আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরহান পামুকের পিইএন বক্তৃতা : লেখালেখির স্বাধীনতা

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

যায়যায়দিনের আর্ট অ্যান্ড কালচার ম্যাগাজিনে গত 6 জুলাই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ওরহান পামুকের বক্তৃতাটি। ভূমিকা লিখেছিলেন সিঙ্গাপুরপ্রবাসী কবি সুমন রহমান। অনুবাদটিও করেছিলেন তিনি। তার অনুমতিক্রমে লেখাটি সামহোয়ার ইন ব্লগে পোস্ট করলাম।

সুমন রহমানের ইমেইল ঠিকানা : লেখকের স্বাধীনতা ও ওরহান পামুক 'তিরিশ হাজার কুর্দি আর এক মিলিয়ন আর্মেনিয়ানকে এই মাটিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, অথচ আমি ছাড়া কেউ এই নিয়ে মুখ খোলেননি। ' 2005 সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে সুইস এক ম্যাগাজিনে দেয়া ইন্টারভিউতে টার্কির বিখ্যাত লেখক ওরহান পামুক এ কথা বলেন। তার এ বক্তব্য টার্কির জাতীয়তাবাদীদের খেপিয়ে দেয়। তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। বছরের শেষদিকে অবশ্য দেশে ফিরে আসেন তিনি।

বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি মানুষের বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে চান। তিনি বলেন, 1915 সালে অটোম্যান-আর্মেনিয়ানদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা আজো টার্কির লোকজন জানে না। যেন এটা একটা টাবু। কিন্তু আমাদের অবশ্যই অতীত নিয়ে কথা বলতে পারা উচিত। এসব ঝাঁঝালো বক্তব্যের কারণে ওরহান পামুকের বিরম্নদ্ধে আইনি অভিযোগ আনা হয়েছিল।

ঘটনাটি এমন সময়ের যখন ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে টার্কির প্রবেশাধিকার নিয়ে জোর তর্ক চলছে। ওরহান পামুকের বাক স্বাধীনতা বিষয়ক বক্তব্য এবং সেটি নিয়ে টার্কির জাতীয়তাবাদীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এ বিতর্কটিকে নতুন করে উসকে দিয়েছিল। পিইএন-এর এ বছরের আর্থার মিলার ফ্রিডম টু রাইট স্মারক বক্তৃতার উদ্বোধনী ভাষণে ওরহান পামুক আবারো লেখকের বাক স্বাধীনতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন। বাক স্বাধীনতা কিংবা লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখকের স্বাধীনতা বিষয়ে ওরহান পামুক মূলত পশ্চিমেরই গ্রাহক। তিনি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে টার্কি (বা অন্য যে কোনো দেশ)-এর 'পশ্চিমিকরণ' প্রত্যাশা করেন এবং বাক স্বাধীনতার 'পশ্চিমি' ধরন বাসত্দবায়নের মাধ্যমেই এটা সম্ভব বলে মনে করেন।

মজার বিষয় হলো, তার পাশের দেশ ইরানের চলচ্চিত্রকাররা বিদ্যমান সেন্সরশিপের মধ্যেও দারম্নণ দারম্নণ সব ছবি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়ে চলেছেন। সেন্সরশিপ নিয়ে দৃশ্যত তাদের অনেকেরই কোনো অভিযোগ নেই। কড়া সেন্সরশিপ তাদের আরো সৃজনশীল এবং কৌশলী হতে সুযোগ করে দিয়েছে, এমনও বলেছেন তাদের কেউ কেউ। পামুকের মতে, এ ধরনের কৌশল আসলে আত্ম-অবমাননা এবং লজ্জার। ওরহান পামুক জন্মগ্রহণ করেন 1952 সালে।

