আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরহান পামুকের নোবেল বক্তৃতা

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

আমার বাবার সুটকেস অনেকেই আশা করেছিলেন রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে বহুল আলোচিত প্রথম টার্কিশ নোবেল বিজয়ী ওরহান পামুকের নোবেল বক্তৃতা জুড়ে হয়তো টার্কি ও সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক সংঘাত প্রাধান্য পাবে। কিন্তু বক্তৃতা শুনে সবাই অবাক হয়েছেন। এটি ষোল আনা সাহিত্যিক ভাষণ। এতে নিজের পরিবার, পরিপাশর্্ব বিশেষ করে বাবার কথা বলেছেন তিনি একজন দক্ষ ঔপন্যাসিকের কুশলতা নিয়ে।

বর্ণনা করেছেন একজন ব্যক্তির সাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার কথা। পামুকের বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। লেখক জীবনের দীর্ঘ একটি সময়জুড়ে তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন বাবা। পামুকের নোবেল বক্তৃতার শিরোনাম 'আমার বাবার সুটকেস'। সুইডিশ একাডেমিতে দেয়া এই ভাষণটির ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ এখানে পোস্ট করা হলো।

মৃতু্যর দুই বছর আগে বাবা আমাকে একটা ছোট সুটকেস দিয়েছিলেন। তাতে ছিল তার লেখা, পাণ্ডুলিপি ও নোটবুক। তার স্বভাবসুলভ রসিকতা ও তামাসা করার ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, আমি চলে যাওয়ার পর এগুলো পড়ো। চলে যাওয়া বলতে তিনি মৃতু্যকে বুঝিয়েছিলেন। তাকে খানিকটা বিব্রত মনে হচ্ছিল।

'শুধু একটা নজর বুলিয়ে দেখো। হয়তো এতে এমন কিছু আছে যা তোমার কাজে লাগতে পারে। আমার চলে যাওয়ার পর হয়তো এগুলো থেকে কিছু বাছাই করে তুমি ছাপতেও পারো। ঘটনাটা ঘটেছিল আমার পড়ার ঘরে। চারদিকে ছিল বইয়ের সারি।

বাবা এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন সুটকেসটা রাখার জায়গার সন্ধানে। যেন একটা লোক তার বেদনাদায়ক বোঝা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চাচ্ছেন। শেষ পর্যনত্দ সচরাচর চোখে পড়ে না এমন একটা জায়গায় সুটকেসটা রেখেছিলেন। এই লজ্জাজনক মুহূর্তটার কথা আমরা কেউই কখনো ভুলিনি। কিন্তু ঘটনাটা শেষ হওয়ার পর আমরা যার যার নিজের ভূমিকায় ফিরে গিয়েছিলাম।

তামাসা, রসিকতা, জীবন নিয়ে হালকা কথাবার্তা আবার আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করেছিল। আমরা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। কোনো দুঃখবোধের অবকাশ না রেখে সবসময় যেভাবে কথা বলতাম সেভাবেই কথা শুরু হয়েছিল। দৈনন্দিন জীবনের টুকটাক বিষয় নিয়ে, টার্কির অনিঃশেষ রাজনৈতিক সঙ্কট বিষয়ে, বাবার ব্যর্থ ব্যবসা উদ্যোগগুলো নিয়ে। আমার মনে পড়ে বাবার মৃতু্যর পর, বেশ কয়েকদিন আমি সুটকেসটার আশপাশ দিয়ে হেটেছি।

কিন্তু একবারের জন্যও স্পর্শ করিনি। ইতিমধ্যেই ওই ছোট কালো চামড়ার সুটকেসটা তালা-চাবি ও বক্রাকার কোনাগুলোসহ আমার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ছোটখাটো ভ্রমণে বাবা সুটকেসটা সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কখনো কখনো এটা কাজে লাগতো তার কাজের কাগজপত্র বহনের জন্য। মনে আছে, ছোটবেলায় বাবা কোনো ট্রপ থেকে ফিরলে আমি সুটকেসটা খুলতাম, ভেতরের জিনিসপত্রগুলো তল্লাশি চালাতাম।

কলোন আর ভিনদেশি গন্ধ এসে আমার নাকে লাগতো। এই সুটকেসটা ছিল আমার পরিচিত বন্ধু, আমার অতীতের, শৈশবের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার এক শক্তিশালী উপাদান। কিন্তু এখন আমি একে স্পর্শ পর্যনত্দ করতে পারছি না। কেন? সন্দেহ নেই, এর কারণ, এর ভেতরে যা আছে তার রহস্যময় গুরুভার। এখন আমি বলবো এই ভার বলতে আসলে কি বোঝায়।

