আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৌশিকের একটা অদ্ভুত দিন!

যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে

মর্নিং কিসটা যুৎসই হতে হবে বাসা থেকে বের হবার সময়। দিনের প্রথম চুমো সবসময় বিশুদ্ধ, দুর্গন্ধমুক্ত হলে দিনটা যায় তরতাজা। আমি ফুরফুরে মেজাজে রাস্তায় বের হই, বাইরে রোদ্দুর, শীতের পাটাতন তেমন শক্তপোক্ত নয় বলে সিগারেটের ধুয়ো বের হচ্ছে ভুসভুস করে। অফিসে বসে পরিকল্পনা মাফিক দিনে এক কাপ চা পান করতে গিয়ে মিথিলার মৃতু্য সংবাদ সব কিছু পানসে করে দিল। ব্লগে তার উপস্থিতির সাথে আমি পরিচিত।

লেখালেখির সাথেও কিঞ্চিত। কিছুক্ষণ পরে পথিকের দু বন্ধুর দূর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর এবং শেষে স্নিগ্ধার বাবার মৃত্যুর খবর আমাকে হতবিহবল করে দিল। বিকেলে তাকে বাসে উঠিয়ে দেবার জন্য বের হয়েই সামনে দেখলাম দাফনের জন্য একজনের লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিএনজিতে উঠে ড্রাইভারের কাছে আরেকটা মৃতু্য সংবাদ। আমি দিকবিদিকশূণ্য হয়ে পড়ি।

জ্যাম ঠেলে যখন বাসস্টান্ড গিয়ে পৌছলাম তখন স্নিগ্ধার বাস ছেড়ে গেছে। ফোনে কিছুক্ষণ সান্তনা দিয়ে আমি মুড চেঞ্জ করার অবলম্বন খুঁজি। পিয়াল, রাসেল, শোহেইল ভাইকে ফোন করে জানলাম তাদের আজিজে আসতে আরো কিছুক্ষণ বাকী। বাকী আসতে পারবে 8টার পরে। রাইসু দা 7 টায়।

আমার মোবাইলে বাজে 6টা। ভাবলাম কিছু সময় গিয়ে পলাশের অফিসে কাটিয়ে আসি। চঞ্চল মাহমুদের অফিসের তিনতলায় রুটস প্রোপার্টিজ। রিয়েল স্টেট কোম্পানী। পলাশ এটার এমডি।

তার পিসিতে আর্থ গুগল। ঢাকার ক্লোজ স্যাটেলাইট ইমেজ দেয়ায় সে এখন খালি প্লট খুঁজে বের করছে। অভিনব সব আয়োজন, অভিনব তার স্ট্রাটেজি। রাইসুদা চলে এসেছে আলিয়াঁেস। আমার পেটে খিদে।

রাইফেলসের ধাবাতে নিয়ে গেলেন তিনি। চিকেন কাবাব, দইবড়া, ফুচকা খেয়ে পেটের খিদে মেটাতে মেটাতে রাইসুদার প্রশ্ন আপনি যে অন্য মেয়ের সাথে ঘোরেন, আপনার স্ত্রী কি সেটা জানেন? আমি স্বীকার করি, আমি জানাই না, কারণ সে কষ্ট পাবে, হয়তো তার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে যদিও তার বিশ্বাস আমি নষ্ট করছি না। কিন্তু আমার মত সে বিষয়টিকে গ্রহণ করবে না হয়তো। আজকে শুভ্রার বাবার মৃতু্য সংবাদ শুনে ছুটে যাওয়াটা যতই মানবীয় হোক তার মনে যে প্রশ্নবোধকত্ব তৈরী হবে, তা আমি দূর করতে পারবো না। রাইসুদা বলেন, তাহলে রিক্স নেন কেন? যদিও আমি বলি আসলে রিস্ক তো নেই না, যেমন আপনার সাথে এসব কথা স্বীকার করছি কিন্তু আপনি তো আমার স্ত্রীকে চেনেন না, তারপরেও মনে হয় আসলে রিস্ক নেয়াই হচ্ছে।

অতিআত্ববিশ্বাসী ম্যানেজেবল একটা বিবৃতি দিয়ে নিজেকে চাংগা করি কিন্তু সেটা কিভাবে বাসায় ফিরতে ফিরতে পরিবর্তিত হয়ে গেল, সেটা পরে বলছি। এরপরে শোহেইল ভাইয়ের সাথে দেখা। পিজি ও শাহবাগের মাঝের রাস্তায়, চায়ের দোকানে। অনেকদিন পরে পিয়াল ভাই ও রাসেলের সাথেও দেখা হলো। ইদানীং রাসেলের সাহিত্যে আদর্শবাদীতা আমার ভাল লেগেছে।