1982 সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস 'কেভদেত বে অ্যান্ড হিজ সনস'। এরপর থেকে তার প্রতিটি উপন্যাসই কোনো না কোনো পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। তবে যে বইয়ের জন্য তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং নন্দিত হয়েছেন তার নাম ইস্তাম্বুল। এ সাহিত্যকর্মটির শ্রেণীবিচার দুঃসাধ্য, এমনও বলেছেন অনেকে। কাব্যমণ্ডিত এ রচনাটি একাধারে উপন্যাস, লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, ইস্তাম্বুল শহর নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ এবং লেখকের পারিবারিক ফটো অ্যালবাম, পশ্চিমি চিত্রশিল্পী এবং দেশি ফটোগ্রাফের একটি সংমিশ্রণ।

এ উপন্যাসে পামুক এক শহরের গল্প বলেন যে শহর স্মৃতির মধ্যে রয়েছে এবং প্রতিক্ষণেই পাঠককে মনে করিয়ে দেন-'এসব হচ্ছে পঞ্চাশোধর্্ব এক লেখকের শব্দাবলী যে তার বহু আগের বয়ঃসন্ধির আউলা ঝাউলা চিন্তাকে একটি আকার দিতে চেষ্টা করছে। ' তার পিতা-মাতার সমস্যাসঙ্কুল সম্পর্ক, দাদির গোয়ার্তুমি, ভাইয়ের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি সম্পর্ক, প্রথম যৌন উত্তেজনা এবং লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত-এভাবেই উপন্যাসটি এগোয়। টার্কি ভাষায় এক ধরনের অতীতকাল আছে যেটা ইংরেজি ভাষায় নেই। এ অতীতকালের রূপ ব্যবহার করে টার্কি লেখকরা গুজব বা উপকথার সঙ্গে অতীতের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার পার্থক্য করতে পারেন। পামুক বলেন, যখনই তিনি না দেখা স্বপ্ন, উপকথা কিংবা অতীত ঘটনা লিখতে চান তখন তিনি কালের এই রূপ ব্যবহার করেন।

ইস্তাম্বুল উপন্যাসটিতে মূলত অতীতের এ রূপটিই কাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর তার স্বর বাসত্দবতা এবং তার কল্পনার বাসত্দবতার মধ্যে পেন্ডুলামের মতো দুলে দুলে গেছে সারা উপন্যাসে। এ উপন্যাসে তিনি উপহার দিয়েছেন আশ্চর্য এক বিষণ্নতা। ওরহান পামুক লেখকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তার মতে, স্বাধীনতা লেখক এবং মানুষের মর্যাদা বোধের পূর্বশর্ত।

এ বিষয়ে তার জোর বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে পিইএন আর্থার মিলার ফ্রিডম টু রাইট স্মারক বক্তৃতায়। তিন বছর নিউ ইয়র্ক ছিলেন। তাছাড়া জীবনের বাদবাকি সময় ওরহান পামুক কাটিয়েছেন ইসত্দাম্বুলেই। অন্য কোনো কাজ না করে ত্রিশ বছর ধরে তিনি উপন্যাসই লিখছেন। পামুকের মতে যেহেতু তার সতীর্থ এবং সহগামী অনেক লেখকই স্বাধীন নন, ফলে শেষপর্যনত্দ কোনো লেখকই স্বাধীন নন।

পিইএন আর্থার মিলার ফ্রিডম টু রাইট স্মারক বক্তৃতামালার উদ্বোধনী আলাপ হিসেবে 2006-এর 25 এপ্রিল তারিখে ওরহান পামুক-এর ভাষণ লেখালেখির স্বাধীনতা ওরহান পামুক 1985 সালের মার্চ মাসে আর্থার মিলার এবং হ্যারল্ড পিন্টার একসঙ্গে ইসত্দাম্বুল সফরে আসেন। ওই সময়ে তারাই সম্ভবত পৃথিবীর নাট্যাঙ্গনে সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ দুটি নাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নাটক বা সাহিত্যিক প্রয়োজনে ইসত্দাম্বুল আসেননি তারা। সে সময়ে টার্কিতে বাক-স্বাধীনতার ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন চলছিল এবং পরিণামে অনেক লেখক-শিল্পীকে জেলে যেতে হয়েছিল। তারা এসেছিলেন সেই প্রেক্ষিতে।