এটা এমন এক জিনিস যা একজন ব্যক্তি সৃষ্টি করেন নিজেকে বদ্ধ ঘরে অন্তরীণ করে, টেবিলের সামনে বসে নিজেকে ঘরের এক কোনায় সমর্পণ করেন। এটাই সাহিত্যের মর্মার্থ। সুটকেসটা স্পর্শ করলেও নিজেকে এর ডালা খোলার জন্য প্রস্তুত করতে পারি না। কিন্তু আমি জানি এর ভেতরে আছে কিছু নোটবুকই। আমি বাবাকে এর কয়েকটিতে লিখতে দেখেছি।

সুটকেসের ভেতরের জিনিসের গুরুভার বিষয়ে প্রথম আমি ওইবারই শুনেছি, তা নয়। বাবার একটা বড় লাইব্রেরি ছিল। তার যৌবনে, 1940-এর দশকে তিনি নিজেকে ইস্তাম্বুলের একজন কবি হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভ্যালেরি কবিতা টার্কিশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তিনি গরিব দেশে অল্প পাঠকের বৃত্তের একজন কবির জীবন বেছে নিতে চাননি।

আমার বাবার বাবা, আমার দাদা ছিলেন এক অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী। শৈশব ও যৌবনে বাবা স্বসত্দিকর পরিবেশে ছিলেন। লেখালেখি বা সাহিত্যের স্বার্থে কঠোর জীবন বেছে নেয়ার ইচ্ছা তার মধ্যে ছিল না। আমি বুঝতে পারি তিনি জীবন ও এর সব সৌন্দর্যকে ভালোবাসতেন। বাবার সুটকেস থেকে আমাকে দূরে রেখেছিল, এর ভেতরের বস্তুগুলো।

ভেবেছিলাম এগুলো পড়লে হয়তো আমার ভালো লাগবে না। বাবাও এটা জানতেন। আর এ কারণে এগুলোকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না এমন একটা ভাব নিতে চেয়েছিলেন। 25 বছরের লেখক জীবন অতিবাহিত করার পর এগুলো দেখতে গিয়ে আমি বেদনাবিদ্ধ হতাম। কিন্তু বাবা কেন সিরিয়াসলি সাহিত্য চর্চা করতে ব্যর্থ হলেন এটা ভেবে আমি রাগ করতে চাইনি।

আমার আসল ভয় ছিল অন্য জায়গায়... সেটা ছিল আরো জটিল বিষয়... আমি এটা জানতে বা আবিষ্কার করতে চাইনি, আমার বাবা একজন ভালো লেখক। আমি সুটকেসটা খুলতে চাইনি কারণ আমি একে ভয় করতাম। আমি নিজেকে এ বিষয়ে খোলাখুলি বোঝাতে পারিনি। যদি সত্য ও মহান কোনো সাহিত্য আমার বাবার সুটকেস থেকে বের হয়, তবে আমাকে স্বীকার করতে হবে আমার বাবার আড়ালে যে লোকটি ছিলেন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তি। এটাই ছিল ভয়াবহ আশঙ্কা।

আমি আমার পরিণত বয়সেও চাইতাম আমার বাবা আমার কাছে লেখক নন, আমার বাবা হিসেবেই থাকুন। একজন লেখক সেই ব্যক্তি যিনি নিজের ভেতরকার দ্বিতীয় সত্তাকে আবিষ্কার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। বুঝতে চান সেই পৃথিবীতে যা তাকে তৈরি করেছে। আমি যখন লেখা বিষয়ে কথা বলি তখন আমার সামনে উপন্যাস কবিতা বা সাহিত্যিক ঐতিহ্য নয়, ভাসে একজন ব্যক্তির ছবি। যে ব্যক্তি নিজেকে একটা ঘরে অনত্দরীণ করেন, একা বসেন একটা টেবিলের সামনে, নিজের দিকে ফেরেন, ছায়াকেও গুটিয়ে নেন, শব্দের সাহায্যে গড়ে তোলেন এক নতুন পৃথিবী।

এই লোকটি বা এই নারীটি টাইপরাইটার ব্যবহার করতে পারেন, কমপিউটার ব্যবহার করে সুবিধা পেতে পারেন, অথবা কলম দিয়ে কাগজের ওপর লিখতে পারেন - আমি যা 30 বছর ধরে করছি। লেখার সময় তিনি চা বা কফি খেতে পারেন, সিগারেটও ফুকতে পারেন। ক্ষণে ক্ষণে তিনি টেবিল থেকে উঠে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতে পারেন। দেখতে পারেন বাচ্চাদের খেলাধুলা। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে কোনো গাছ বা দৃশ্য দেখতে পারেন।

অথবা তার চোখ আটকে যেতে পারে একটা কালো দেয়ালে। তিনি কবিতা, নাটক বা আমার মতো উপন্যাস লিখতে পারেন। এ পার্থক্যগুলো ঘটতে পারে একমাত্র নিজেকে টেবিলে বসিয়ে নিজের দিকে ফেরানোর কঠিন কাজটার পরই। লেখা মানে নিজের অন্তর্লোকের শব্দগুলোর দিকে তাকানো, জগৎ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার পর ফেলে আসা জগৎকে পাঠ করা। ধৈর্য-আনন্দ নিয়ে আত্মগতভাবে কাজগুলো করা।

