবে অবজারভারে 1957 - 58 সালে ওয়াহিদুল হক সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে পর্যায়ক্রমে ওই পত্রিকার সাব - এডিটর ও সিনিয়র সাব - এডিটর হন। এর মাঝে কিছুদিন মর্নিং নিউজে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর ওভাবে আর সাংবাদিকতায় ফেরেননি। তবে 90 এর দশকে কিছুদিন তিনি ডেইলি স্টারে কাজ করেছেন।

ভোরের কাগজ এবং জনকণ্ঠে তিনি নিয়মিত কলাম লেখক ছিলেন। তাঁর শাণিত লেখনী অনেকের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সহকর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন চমৎকার একজন মানুষ। " বাংলাদেশ সাংবাদিক ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ও অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী তার সম্পর্কে বলেন, "সাংবাদিকতার েেত্র তাকে আমরা শিাগুরু হিসেবে দেখি। তিনি আমাদের গাইড ও একইসঙ্গে আদর্শ ছিলেন।

ভয়ভীতি ও লোভ লালসার ঊধের্্ব উঠে কীভাবে সৎ সাংবাদিকতা করতে হয় তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। সাংবাদিকতায় আমরা একজন পথ প্রদর্শককে হারালাম। " আগামী 3 ফেব্রুয়ারি বিকেল 4টায় শহীদ মিনারে ওয়াহিদুল হক স্মরণে নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন সংগঠনের শোক ওয়াহিদুল হকের মৃতু্যতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-- বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক কমরেড খালেকুজ্জামান রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, "ওয়াহিদুল হক আমৃতু্য এ দেশে অসামপ্রদায়িক সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।

বিশেষ করে গত শতকের ষাটের দশক জুড়ে এবং '71 এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে তার লড়াই অবিস্মরণীয়। " কমরেড খালেকুজ্জামান ওয়াহিদুল হকের পরিবার এবং শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল--জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ রোববার এক শোক বার্তায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃত ওয়াহিদুল হকের মৃতু্যতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবার, স্বজন, সহকমর্ী ও গুণগ্রাহীদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। দুপুরে শহীদ মিনারে জাসদের প থেকে হাসানুল হক ইনু, শিরিন আক্তারসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ওয়াহিদুল হকের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সমন্বয়কারী জাহেদুল হক মিলু বিবৃতিতে বলেছেন, ওয়াহিদুল হক আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্তম্ভ।

অসামপ্রদায়িক চেতনায় গভীর আস্থা রেখে আজীবন তার বিকাশে ভূমিকা রেখে গেছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।