এর আগে, 1980 সালে টার্কিতে একটি কু্য হয় এবং অনেক লেখক-সাহিত্যিককে জেলের ঘানি টানতে হয়। বরাবরের মতো লেখকরাই এসব ঘটনার সবচেয়ে মর্মন্তুদ শিকার হয়ে থাকেন। আমি যখন ওই সময়ের পত্রিকার পাতাগুলো উল্টাই, একটা ছবি আমার মনে গেঁথে থাকে : লোকজন আদালতে বসে আছে, পুলিশ-বেষ্টিত, মাথা কামানো, মামলা যেভাবে আগাচ্ছে তাতে তারা ব্যথিত ক্রুদ্ধ। তাদের মধ্যেও অনেক লেখক ছিলেন এবং মিলার-পিন্টার ইসত্দাম্বুলে এসেছিলেন সেসব লেখকের পরিবারবর্গের সঙ্গে দেখা করার জন্য, সহায়তা করার জন্য, তাদের ভোগানত্দির দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। পিইএন আর হেলসিঙ্কি ওয়াচ কমিটি যৌথভাবে তাদের এ সফরের আয়োজন করে।

তাদের রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে যাই আমি, যেহেতু আমার এবং আমার এক বন্ধুর তাদের গাইড হওয়ার কথা। আমাকে এ কাজের প্রসত্দাব দেয়া হয়েছিল এজন্য না যে, আমি সে সময়ে খুব রাজনীতি করতাম। বরং প্রসত্দাব এসেছিল এজন্য যে, আমি ছিলাম এমন একজন ঔপন্যাসিক যে আবার ইংরেজি ভালো জানে। আমি এ প্রসত্দাবে সানন্দে রাজি হয়ে যাই, শুধু আমার দুর্ভাগা লেখকবন্ধুদের সাহায্য করা হবে এটা ভেবে নয়, বরং এ উছিলায় যে, দুই মহৎ লেখকের সঙ্গে কিছু সময়ও কাটানো যাবে। আমরা তাদের নিয়ে গিয়েছি ছোট ছোট এবং প্রায় লালবাতি-জ্বলা প্রকাশনালয়গুলিতে, সংবাদপত্রের আউলা ঝাউলা অফিসগুলিতে, দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে এমনসব ছোট কাগজের ধুলামলিন আসত্দানায়।

আমরা গিয়েছি এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি, এই রেসত্দোরাঁ থেকে সেই রেসত্দোরাঁয়, দুর্ভাগা লেখক আর তাদের পরিবারের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। এর আগ পর্যনত্দ আমি রাজনীতির ত্রিসীমানায় নিজে যেচে পা দেই নাই কখনো। কিন্তু যখনই নিষ্ঠুরতা, দমন-পীড়ন আর সোজাসাপ্টা শয়তানির রক্ত হিম করা ফিরিসত্দিগুলি শুনলাম, খানিক গস্নানি বোধ নিয়েই এ জগতে এসে শামিল হলাম। আবার একই সময়ে এ ডামাডোল থেকে নিজকে বাঁচিয়ে চলার বিপরীত একটা দায় অনুভব করতে লাগলাম, সব কিছু বাদ দিয়ে সুন্দর সুন্দর সব উপন্যাস লিখবার দায়। মিলার আর পিন্টারকে যখন ইসত্দাম্বুলের ব্যসত্দ রাসত্দাগুলো দিয়ে এখানে-ওখানে নিয়ে যাচ্ছিলাম, মনে পড়ছে, আমরা আলাপ করছিলাম ফুটপাথের হকারদের নিয়ে, ঘোড়াগাড়ি বিষয়ে, সিনেমার পোস্টার দেখে দেখে এবং স্কার্ফ পরা ও স্কার্ফ ছাড়া উভয় ধরনের মহিলাদের নিয়ে।