আমি যখন টেবিলে বসে দিন, মাস বা বছরগুলো পার করি, ক্রমশ সাদা পৃষ্ঠায় শব্দ সাজাতে থাকি আমার মনে হয় আমি যেন নতুন একটা জগৎ নির্মাণ করছি। আমার মনে হতে থাকে আমি আমার ভেতরের আরেকটি সত্তাকে জীবন দান করছি। একইভাবে কেউ হয়তো পাথরের পর পাথর গেথে সেতু বা গম্বুজ তৈরি করেন। যে পাথর আমরা লেখকরা ব্যবহার করি তা হলো শব্দ। আমরা যখন শব্দগুলোকে হাতে পরখ করি, পরস্পরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অনুভব করার চেষ্টা করি, দূর থেকে তাদের দেখি, আঙ্গুল বা কলমের মুখের সাহায্যে সেগুলোতে হাত বোলাতে থাকি, তাদের ওজন বোঝার চেষ্টা করি, তাদের চারদিকে ঘোরাতে থাকি... বছর আসে বছর চলে যায়।

ধৈর্য ও আশা নিয়ে আমরা একটা নতুন জগৎ তৈরি করি। অনুপ্রেরণা লেখকের রহস্য নয়, তার জেদ ও ধৈর্য এটা কোথা থেকে আসে তা কখনোই স্পষ্ট নয়। মজার একটা টার্কিশ প্রবাদ আছে - 'সুই দিয়ে কুয়ো খোড়া' বলে। আমার মনে হয় লেখকদের মন নিয়েই কথাটা বলা হয়েছে। পুরনো গল্পগুলোর মধ্যে আমি ফরহাদের ধৈর্য পছন্দ করি, তাকে বুঝতে পারি যে প্রেমিকার জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় খুড়ে যাচ্ছে।

আমার মাই নেম ইজ রেড উপন্যাসে আমি প্রাচীন এক মিনিয়েচার শিল্পীর কথা লিখেছিলাম যিনি এই ধরনের নিবিষ্টতা নিয়ে একই ঘোড়ার ছবি বছরের পর বছর ধরে একে যাচ্ছিলেন। এমনকি প্রত্যেকটি আচড়ের কথা মনে করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যেন চোখ বন্ধ করে ওই সুন্দর ঘোড়াটিকে তিনি একে ফেলতে পারেন। আমি জানি, এর মাধ্যমে আসলে লেখা নিয়ে, নিজের জীবন নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম আমি। লেখককে যদি নিজের গল্প বলতে হয় তবে ধীরেসুস্থে বলতে হবে।

যেন গল্পটা অন্যদের নিয়ে। যদি তিনি নিজের ভেতর সেই গল্পের শক্তি অনুভব করতে চান তবে টেবিলে বসে ধৈর্যের সঙ্গে শিল্পের কাছে সমর্পিত হতে হবে। গল্পের প্রকৌশল হয়তো তার মনে কিছু আশা জাগাতে পারে। অনুপ্রেরণার দেবদূত (কারো কারো কাছে নিয়মিত আসে, কারো কাছে আসে কালেভদ্রে) আশা ও আত্মবিশ্বাস জাগাতে সাহায্য করে। যখন একজন লেখক সবচেয়ে একাকিত্ব বোধ করেন, তার কাজ স্বপ্ন রেখার মূল্য নিয়ে সন্দেহ করতে থাকেন, যখন তিনি ভাবতে থাকেন তার গল্পটা তার নিজেরই গল্প, তখনই দেবদূত তার কাছে চিত্রকল্প, গল্প ও স্বপ্ন উন্মোচিত করেন।

যা দিয়ে লেখক তার প্রার্থিত জগৎ নির্মাণ করতে পারবেন। নিজের জীবনের পুরোটা যে বইগুলো লিখতে গিয়ে আমি উৎসর্গ করেছিলাম আমি যখন সেই বইগুলোর কথা ভাবি তখন বিস্ময় জাগে। যে সত্দবক, স্বপ্ন বা পৃষ্ঠাগুলো আমাকে প্রচ- তৃপ্তি দিয়েছিল সেগুলো যেন আমার কল্পনা থেকে আসেনি। অন্য এক শক্তি যেন সেগুলোকে খুজে পেয়েছিল আর পর্যায়ক্রমে আমার কাছে উপস্থাপন করেছিল। আমি বাবার সুটকেস খুলতে ভয় পাচ্ছিলাম কারণ আমি জানতাম, আমি যে বাধাগুলোর মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

