আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খাবারে বিষ (রোমাঞ্চ গল্প)

timursblog@yahoo.com

ঠিক দুপুর আড়াইটা বাজে । লাফায়েত অ্যাভেনিউয়ের শেষ মাথায় বার্গার কিংএর রেস্তোঁরাটার সামনে গাঢ় নীল পন্টিয়াক কাটলাস গাড়িটা এসে থামল । রাশান থার্ড সেক্রেটারি ভাসিলি মিখালকভ এর লাঞ্চের সময়, যদিও এতো মানী লোকের পায়ের ধুলো রোজ পড়ে না এই গরীব রেস্তোঁরায় । কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছুতে এখনো অনেকদুর যেতে হবে মিখালকভকে, তাই পথিমধ্যে এই ভোজনবিরতি । 'শালার আস্পর্ধা দেখো! ভাসিলিকে পার্ক করতে দেখে মনে মনে গাল দিল অনুসরন করে আসা ডিটেকটিভ জ্যাক স্মিথ ।

'সাহস কম নয় শালার, ডিপ্লোম্যাটিক লাইসেন্স প্লেট ছাড়াই চলাফেরা করছে, গাড়িটাও আমেরিকান !' এফবিআই এজেন্ট জ্যাক স্মিথের ওপর হুকুম আছে শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়া কুটনীতিকদের কৌশলে অনুসরণ করা । যাদেরকে অনুসরন করা হচ্ছে ব্যাপারটা তারাও অনেকে জানে, তবে তেমন গা করে না কেউ, পেটে খেলে পিঠে সয়, তাছাড়া এইই দুনিয়ার নিয়ম, ডিপ্লোম্যাটদের বিশ্বাস করতে নেই, প্রতিপক্ষ শিবিরের হলেতো কথাই নেই । কিন্তু মিখালকভের হামবড়া, থোড়াই কেয়ার ভাব দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় স্মিথের । গাড়িতে ওঠার সময় যেভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশটা দেখে নেয় মিখালকভ, টিকটিকির গাড়ি দেখলে যেরকম তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে ওর ঠোটের গোড়ায়, সেটা স্মিথের পক্ষে হজম করা সত্যি কঠিন । তবে থামায় ভালোই হয়েছে, পেট চোঁ চোঁ করছে স্মিথেরও, কিছু কিনে নেয়া যাবে ।

প্যাকেট লাঞ্চের কাউন্টারে দাঁড়ালো স্মিথ । 'হাড়ছাড়া চিকেন স্যুপ, গাজরের সালাদ আর সাথে নুডলস দিন' বলে একটা কোণের টেবিলে বসে পড়লো ও । দুই টেবিলের মাঝখানে একটা নিচু কাউন্টার কিছুটা আড়াল সৃষ্টি করেছে । একটু পর সাবধানে ঘাড় ফিরিয়ে মিখালকভের দিকে চাইল স্মিথ । অহংকারী লোকটা তার দিকেই চেয়ে আছে একদৃষ্টে ! মাথা গরম হয়ে গেলো স্মিথের, কষ্ট করে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে, চাকুরির খাতিরে রুটিন দায়িত্ব পালন করছে সে মাত্র, এতো মাথা গরম করার কিছু নেই মনে মনে বোঝাল নিজেকে স্মিথ ।

কিন্তু স্মিথের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই আঙুল তুলে ওয়েট্রেসকে ডাকলো মিখালকভ, কাছে যেতেই ওয়েট্রেসের হাতে একটা ভাঁজ করা চিরকুট দিয়ে ওই ভদ্রলোকের জন্য" বলে জ্যাক স্মিথের টেবিলের দিকে নির্দেশ করল । তারপর হেসে স্যুপের বাটিতে চামচ ডোবালো রাশান কুটনীতিক । চিরকুটটা খুলল স্মিথ । "আমার পিছনে লেগে থাকাটা আমি পছন্দ করছি না স্মিথ, সময় নষ্ট না করে বাড়ি যাও--ভাসিলি" । এবারে সত্যিই মাথায় শিরা দপদপ করতে লাগলো জ্যাক স্মিথের "বটে! ডিপ্লোম্যাটিক লাইসেন্স পেয়ে আসলেই ধরাকে সরা জ্ঞান করছে এই বিদেশি, একটা শিক্ষা না দিলেই নয়" ।

কিন্তু কি ভাবে? সরকারের বেতনভোগী ডিটেকটিভের পক্ষে বিদেশি কুটনীতিকের সাথে হাতাহাতি করা প্রায় অসম্ভবই নয়, ভীষন বিপদজনকও বটে! ভাসিলি মিখালকভকে স্রেফ স্রেফ চোখে চোখে রাখতে বলা হয়েছে তাকে । হাতাহাতি করলে শুধু চাকুরি যাবে না, আন্তর্জাতিক কেলেংকারি ঘটানোর দায় জেল-জরিমানাও হতে পারে । সিগারেটের জন্য পকেটে হাত বাড়াতেই একটা শক্ত কিছু ঠেকতে জিনিসটা বের করলো । একটা টিউবের মতো কাঁচের শিশি, , নীচে লেখা ওরভিলন, অ্যাকুরিয়ামের কাঁচ পরিস্কার করার জিনিস, নতুন এসেছে বাজারে । মুখে শয়তানী হাসি ফুটলো জ্যাক স্মিথের ।