আমার কাছে যদিও এটা একটা ফর্মে রাইসু দার ভাষার সাম্প্রতিক কথন রীতিকে সাহিত্যে স্থান করে নেয়ার প্রচেষ্টার পরিপূরক মনে হয়েছে তারপরেও দুইটা বিষয়েই আমার ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রয়েছে। যেমন সাহিত্যে আদর্শবাদিতা হচ্ছে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়, যেটা কোন একটা আদর্শকে মেইনস্ট্রীম করার জন্য হয়ে থাকবে। কিন্তু এটা সাহিত্যের প্রবাহমানতায় সম্ভব নয় আপাতদৃষ্টিতে যদি খুব বেশী সংগবদ্ধ না হয় উৎসাহীরা। কিন্তু আমি সংঘবদ্ধ করার পক্ষে। এটা এমনি এমনি হবে না বলে আমার অভিমত।

রাইসুদার বিষয়টাও তদ্রুপ, মনে হয় ভাষার সাথে দেশের একক ও আলাদা একটা পরিচয় স্থাপনের জন্য এটা একটা আন্দোলন। কিন্তু তাও ঐ স্বাভাবিক প্রবাহমনতায় হারিয়ে যেতে পারে বা প্রতিষ্ঠিত নাও হতে পারে, কারণ অনেকবেশী কানেকটেড আমরা বিশ্বের সাথে। একটা সংগবদ্ধতা সে অর্থে আন্দোলন ঠিক প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই শুরু করা উচিত। শোহেইল ভাইয়ের সাথে অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো। সিলেটের সাতকড়া, বরিশালের মানুষ ইত্যাদি নিয়ে।

রাইসু ভাইয়ের যার যার তার তার বিল দেয়ার রীতিটাকে তিনি একপেশে করার জন্য অনেকক্ষণ চেষ্টা চালালেন। তবে রাজনীতি বিষয়ক আমার ক্যাচালে তিনি স্থিতিশীলতার পক্ষে মত দিলেন। রাসেল নির্বিরোধী নাগরিক, রাষ্ট্রীয় আইন পালনকারী। আমরাও তদ্রুপ। কার ইংগিতে দেশে এমন হচ্ছে এমন গুরুগম্ভীর আলোচনায় ইংগিতদাতা কে সেটা উল্লেখ না করে আমরা গুষ্টিউদ্ধার করছিলাম, বাংলাদেশের স্বার্থ নয়, অন্য কারো স্বার্থে দেখা যাচ্ছে।

কেউ নাম আর বলে না। রাইসুদা পরিষ্কার করলেন, আরে বাবা, বলো, সিআইএর ইংগিতে হচ্ছে! পিয়াল ভাই একটা উদাহারণ দিতে গিয়ে বললো, ধরো রাইসু, এটুকু বলে অন্য কথায় যাবার আগে রাইসুর উত্তর, পিয়াল ঠিকআছে আর ব্যাখ্যা দেয়া লাগবে না, ব্যাখ্যায় ভীত রাইসুর কথায় আমরা দিনের সবচেয়ে বৃহৎ হাসিটা অতপর উগড়ে দিলাম। বাসায় ফেরার পালা। শাহবাগে সিএনজি নিলাম। ড্রাইভারের দিকে খেয়াল করি নি।

কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বিয়ে করেছেন? আমি বললাম, হ্যা। এতরাত পর্যন্ত বাইরে থাকবেন না। বিবিকে সময় দেবেন। আমি চমকে উঠি। অযাচিত আলাপে কিঞ্চিত বিরক্ত।

লোকটাকে খেয়াল করলাম, লম্বা চুল, লম্বা দাড়ী, কাচা পাকা মেশানো। তিনি তার উপরের গ্লাসটা ঠিক করেন এবার তার পুরো অবয়ব দেখতে পারি। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। শিরশিরে একটা অনুভূতি মেরুদন্ড বেয়ে নেমে আসে। তিনি বলেন, কি ভাবছেন, জ্ঞান দিচ্ছি! জীবন আমাদেরই সুন্দর করতে হয়, সুন্দর করার চাবিকাঠী আমাদের হাতে।