তিনি নির্জনতা নয় বরং বন্ধুদের সঙ্গে মেশা, ভিড়, স্যালুন, রসিকতা আর সঙ্গ ভালোবাসতেন। কিন্তু পরে আমার চিনত্দা একটা মোড় নিল। ভাবলাম এই চিনত্দা, ধৈর্য ও ত্যাগের এই স্বপ্ন আমার নিজের জীবন থেকে এসেছে। আমার লেখক হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এই পূর্ব ধারণা তৈরি হয়েছে। অনেক মেধাবী লেখকের চারদিকেই পরিবার ও সঙ্গীদের আবরণ ছিল।

সাথিদের উজ্জ্বলতা ও গুঞ্জনের মধ্যেই তারা কাজ করতেন। তাছাড়া আমার বাবা আমাদের যৌবনে পারিবারিক জীবনের একঘেয়েমিতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে অন্য লেখকদের মতো করে হোটেল রুম ভাড়া করে নোটবুকগুলো ভরেছিলেন। আমি জানতাম ওই নোটবুকগুলোও সুটকেসে ছিল।

কারণ যখন বাবা আমাকে সুটকেসটা দিয়েছিলেন তার আগে তিনি জীবনের ওই পর্বটার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। এমনকি আমার ছোট বেলাতেও তিনি ওই দিনগুলোর কথা বলেছেন। কিন্তু যা তাকে হোটেল রম্নম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল সেই নাজুক অবস্থা, লেখক হওয়ার স্বপ্ন ও আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের কথা তিনি বলেননি। তার বদলে তিনি বলেছেন কখন কখন তিনি প্যারিসের ফুটপাথে সার্ত্রেকে দেখেছেন, বলেছেন সেই বইগুলোর কথা যেগুলো তিনি পড়েছেন বা সেই মুভির কথা যেগুলো তিনি দেখেছেন। যে খবরগুলো দেয়া যায় সবই তিনি দিয়েছেন।

আমি যখন লেখক হলাম তখন আমি ওই ঘটনাগুলোকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আমি এমন এক বাবা পেয়েছি যিনি পাশা আর ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে কথা বলার চাইতে লেখকদের জগৎ নিয়ে বেশি আলোচনা করতেন। তাই বাবার নোটবুকগুলো পড়ার সময় হয়তো এ কথাগুলো মনে রাখতে হবে। মনে করতে হবে তার বিশাল লাইব্রেরির প্রতি আমার কতোটা ঋণ। মনে করতে হবে বাবা যখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তখন আমারই মতো নিজের চিন্তা ও বইগুলো নিয়ে একা হতে ভালোবাসতেন।

তার লেখার গুণ কি তা তার মনেই আসতো না। কিন্তু বাবার দেয়া সুটকেসটার দিকে ভয় নিয়ে তাকিয়ে আমি অনুভব করতাম এই কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাবা মাঝে মাঝে তার বইয়ের সামনের ডিভানে বসে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন। হাতের বই বা ম্যাগাজিনের কথা তার মনে থাকতো না। তিনি চলে যেতেন স্বপ্নের জগতে, দীর্ঘ সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন তার চিন্তার ভেতর।

তার মুখের দিকে তাকালে দেখতে পেতাম তার সাধারণ রসিকতা, খোশ মেজাজের সাংসারিক জীবনের ভঙ্গির চেয়ে এই ভঙ্গিটা আলাদা। আমি যখন শৈশব বা প্রথম যৌবনে এই অন্তদৃষ্টির দিকে প্রথম নজর দিলাম তখন সচকিত হয়ে পড়লাম। দেখলাম তিনি নির্ভার হয়ে পড়েছেন। এখন অনেক বছর পর, আমি জানি একজন ব্যক্তি যখন লেখক হন তখন এই নির্ভারতাই তার মুখ্য সূত্র। লেখক হতে হলে ধৈর্য আর কঠোর পরিশ্রমই সবকিছু নয়।

ভিড়, সঙ্গ, সাধারণ বিষয়-আশয়, দৈনন্দিন জীবন থেকে পালিয়ে নিজেকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দি করার অনুভূতি জাগাতে হবে। আমরা ধৈর্য ও আশার কথা বলি যাতে আমরা লেখায় একটা গভীর জগৎ তৈরি করতে পারি। নিজেকে ঘরবন্দি করার আকাঙ্ক্ষা আমাদের কাজের দিকে ঠেলে দেয়। সত্যিকারের সাহিত্যের সূচনা ঘটে যখন একজন মানুষ নিজেকে নিজের বইগুলোর সঙ্গে ঘরবন্দি করে ফেলেন। কিন্তু যখনই আমরা নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলি তখনই বুঝতে পারি আমরা যেমন ভাবি তেমন একা আর নই।

আমাদের সঙ্গে আছে সেই শব্দগুলো যারা আমাদের কাছে আগে এসেছিল। আছে অন্যদের বই ও শব্দগুলো। একে আমরা বলি ঐতিহ্য। আমি বিশ্বাস করি, সাহিত্য হলো মানবতার সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন যা সে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তৈরি করেছে। লেখকদের সমস্যাকীর্ণ শব্দগুলোর দিকে নজর দিলে সমাজ, গোষ্ঠী ও মানুষ আরো বেশি জ্ঞানী, সমৃদ্ধ ও অগ্রসর হয়।