ত্যাঁদোড় ডিপ্লোম্যাটকে শায়েস্তা করার ভালো বুদ্ধি পাওয়া গেছে । দু'কাপ কালো কফির ফরমাশ দিলো সে । কফি দিয়ে চলে যাচ্ছিলো ওয়েট্রেস, ডেকে থামালো তাকে স্মিথ, 'এটা আমার তরফ থেকে ওই ভদ্রলোকের জন্য । ' ওরভিলনের শিশির খানিকটা এর মধ্যেই অন্য কফির কাপে খালি করে ফেলেছে স্মিথ । ওরভিলনের কোন গন্ধ নেই জানে স্মিথ ।

এ ঘটনায় সন্দেহ জাগা উচিৎ ছিলো ওয়েট্রেসের, কিন্তু নতুন এসেছে সে, তাছাড়া একটু আগেই একটা চিরকুট বয়ে এনেছে সে একজনের কাছ থেকে । 'পুরনো বন্ধু বোধহয় ওরা, অনেকদিন পর দেখা, হঠাৎ কথা বলতে চাইছে না' আর ঠিক সেই মুহুর্তেই কিচেন থেকে ডাক পড়ায় সন্দেহের লেশটুকু উবে গেলো মন থেকে । দ্রুত পায়ে এগুলো সে কিচেনের দিকে, সার্ভিস কাউন্টারের নিচে রাখা স্যুপের বড় ভ্যাটটা রাখা, খেয়াল করেনি ভালো মতো । পাশ দিয়ে যাবার সময় কনুইটা বেঁধে গেলো কাউন্টারের ওপর রাখা ওজন মাপা যন্ত্রটার কোণায়, কাপ থেকে সবটা কফি ছিটকে পড়লো ভ্যাটের স্যুপের মধ্যে ! সর্বনাশ! দ্রুত আশেপাশটা দেখে নিলো সে, কেউ দেখেনি! মাত্র তিনজন খদ্দের, স্মিথ আবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে, তাছাড়া কাউন্টারটা আড়াল করে রেখেছে । চট করে স্যুপের মধ্যে একটা আঙুল ডুবিয়ে চেখে নিলো, নাহ, স্বাদেও কোন হেরফের বোঝা যাচ্ছেনা, আবার তলব পড়লো কিচেন থেকে, তড়িঘড়ি করে ছুটলো সে ।

রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো স্মিথ, কয়েকমাস আগের একটা ঘটনা মনে পড়ছে । শ্যাওলা জমে ময়লা হয়ে যাওয়া অ্যাকুয়ারিয়ামের কাঁচগুলো খুলে পরিস্কার করার জন্য ওরভিলন মাখিয়ে গ্যারেজের দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখেছিলো স্মিথ । হঠাৎ স্মিথের হলদে লাব্রাডর কুকুর ড্যাকোটা এসে জিভ দিয়ে চেটে দিল একটা কাঁচের প্যানেল (সব কিছুই জিভ দিয়ে একবার চেটে দেখা ছ্যাঁচ্চোড় কুকুরটার একটা খাসলত, স্মিথের বাড়িতে ঠাই হবার আগে ছোটবেলাটা রাস্তায় কাটিয়েছে কিনা !), ফলাফল অবশ্য সাথে সাথেই পেলো ড্যাকোটা, মুখ দিয়ে ফেনা তুলে তড়পাতে লাগলো মাটিতে । সাথে সাথে ভেটেরনারি হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মারাই যেতো বোকা জানোয়ারটা, এরপর থেকে অভ্যাসটা কিছুটা শোধরাবার চেষ্টা করছে সে । ঘটনার পর ওরভিলনের শিশিটা তুলে লেবেলটা পড়ে দেখেছে স্মিথ "টক্সিক এলিমেন্টস,মে ইরিটেট স্কিন, ইউজ উইথ কেয়ার" ।

তা লেবেলে লেখা না থাকলেও, লেখাপড়া জানে এমন মানুষ নিশ্চয়ই স্বাদটা কেমন জানার জন্য কাঁচ পরিষ্কার করার ওষুধ খেয়ে দেখবে না । বেশ কিছুকাল যে ভাসিলি মিখালকভকে বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত স্মিথ । হাসপাতালেও যেতে হতে পারে পাকস্থলি ধোলাইয়ের জন্য । এবারে ফিনিশিং টাচটা দিতে হবে । রুমাল দিয়ে ধরে শিশিটা সাবধানে বের করে হাতের তালুতে রাখলো স্মিথ ।