পশ্চিমি পর্যবেৰকের জন্য এসব দৃশ্য এবং আলাপ বেশ মনোহর। কিন্তু একটি দৃশ্য পরিষ্কার মনে আছে, ইসত্দাম্বুলের হিলটন হোটেলের লম্বা করিডোরের এক মাথায় একদিন আমি ও আমার অন্য গাইড বন্ধুটি কি একটা ৰোভের বিষয় নিয়ে ফিসফাস করছিলাম আর অন্য মাথায় দেখা যাচ্ছিলো মিলার আর পিন্টারের ছায়ামূর্তি। নিজেদের মধ্যে তারাও যেন কি বিষয় নিয়ে ফিসফাস করছিলেন। সাধারণ এ দৃশ্যটি আমার বিৰুব্ধ হৃদয়ে চিরদিন গেঁথে থাকবে। এ দৃশ্যটিই বলে দেয় আমাদের আর তাদের জটিল ইতিহাস আর অতীতের মধ্যে পার্থক্য কতো যোজন যোজন! আবার এও বলে দেয়, শত ব্যবধান থাকলেও লেখকদের মধ্যে কোনো কোনো ইসু্যতে ঐকমত্য তৈরি হওয়াও সম্ভব।

এখান থেকে ওখানে, এ ঘর থেকে সে ঘরে, আমরা যখন সব দুর্ভাগা এবং চেইন স্মোকার লোকজনের সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলাম, আমার তখন গর্ব আর লজ্জার একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। কখনো সেটা ছিল প্রকাশ্য, কখনো আবার আমি সেটা অন্য লোকজনের হাবভাব থেকে অাঁচ করছিলাম। লেখক, চিনত্দক কিংবা সাংবাদিক, যাদের সঙ্গেই আমরা কথা বলছিলাম, সে সময়ে তাদের প্রায় সবাই নিজেদের বামপন্থী মনে করতো। ফলে পশ্চিমি উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার যে ধারণাটি আছে, এর ওপর তাদের আস্থা থাকার সঙ্গত কারণ ছিল। বিশ বছর পর, আজ দুঃখের সঙ্গে দেখছি যে সেই মানুষজনের অর্ধেকই পশ্চিমিকরণ এবং গণতন্ত্রায়ণের বিপরীতে নিজেদের জাতীয়তাবাদী হিসেবে গড়ে তুলছে।

গাইড হিসেবে আমার সে অভিজ্ঞতা, পরবর্তী জীবনের আরো নানা অভিজ্ঞতার মতোই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং এ সুযোগে আমি সেই শিৰার আলোকে কিছু কথা বলতে চাই। যে দেশই হোক, চিনত্দা ও প্রকাশভঙ্গির স্বাধীনতা একটি সর্বজনীন মানবাধিকার। এ স্বাধীনতার চাহিদা আধুনিক মানুষের কাছে প্রায় রম্নটি-পানির চাহিদার মতোই। জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্ট, নৈতিক সংবেদনশীলতা বা বাণিজ্যিক/সামরিক অজুহাতে তাকে খর্ব করা কখনোই উচিত নয়। পশ্চিমি দুনিয়ার বাইরে পৃথিবীর বেশির ভাগ রাষ্ট্রে আজো লজ্জাজনক গরিবি বিদ্যমান, আর সেটা তাদের বাক স্বাধীনতা না থাকার কারণেই।

গরিবি আর রাষ্ট্রের নিষ্পেষণ থেকে বাঁচতে গিয়ে গরিব দেশের যেসব নাগরিক পশ্চিমে অভিবাসিত হন, আমরা দেখেছি সেখানে গিয়েও তারা ধনী রাষ্ট্রের বিরাজমান বর্ণবাদের শিকার হন। যারা অভিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের ধর্ম, জাতিসত্তা এবং সংস্কৃতির অজুহাতে নাজেহাল করে, তাদের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে আমাদের। কিন্তু সংখ্যালঘুর মানবতা বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করার অর্থ এই নয় যে, চিনত্দার স্বাধীনতার ব্যাপারেও আমরা তাদের মতকে সমর্থন করবো। ধর্মীয় বা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার অধিকারকে সম্মান করার অজুহাতে কখনোই তাদের কথা বলার অধিকারকে খর্ব করা যায় না। আমরা লেখকরা যাতে কখনোই এ বিষয়ে অনত্দত দোনোমনো না হই, যতোই উস্কানি আসুক না কেন।