আর আমরা তো জানি, বই পুড়িয়ে দেয়া ও লেখকদের নিগ্রহ দুটোই বলে, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয়াবহ সময় আমাদের নিকটবর্তী। কিন্তু সাহিত্য কখনোই শুধু জাতীয় ব্যাপার নয়। যে লেখক নিজেকে ঘরের মধ্যে অনত্দরীণ করেছেন তিনি প্রথমে নিজের অন্তর পরিক্রমণ করেন বছরের পর বছর। সাহিত্যের অসীম নিয়ম আবিষ্কার করেন। তার এই শিল্পকৌশল রপ্ত করতে হয় যার মাধ্যমে তিনি নিজের কথা বলতে পারেন অন্যের কথা বলার মাধ্যমে।

অন্য লোকের গল্প বলতে পারেন এমনভাবে যেন তা তার নিজেরই গল্প। এটাই সাহিত্য। কিন্তু প্রথমেই আমাদের ভ্রমণ করতে হবে অন্যদের গল্প ও বইগুলোর ভেতর দিয়ে। 1500 ভলিউমঅলা এক বিশাল লাইব্রেরি ছিল আমার বাবার। লেখক হওয়ার জন্য এই সংগ্রহ যথেষ্ট।

22 বছর বয়সে আমি হয়তো এর সবগুলো পড়ে উঠিনি। কিন্তু বইগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম কোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কোনগুলো হালকা ও পড়া সহজ। কোনগুলো কাসিক, শেখার জন্য কোনগুলো অবশ্য পাঠ্য। কখনো আমি দূর থেকে লাইব্রেরিটিকে দেখতাম।

ভাবতাম একদিন অন্য এক বাড়িতে আমি নিজের একটা লাইব্রেরি তৈরি করবো। আরো ভালো একটা লাইব্রেরি। নিজের জন্য একটা জগৎ তৈরি করবো। আমি দূর থেকে বাবার লাইব্রেরি দেখলে মনে হতো এটা বাস্তব পৃথিবীর ছোট একটা ছবি। কিন্তু এই পৃথিবী ছিল আমাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা পৃথিবী।

ইসত্দাম্বুলের দৃষ্টিতে দেখা। পৃথিবীতে নিজের, নিজের জীবনের, সাহিত্যের চিনত্দা করতে গিয়ে আমার মুখ্য অনুভূতি হতো, আমি পৃথিবীর কেন্দ্রে নই। পৃথিবীর কেন্দ্রে জীবন আরো সমৃদ্ধ আরো উত্তেজনাময়। টার্কির সবকিছু, ইস্তাম্বুলের সবকিছু নিয়ে আমরা এর বাইরেই পড়ে আছি। আজ আমি জানি পৃথিবীর অনেক লোকই এভাবে ভাবেন।

একইভাবে আছে এক বিশ্বসাহিত্য। আছে এর কেন্দ্র। আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। আসলে আমার মনে যা ছিল তা পশ্চিমি সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য নয়। আমার টার্কিশরা যা থেকে অনেক দূরে।

আমার বাবার লাইব্রেরি ছিল এর একটা প্রমাণ। এর একদিকে ছিল টার্কিশ সাহিত্য, আরেক দিকে ছিল পশ্চিমি সাহিত্যের সংগ্রহ। আমার মনে হতো, বাবা এই বইগুলো পড়েছিলেন জীবন থেকে পালিয়ে পশ্চিমে উড়ে যাওয়ার জন্য, যা আমিও পরে করবো। অথবা আমার মনে হতো বইগুলো হলো অপূর্ণ সংস্কৃতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে স্থানানত্দরিত করার হাতিয়ার। শুধু পড়ার মাধ্যমেই নয় আমরা আমাদের ইসত্দাম্বুলের জীবন থেকে পালাতে চাই লেখার মাধ্যমেও।

নোটবুকগুলো ভরার জন্য বাবা প্যারিসে গিয়ে নিজেকে ঘরবন্দি করেছিলেন তারপর ফিরেছিলেন টার্কিতে। আমি বাবার সুটকেসের দিকে তাকাই, বুঝি এটা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। টার্কিতে একটি ঘরে বসে 25 বছর ধরে লেখক হিসেবে টিকে থাকার কাজ করার পর বাবার সুটকেসের গভীর চিনত্দাগুলোর কথা জানার আগ্রহ হলো আমার। যেন লেখা সমাজ, রাষ্ট্র আর মানুষের চোখের আড়ালে করার মতোই এক গোপন কাজ। বাবা সাহিত্যকে আমার মতো সিরিয়াসলি নেননি বলেই আমি সম্ভবত তার ওপর রাগান্বিত ছিলাম।