আমি এবার নমনীয়। তিনি বলেন, বন্ধুদের থেকে স্ত্রীকে বেশী সময় দেবেন। রাগ হলে বাইরে বের হয়ে যাবেন, কিছুক্ষণ বাইরে থেকে চা সিগারেট খেয়ে ঘরে ঢুকবেন। এবার সত্যি সত্যি আমি চমকে উঠি। ক'দিন আগে একদিন রাগের মুহূর্তে টিভি, ডিভিডি ভেঙে ফেলেছিলাম, মনে হলো তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেলে তো আর 25 হাজার টাকা জলে যেত না! পরে তো সবই ঠিকঠাক হয়েই গেল, মাঝখানে 25 হাজার টাকার জিনিস বিক্রি করতে হলো 1500 টাকায়! আমি এবার তার দিকে পুরো মনযোগ দেই।

তাকে বলি, আপনার সাথে আমি পরে দেখা করবো, কোথায় আপনার বাসা! জানলাম আমার বাসার কাছেই। তিনি আমাকে বললেন, আপনি যদি একটু অপেক্ষা করেন, তবে গ্যারাজে গাড়ীটা রেখে আসতে পারি, তারপরে বাসায় যাবার পথে কিছুক্ষণ আলাপ করা যাবে, এক কাপ চাও খাওয়া যাবে। গ্যারেজে গাড়ী রাখলেন। আমরা একটা রিকশায় উঠলাম। তিনি বললেন, যদিও আমার বয়স অনেক দেখায়, আমি কিন্তু 42।

তবে বিয়ে করেছি 18 বছর বয়সে। বড় মেয়ে এসএসসি দেবে, ছেলে নাইনে। ঘর পালানো ছেলে, পড়াশুনা করতে পারিনি, তবে ভাল আছি। আমি বললাম, আপনার কথাতো অনেক মার্জিত, শিক্ষাপ্রাপ্তর মত! তিনি জানালেন, আসলে তিনি একজন নাট্যকমর্ী। বিবর্তন গ্রুপে ছিলেন, এখন আরো কয়েকটা গ্রুপের নাম বললেন, টিএসসিতে রিহার্সেল করেন।

টিভি নাটকও করেছেন। কিছুদিন আগে ইউ-টার্ন নামে একটা নাটকেও তিনি ছিলেন। কিন্তু খুবই কম সম্মানী পান। আফজাল হোসেন নাকি মাত্র 500 টাকা দিয়েছেন। এবার ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞেস করি।

জানালেন গোলাম মোস্তফা। তার বাসার সামনে চলে এসেছি। তিনি বললেন, কিভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ হবে, আমি বললাম, আমিই যোগাযোগ করবো! তিনি বিষন্ন দৃষ্টিতে বললেন, হারিয়ে যাবেন না তো! আমি অট্টহাসি দিয়ে বলি, না না! কেন হারাবো না, তা বোধহয় তিনি কল্পনা করতে পারেন নি! আমি বহু নারীসংগ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছি মোস্তফার সাথে কথা বলার সময় থেকে, আর মাথার মধ্যে ঘুরছিল রাইসু দার সাথে আলাপচারিতার পর থেকে। বাসায় ফেরার বাকী পথটুকু একটা হ্যাপী এন্ডিং খুজছিলাম। কিন্তু হলো না।

বাসার সামনেই শিরোনামহীনের জিয়ার সাথে দেখা। তার গাড়ী এক্সিডেন্ট করেছে, তার কিছু না হলেও গাড়ীটির পেছনটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। আমি জিয়াকে বলি, আজকে আর কোন লোড নিতে পারবো না ভ্রাতঃ, অলরেডি অনেক লোডেড! বাসার সামনে। রাত্র 11:10 মিনিট। অপেক্ষার পালা।

দরজার খুলতে এসে পার্টনার যদি গেটের প্লাল্লার আড়ালে থাকে তবে বুঝবো সে রেগে আছে। আমি গুনতে থাকি 1,2,3। পাল্লা খুললো, সে সহাস্যে বেড়িয়ে এসেছে পাল্লার অন্তরাল ছেড়ে। সামনের রাস্তায় কেউ নেই। অনায়েসে একটা চুমু দেয়াই যায়! আমার সারাদিনের সমস্ত ক্লেদ, ক্লান্তি নিমিষেই শেষ হয়ে গেল।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আজকে আমি তো দেরি করে এসেছি, কিন্তু তুমি যে কিছু বললে না? সে বললো, হঠাৎ আজ ভাবছিলাম, আজকে যদি আমি জানতে পারি শীঘ্রই আমি মরে যাবো, তবে কি ইচ্ছে করবে জানো? আমি জানতে চাই, কি ইচ্ছে করবে? সে আমার বুকের মধ্যে আরো ঘনিষ্ট হয়, কোমল গলায় বলে, আমি কৌশিকের সাথে আরো কিছুদিন থাকতে চাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।