ছোটবেলায় আইসহকি খেলার কল্যানে কোন জিনিস হাত বা পা দিয়ে ঠিকঠিক দুরত্বে ছুঁড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে জ্যাক স্মিথের । রুমাল দিয়ে ভালো করে ঘষে, শিশিটা শুন্যে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পড়ার আগেই একটা আলতো কিক মেরে সেটা মিখালকভের টেবিলের দিকে পাঠিয়ে দিল স্মিথ । পিছন ফিরে বসে আছে ভাসিলি, জানলোও না কিভাবে প্রায় নিঃশব্দে গড়াতে গড়াতে একটা কাঁচের লম্বাটে শিশি পায়ের কাছে টেবিলের নীচে এসে থামল। ঘুরে দাঁড়ালো স্মিথ, সার্ভিস কাউন্টারের পিছনে এসে বলল ওয়েট্রেস, "এই যে মিস্টার, আপনার লাঞ্চবক্স তৈরি " । দাম চুকিয়ে লাঞ্চবক্স হাতে বেরিয়ে এলো রেঁস্তোরা থেকে স্মিথ ।

দ্রুত কেটে পড়তে হবে এখান থেকে, পরে রিপোর্ট করবে, মিখালকভকে হারিয়ে ফেলেছিল সে ফলো করতে গিয়ে । কয়েকঘন্টা পরের কথা, আঞ্চলিক এফবিআই অফিসে নিজের কামরায় বসে আছে স্মিথ, সামনে একটা টিভি খোলা, বিকেলের খবর পড়ছে পাঠিকা 'বার্গার কিং রেস্তোঁরায় খাদ্যে রহস্যজনক বিষক্রিয়ায় চার জনের মৃত্যু, ষোল জন অসুস্থ, সন্দেহভাজনের তালিকায় রুশ কুটনীতিক, ঘটনার কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। ' তবে কিছুই আর শুনছে না বা দেখছে না চেয়ারে এলিয়ে বসে থাকা জ্যাক স্মিথ । সামনে টেবিলের ওপর রাখা একটা খোলা লাঞ্চবক্স.. তাতে লেখা 'বার্গার কিং, বেস্ট লাঞ্চ ইন টাউন' । ****** কয়েক সপ্তাহ পরের কথা ।

ওভাল অফিস, হোয়াইট হাউজে, এফবিআই প্রধান দেখা করতে এসেছেন প্রেসিডেন্টের সাথে । 'তাহলে একজন ডিপ্লোম্যাটই এমন কান্ড ঘটালো ? ছি! ছি! আমি ভাবতেই পারছি না..তবে রাশানদের দিয়ে সবই সম্ভব, জাতটাই খারাপ বুঝলেন । আমরা ওর বিচার করতে পারবো না, কিন্তু বহিস্কার করে দিয়েছি, আন্তর্জাতিক আদালতেও তুলবো এই মামলা । ' সহানুভুতির সাথে মাথা নাড়লেন টিকটিকি শিরোমণি। প্রেসিডেন্টের রুশ বাতিকের কথা জানেন তিনি, তবে এ নিয়ে কথা বলতে আসেন নি তিনি ।

'হ্যাঁ, সেদিন ফলো করার দায়িত্বে ছিলো এজেন্ট জ্যাক স্মিথ। রহস্যজনক মৃত্যুর পর স্মিথের পকেটে ভাসিলির নাম লেখা চিরকুট পাই আমরা । এটা যে ভাসিলি মিখালকভের নিজের হাতের লেখা, সেটা এক্সপার্টরা বের করে দিয়েছে । নিজের নাম নিজেই লিখে আমাদের কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে বেকুব লোকটা, সেদিন বার্গার কিং এ থেমেছিলো ভাসিলি । তার টেবিলের নীচে বিষাক্ত কাঁচ পরিষ্কার করার কেমিক্যালের শিশি পাই, নাম ওরভিলন।

তো আমার একটা অনুরোধ আছে মি. প্রেসিডেন্ট । ' 'কি সেটা?' জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট । 'তেমন কিছু না, দেশের কাজে শহীদ এমন এজেন্টদের পোট্রর্েট আমরা লবিতে টাঙ্গিয়ে রাখি, যাতে অন্যরা প্রেরনা পায় তাদের দেখে । আপনাকে আমাদের অফিসে এসে এজেন্ট জ্যাক স্মিথের পোট্রর্েট উন্মোচন করতে হবে । ' 'অবশ্যই অবশ্যই," বলে বিদায় জানাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট ।

"দেশের নিরাপত্তা তো রক্ষা করছে এই দুঃসাহসী লোকগুলোই, তাদের জন্য এতোটুকু করতে পারবো না আমরা?' .....তা বাড়িতে কে কে আছে স্মিথের?'জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট "কেউ না, মি. প্রেসিডেন্ট । তার বউ পাগলাগারদে, ছেলে বাইরে থাকে, শুধু একটা কুকুর আর কতগুলো অ্যাকুরিয়াম নিয়েই পড়ে থাকতো, শেষ দিকে নাকি ওর মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে পড়েছিল। ' শেষ:

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।