আসলে বাবা আমার মতো করেননি বলে আমি তার ওপর রাগান্বিত ছিলাম। তিনি স্ত্রীর সঙ্গে কখনোই ঝগড়া করেননি। বন্ধু ও ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে হেসে-খেলে তিনি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার আরেকটা সত্তা জানে, আমি যতোটা রাগান্বিত ছিলাম ততোটাই ঈর্ষাকাতর ছিলাম। দ্বিতীয় শব্দটাই বেশি উপযুক্ত।

এটাও আমাকে অস্বসত্দিতে ফেলেছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, সুখ কি? একটা রুমে বসে আমি গভীর জীবনযাপন করি এটাই কি সুখ? নাকি সমাজে সুখকর জীবনযাপন করা অন্যদের মতো একই ভাবনা ভাবতে পারাটাই সুখ? কিন্তু এই প্রশ্নগুলো অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আসলে কি আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছাতে পেরেছি যে সুখই ভালো জীবনের নির্দেশক? লোকজন, সংবাদপত্র, সবাই এমন ভাব করে যেন সুখই জীবনের পরিমাপক। এই অবস্থার সম্পূর্ণ উল্টো পিঠে কি সত্য থাকতে পারে না? যাই হোক, বাবা পরিবার থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়েছিলেন। আমি তার কতোটা জানি, আমি তার অস্বসত্দির কতোটা অনুধাবন করতে পারি? আমি প্রথমবার বাবার সুটকেস খোলার সময় এ প্রশ্নই আমাকে তাড়িত করেছিল।

আমার বাবার কি গোপন কোনো ব্যাপার ছিল? অসুখী কোনো ব্যাপার ছিল যা আমি জানি না? যার অবসান ঘটতো একমাত্র লেখালেখির মাধ্যমেই? সুটকেসটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভ্রমণের গন্ধ পেলাম। বাবা এর আগেই আমাকে কয়েকটি নোটবুক দেখিয়েছিলেন। কিন্তু খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। বেশির ভাগ নোটবই তিনি ভরিয়েছেন প্যারিসে থাকার সময়। তখন তরুণ বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন।

আমি যে লেখকদের পছন্দ করি তাদের জীবনীর দ্বারা উৎসাহিত হয়ে আমি জানতে চাই আমার বয়সে আমার বাবা কি চিনত্দা করতেন, কি লিখতেন। আমি এখন যা ভাবি তা আমার শৈশব বা যৌবনের ভাবনা থেকে পুরো উল্টো। আমার কাছে পৃথিবীর কেন্দ্র হলো ইস্তাম্বুল। আমি এই শহরে পুরো জীবন কাটিয়ে দিলাম বলে নয়, এর পেছনের কারণ হলো গত 33 বছর ধরে আমি এর রাসত্দা, সেতু, লোকজন, কুকুর, বাড়িঘর, মসজিদ, ফোয়ারা, অদ্ভুত নায়ক, দোকানপাট, বিখ্যাত চরিত্র, অন্ধকার স্থান, রাত-দিন ইত্যাদির বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছি। এগুলোকে আমার অংশ করে তুলছি।

এদের আলিঙ্গন করছি যে শহরে আমি থাকি তার চেয়ে যে জগৎ আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি, যে জগৎ আমার মাথায় আছে তা আমার কাছে বেশি বাসত্দব। আর এটা ঘটে তখন যখন রাস্তা, জিনিসপত্র, ভবনগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরম্ন করে, ভাব বিনিময় করতে থাকে আমার ভাবনার বাইরেও। যেন তারা আমার বই বা কল্পনার বাইরেও অস্তিত্বশীল। এই জগৎটা আমি তৈরি করেছি সূচের সাহায্যে কূপ খোড়ার মতো করে। এটাকেই অন্য কিছুর চেয়ে সত্য বলে মনে হয়।

বাবার মধ্যেও হয়তো লেখালেখি করার বছরগুলোতে একই ধরনের সুখ অনুভব করেছেন। তার সুটকেসে চোখ বোলাতে বোলাতে আমি ভাবি। এ ধরনের আগাম বিচার হয়তো ঠিক নয়। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি কখনোই নির্দেশ দিতেন না।

নিষেধাজ্ঞা, হম্বিতম্বি, শাস্তি দেয়ার মতো সাধারণ বাবা তিনি ছিলেন না। সব সময়ই আমাকে স্বাধীন থাকতে দিয়েছেন। সবসময়ই আমাকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। আমার বন্ধুদের থেকে আমার শৈশব আলাদা হয়ে গিয়েছিল কারণ বাবার দিক থেকে আমার কোনো ভয় ছিল না। আমি খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আমি লেখক হতে পেরেছি কারণ আমার বাবা তার যৌবনে লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন।