আমাদের কারো কারো পশ্চিম বিষয়ে শ্রেয়োতর বোঝাপড়া থাকতে পারে, কারো থাকতে পারে পুবের ব্যাপারে বেশি অনুরাগ, কেউ কেউ আবার আমার মতো, দুই জগতেই হৃদয়কে সমানভাবে খোলা রাখতে চাই, দুয়ের মধ্যকার কৃত্রিম বিভাজন ভুলে গিয়ে। পরিষ্কার, খোলাখুলি এবং শক্তপোক্তভাবে নিজের রাজনীতি প্রকাশের ব্যাপারে সবসময়ই আমার মধ্যে দ্বিধা কাজ করে, আমি নানান ঘুরপথ ধরি, যেন-বা যা বলছি সেসব পুরোপুরি সত্য নয়। সেটা আসলে এজন্য যে, আমি কখনোই একক কোনো দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিজের চিনত্দাকে বন্ধ করে ফেলতে পারি না। আমি একজন ঔপন্যাসিক, এমন ঔপন্যাসিক যে তার সৃষ্ট সব চরিত্রের পাশে থাকতে চায়, বিশেষত খারাপ চরিত্রগুলির পাশে। আমি এমন এক দুনিয়ায় বাস করি যেখানে নির্যাতিত মানুষ অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে নিজেই নির্যাতনকারী হয়ে যায়।

বস্তুজগৎ এবং মানুষের বিদ্যমান চরিত্রের ওপরে শক্ত ঈমান রাখা কতো কঠিন জানি আমি। এও জানি, অধিকাংশ লোকের চিনত্দার মধ্যেই পরস্পর বিরোধিতা থাকে। লোকজন সারাৰণ নিজের মনের সঙ্গেই এক বৈপরীত্যে লিপ্ত আছে-এ অনন্য আধুনিক শর্তটির মধ্যেই উপন্যাস লিখবার আনন্দ নিহিত আছে। আমাদের আধুনিক মন এতো দ্বন্দ্বময় এবং পিচ্ছিল বলেই এখানে বাক স্বাধীনতা এতো দরকারি। এটা দরকারি নিজেদের ঠিকঠাক বোঝার জন্য, আমাদের ছায়াচ্ছন্ন এবং পরস্পরবিরোধী ভিতর-চিনত্দাগুলো পড়বার জন্য এবং সেই গর্ব আর লজ্জার মানে বোঝার জন্য যার কথা আমি একটু আগে বলেছি।

বিশ বছর আগে মিলার আর পিন্টারের সঙ্গে ইসত্দাম্বুলের রাসত্দায় রাসত্দায় ঘুরতে গিয়ে আমি যে গর্ব আর লজ্জার সামনাসামনি হয়েছিলাম, সেই আলোকে এবার আরেকটা গল্প করি। তাদের সফরের বছর দশেকের মধ্যেই এমন কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটতে লাগলো যার প্রেৰিতে বাক স্বাধীনতা নিয়ে আমি একের পর এক বিবৃতি দিলাম, যার সঙ্গে আমার উপন্যাসের কোনো সম্বন্ধ নেই। ঠিক এমনি এক সময়ে জাতিসংঘের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা করতে গিয়ে জনৈক ভারতীয় ভদ্রলোক লেখক ইসত্দাম্বুলে আসেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। বরাবরের মতো আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম সেই হিলটন হোটেলেই। টেবিলে বসতে না বসতেই সেই ভারতীয় লেখক আমাকে এমন এক প্রশ্ন করলেন যার রেশ আমার মনে এখনো আছে।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'মি. পামুক, আপনার দেশে যা কিছু ঘটছে সেগুলো আপনার উপন্যাসের বিষয় হয়ে সেভাবে আসছে না, সেটা কি আইনি নিষেধাজ্ঞা আছে বলে?' এ প্রশ্নের পর একটি লম্বা নীরবতা, আমি ভাবতে লাগলাম। তখন আমি যেন সেই দসত্দয়েভস্কি স্টাইলের আত্মজিজ্ঞাসার সামনাসামনি। ভদ্রলোক পরিষ্কার যা বোঝাতে চাইলেন তা হলো, যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা, আইনি প্রতিবন্ধকতা এবং দমন-পীড়ন নীতির হম্বিতম্বিতে আমার দেশের কি কি জিনিস না বলা হয়ে থাকলো? তার বলার ভঙ্গি মার্জিত হবার কারণে আমি সেই প্রশ্নটিকে আৰরিক অর্থে নিই। এখনকার তুলনায় দশ বছর আগের টার্কিতে লেখালেখির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং রাষ্ট্রীয় দমনকৌশল অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। কিন্তু আমি যখন এগুলো একে একে নিরিখ করে দেখছিলাম, দেখলাম এদের কোনোটাকেই আমার নিজের উপন্যাসে বিবৃত করার ইচ্ছা আমার নেই।