তার ব্যাপারে আমকে সহনশীল হতে হবে। হোটেল রম্নমে বসে তিনি যা লিখেছিলেন তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এগুলোই ছিল সুটকেস নিয়ে আশাপ্রদ চিন্তা। বাবা যেখানে রেখেছিলেন সেখানেই এখনো আছে সেটা। আমার সব ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে আমি কিছু পা-ুলিপি ও নোটবুক পড়েছি।

বাবা কি লিখেছিলেন? প্যারিসের হোটেল জানালা দিয়ে দেখা কিছু দৃশ্য আমি পুনরুদ্ধার করতে পারি। কিছু কবিতা, ধাধা, কিছু বিশ্লেষণ...। আমি লিখতে গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া লোকের মতো অনুভূতি হয়। যেন লোকটা দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটলো সেটাই মনে করতে চাইছে। আর একই সময়ে খুব বেশি মনে করার সম্ভাবনাটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আমি ছোটবেলায় দেখেছি, বাবা-মা ঝগড়া বেধে যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে যেতেন। কিন্তু শেষ পর্যনত্দ মৃতু্যময় নীরবতা নেমে আসতো। মুড পরিবর্তনের জন্য বাবা রেডিও অন করতেন। সঙ্গীত হয়তো তাকে ঝগড়ার কথা ভুলিয়ে দিতে পারতো। আমাকে কিছু সুন্দর শব্দের মাধ্যমে মুড পরিবর্তন করতে দিন।

আমি আশা করি সঙ্গীতের মতোই সক্ষম তারা। আপনারা জানেন, আমাদের_ লেখকদের প্রায়ই একটি প্রশ্ন করা হয়। খুবই পছন্দসই এক প্রশ্ন, কেন লেখেন? আমি লিখি। কারণ লেখার তীব্র প্রয়োজন আছে আমার। আমি লিখি কারণ সাধারণ লোকের মতো সাধারণ কাজ করতে পারি না আমি।

আমি লিখি কারণ আমি যেমন লিখি তেমন বই আমি পড়তে চাই। আমি লিখি কারণ আমি আপনাদের ওপর রাগ করেছি। সবার ওপর রাগ করেছি। আমি লিখি কারণ সারাদিন ঘরে বসে লিখতে ভালো লাগে। আমি লিখি কারণ বাসত্দবজীবনে আমি অংশ নিতে পারি একে পরিবর্তন করার মাধ্যমেই।

আমি লিখি, কারণ আমি অন্যদের, অন্য সবাইকে জানাতে চাই কি জীবন আমরা যাপন করি। টার্কিতে, ইস্তাম্বুলে কোন জীবনযাপন করে যেতে হচ্ছে আমাদের। আমি লিখি, কারণ আমি কাগজ, কলম ও কালির গন্ধ ভালোবাসি। আমি লিখি, কারণ অন্য কিছুর চাইতে আমি সাহিত্যে বিশ্বাস করি, উপন্যাসের শিল্পরূপে বিশ্বাস করি। আমি লিখি কারণ, এটা অভ্যাস, একটা আকাঙ্ক্ষা।

আমি লিখি কারণ আমি বিস্মৃত হতে ভয় পাই। আমি লিখি কারণ লেখা যে গর্ব ও উপকার বয়ে আনে তা আমি ভালোবাসি। আমি একা হওয়ার জন্য লিখি। আমি সম্ভব এই কারণে লিখি যে এর মাধ্যমে আমি বুঝতে পারবো কেন আমি আপনাদের ওপর, আপনাদের সবার ওপর এতো বেশি এতো বেশি রাগান্বিত। আমি লিখি, কারণ নিজের লেখা পড়াতে ভালো লাগে।

আমি লিখি, কারণ একদা আমি একটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধ এক পৃষ্ঠা লিখেছিলাম, আমি সেটি শেষ করতে চাই। আমি লিখি, কারণ সবাই চায় আমি লিখি। আমি লিখি কারণ লাইব্রেরির অমরতা নিয়ে আমার শিশুসুলভ বিশ্বাস আছে। আর একইভাবে আমার বইও সেলফে থাকে। আমি লিখি কারণ জীবনের সব সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে শব্দে পরিণত করায় উত্তেজনা আছে।

আমি গল্প বলার জন্য নয়, গল্প গেথে তোলার জন্য লিখি। আমি ওই নিষেধাজ্ঞা থেকে পলায়ন করতে লিখি যার স্বপ্ন আপনি দেখতে পারবেন কিন্তু সেখানে যেতে পারবেন না। সেখানে যাওয়া আমি রুখতে পারি না। আমি লিখি, কারণ কখনো আমি সুখী হতে পারিনি। আমি সুখী হওয়ার জন্য লিখি।

আমার অফিসে এসে সুটকেস রেখে যাওয়ার পর বাবা এক সপ্তাহ পর আবার এসেছিলেন। অন্য সময়ের মতোই একটা চকোলেট হাতে করে। তিনি ভুলে যেতেন যে আমার বয়স 48 বছর। অন্য সময়ের মতো তিনি হাসলেন ও আলাপ করলেন পরিবার, রাজনীতি ও জীবন নিয়ে। এক সময় বাবার দৃষ্টি পড়লো সুটকেস রেখে যাওয়া জায়গাটার দিকে।