কিন্তু আমি যদি তাকে বলি যে, 'এসব বিধিনিষেধের কোনোটাকেই আমার উপন্যাসে নিয়ে আসার ইচ্ছা নেই, যেহেতু তাদের বিষয়ে প্রকাশ্য আলাপ করতে আমি সমর্থ'-তাহলে তাকে হয়তো ভুল ধারণাই দেয়া হবে। কারণ ইতিমধ্যে আমি আমার উপন্যাসের বাইরে এসব বিপজ্জনক ইসু্য নিয়ে প্রকাশ্য আলাপে নিয়োজিত আছি। তাছাড়া নিষিদ্ধ বলেই এসব বিষয়কে উপন্যাসে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লেখার পৰপাতী আমি নই। ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাবে এসবই আমি ভাবছিলাম এবং একসময় আমার নীরবতার জন্য লজ্জা পেলাম। শেষে বাক স্বাধীনতায় আমার আস্থা পুনর্ব্যক্ত করলাম ওই ভদ্রলোকের কাছে।

বললাম, বাক স্বাধীনতা মানুষের স্বাভাবিক মর্যাদা বোধের ব্যাপার। আমি এমন অনেক লেখককে ব্যক্তিগতভাবে জানি যারা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন এজন্য যে, বিষয়টি নিষিদ্ধ। নিজেকেও আমি ভিন্ন কিছু ভাবি না। যেহেতু আমার সতীর্থ এবং সহগামী অন্যান্য লেখক স্বাধীন নন, ফলে আসলে সর্বতোভাবে কোনো লেখকই স্বাধীন নন। এটাই পিইএন এবং সারা বিশ্বের লেখকদের মধ্যে ঐক্য এবং পারস্পরিক সহমর্মিতার জায়গা।

কোনো কোনো সময়ে আমার বন্ধুরা আমাকে বা অন্য কাউকে মোৰমভাবেই বলে যেমন, 'তোমার বিষয়টি সেভাবে লেখা উচিত হয়নি। তুমি যদি বিষয়টিকে একটু ঘুরিয়ে রেখে-ঢেকে লেখো তাহলে এর মধ্যে আপত্তিকর কিছু কেউ খুঁজে পাবে না এবং এতে করে তোমারও কোনো সমস্যা হবে না। ' কিন্তু একটি নিপীড়নমূলক সংস্কৃতির মধ্যে কোনো লেখা লিখতে গিয়ে শব্দটব্দ বদলে সবার আদরণীয় করে লেখা-যেন কাস্টমস গলিয়ে অবৈধ পণ্য চোরাচালান। এটা লজ্জার এবং অবমাননার। পিইএন ফেস্টিভাল-এর এ বছরের থিম হচ্ছে, যুক্তি এবং বিশ্বাস।

আমি এতো কাহিনীর অবতারণা করলাম শুধু একক এক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।