তিনি খেয়াল করলেন ওটা অন্য জায়গায় সরিয়েছি আমি। পরস্পরের চোখে চোখ পড়লো আমাদের। একটা নীরবতা নেমে এলো। আমি বললাম না আমি সুটকেসটা খুলে কাগজগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। বরং অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম।

কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন। আমিও বুঝতে পারলাম তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনিও বুঝতে পারলেন তিনি যে বুঝেছেন এটা আমি বুঝতে পেরেছি। সবকিছু ঘটলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আমার বাবা ছিলেন সুখী ও সহজ একজন মানুষ।

নিজের ওপর আস্থা ছিল তার। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বরাবরের মতো একটা হাসি দিলেন। আর বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগ পর্যনত্দ তিনি সেইসব মধুর কথাই আওড়ে যেতে থাকলেন বাবা হিসেবে প্রায়ই যে কথাগুলো বলতেন তিনি। বরাবরের মতো তিনি আনন্দিত ভঙ্গিতে, থোড়াই কেয়ার ভঙ্গিতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি অনুভব করলাম এক ধরনের আনন্দের অনুভূতি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে।

এটা সেই চিনত্দা যে, আমি হয়তো তার মতো সুখের জীবন কাটাইনি। কিন্তু আমি লেখায় আত্মসমর্পণ করেছি। তুমি তা বুঝতে পারছো। বাবা যে মূল্যটা দিয়েছেন তা ভেবেই আমি লজ্জিত হয়েছিলাম। সব মানুষের মধ্যে আমার বাবা কখনোই আমার বেদনার কারণ হননি।

আমাকে স্বাধীন রেখে চলে গিয়েছিলেন। এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, লেখা ও সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের কেন্দ্রীয় অপূর্ণতার সম্পর্ক থাকে। সম্পর্ক থাকে আমাদের সুখ ও অপরাধবোধের। কিন্তু গল্পের আরেকটা বিষয় আমার মধ্যে ওইদিন সম্পর্কে একটা অপরাধ বোধ তৈরি করে। বাবা সুটকেসটা আমাকে দেয়ার 23 বছর আগে আমি ঔপন্যাসিক হওয়ার সিদ্ধানত্দ নিয়েছিলাম।

22 বছর বয়সে আমি লিখতে শুরম্ন করেছিলাম। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে ঘরবন্দি করে আমি আমার প্রথম উপন্যাস কেভদেত বে অ্যান্ড সন্স উপন্যাসটা শেষ করেছিলাম। কাপা কাপা হাতে টাইপ করা অপ্রকাশিত পা-ুলিপি বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তিনি যেন পড়েন আর তার ভাবনা আমাকে জানান। এটা শুধু এই কারণে নয় যে, তার পছন্দ ও মেধা নিয়ে আমার আস্থা ছিল।

তার মতামতের ভীষণ মূল্য ছিল আমার কাছে। কারণ তিনি মায়ের মতো আমার লেখালেখির বিরোধিতা করেননি। সে সময় বাবা কাছাকাছি ছিলেন না। অনেক দূরে গিয়েছিলেন। আমি অস্থিরভাবে তার আসার অপেক্ষা করেছি।

দুই সপ্তাহ পর তিনি ফিরলে আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম। বাবা কিছু না বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন তিনি লেখাটা খুব পছন্দ করেছেন। খানিকটা সময়ের জন্য আমরা একটা সচেতন নীরবতার মধ্যে মহান আবেগ অনুভব করেছিলাম। পরে যখন আমরা শানত্দ হয়ে আলাপ শুরম্ন করলাম বাবা তুমুল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নতুন উপন্যাস নিয়ে তার মুগ্ধতার কথা বলতে থাকলেন।

তিনি বললেন, আমি একদিন এমন এক পুরস্কার পাবো যা নিতে আমি আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি। তিনি আমার কাজের প্রশংসা করার জন্যই এ কথা বলেননি। অথবা শুধু পুরস্কারকে লক্ষ্য হিসেবে বেধে দিতে চাননি। অন্য টার্কিশ বাবাদের মতোই তিনি ছেলেকে সাহস ও সমর্থন দিতে চেয়েছিলেন। অন্যরা যেভাবে বলে, 'একদিন তুমি নিশ্চিত একজন পাশা হবে' সেভাবেই তিনি দেখা হলেই কথাগুলো বলতেন।

আমার বাবা মারা গিয়েছেন 2002-এর ডিসেম্বরে। আজ আমি সুইডিশ একাডেমির সামনে। সম্মানিত অতিথিরা আমাকে এই মহান পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। এই মহান সম্মান। আমি আশা করি তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন।

অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।