আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুমের সাতকাহন

মুক্ত করো ভয়, সত্য পথে জীবন গড়ো, নিজেরে করো জয় ।

এক কি দু'দিনের কথা নয়, ব্যাপারটা ঘটে চলেছে প্রায় মাস তিনেক হলো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস আর লাইব্রেরি করে করে হয়রান হয়ে গেলেও এতটুকু বিশ্রাম নেই প্রতীকের জীবনে। বই-খাতা নামিয়েই দে ছুট ডাইনিঙে। নাকে মুখে কিছু গুঁজেই ছুটতে হয় তোপখানা।

পার্টটাইম চাকরিটার সময় শেষ না হতে হতেই আবার ছুটতে হয় টিউশনিতে। হলে যখন ফেরে তখন রাত 11 টা। ডাইনিঙে ঢুকে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া খাবারটাই খেয়ে নেয়। এরপর রাত 2 টা 3 টা পর্যন্ত চলে একটানা পড়াশোনা। ক্লান্তিতে শরীরটা যেন আর চলে না।

খাটে উঠে মশারি টানাবে সে শক্তিটুকুও নেই। সটান হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। একটু ঘুম চাই। কিন্তু ঘুম যে আসে না। প্রতীক বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে।

উঠে বসে আবার শোয়। লাভ হয় না কিছুই। একটু ঘুমের জন্য ও ছটফট করতে থাকে। 'ওহ গড, একটু ঘুম না হলে তো আমি পাগল হয়ে যাব। ' না, ঘুম ওর কষ্ট বোঝে না।

দু'চোখে ঘুম না এলেও চোখ বন্ধ করেই বিছানায় পড়ে থাকে প্রতীক। প্রতিদিনের মতই শেষ হয় আর একটি ঘুমহীন রাত। শুরু হয় গতকালের মতই আরও একটা দিন। দিন দিন পরিশ্রান্তির চরমে পেঁৗছে যাচ্ছে ছেলেটি। ইদানীং কাজের প্রতি আগের মত মনোযোগ নেই।

মাঝে মাঝেই ভুল হয়ে যাচ্ছে। আর দিন শেষে রাত আসা মানেই আতঙ্ক ঘিরে ধরা, আজ রাতেও তার ঘুম হবে না! তবে কী...হতাশায় ভেঙে পড়ে সে। পাশের বেডেই সাহেদ ঘুমায়। একই সাবজেক্টে প্রতীকের এক ইয়ার সিনিয়র। প্রথম থেকেই প্রতীকের ব্যাপারটা তার কাছে প্রেম সংক্রান্ত কোন সমস্যা মনে হয়েছিল।

ভেবেছিল এসব কেসে এমন ব্যাপার এক-আধটু হয়ই। কিন্তু প্রতীক যখন বলল, ব্যাপারটা মোটেও এধরনের কিছু নয় তখন সাহেদও একটু ভাবনায় পড়ল। সহজ সরল মনে সে প্রতীককে এক ভয়ংকর পরামর্শ দিয়ে বসল। 'তুমি স্লিপিং পিল খেয়ে দেখতে পারো। ' 'যে কোন উপায়েই হোক ঘুম চাই আমার।

' ঘুমের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে প্রতীক। সাহেদের পরামর্শ তার মনে ধরে। পাশের রুমের কনকের মাধ্যমে স্লিপিং পিলও পেয়ে যায়। প্রথম দিকে প্রতি রাতেই একটা করে পিল খেত সে। খুব ভাল কাজ না হওয়ায় ডোজ বাড়ায়।

এবার বেশ কাজ হয়। বহুদিন পর কাঙ্ক্ষিত ঘুম আসে চোখে। চোখে ঘুম এলেও ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায়। ভেবেছিল দু'একদিন খাওয়ার পর এমনিতেই ঘুম আসবে। কিন্তু না, পিল ছাড়া ঘুম আসে না ওর।

পিলের ডোজও বেড়ে যায়। কারণ প্রথম দিকের মত দু'একটা পিলে ঘুম আসে না এখন। দিন যাপনও একটু এলোমেলো হয়ে যায়। আগের মত সকালের ক্লাসগুলো করা হয় না। চাকরি এবং টিউশনিতেও কেমন যেন ছন্দ পতন শুরু হয়।

আগের প্রতীককে এই প্রতীকের সাথে মেলানো যায় না। আগের প্রতীকের কাছে ঘুম ছিল সোনার হরিণ। আর এখন? সারাদিন ওর চোখের পাতায় যেন ঘুম ঝুলে থাকে! দু'তিনটা নয়, প্রতি রাতে পাঁচটার কম পিল খেলে ঘুম হয় না ওর। পিল খাওয়া এখন ওর কাছে নেশার মত! রাতের পর রাত ঘুম না হওয়ার এমন সমস্যা প্রতীকের একার নয়। বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো এশিয়ায় ঘুম না হওয়ার সমস্যা আছে কয়েক মিলিয়ন মানুষের, ভাবা যায়! সে যাক।

ঘুম না হওয়ার এই সমস্যার একটি নাম আছে। ইনসমনিয়া (ওহংড়সহরধ), অর্থাৎ অনিদ্রা। এই অদ্ভুত রোগে ভুক্তভোগীদের বলা হয় উনি্নদ্র বা ইনসমনিয়াক (ওহংড়সহরধপ)। ঘুম না হওয়ার সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগে সিঙ্গাপুরের লোকেরা। এক তথ্যে জানা যায়_সিঙ্গাপুরে প্রতি 100 জনে 15 জন লোক অনিদ্রায় ভোগে।

কারও কারও মতে এই সংখ্যা আরও বেশি। আর পুরো এশিয়ায় অনিদ্রায় ভোগে প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক! ভালভাবে ঘুম না হওয়া কিংবা একেবারেই ঘুম না হওয়া দুটোই সমস্যা। ঘুম ভাল না হলে দিনের শুরুটা ভাল হয় না। সারাদিন শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে, কাজে ভাল করে মন বসে না, মেজাজটাও খিটখিটে থাকে। আর একেবারে ঘুম না হলে? বেশির ভাগেরই প্রতীকের মত অবস্থা হয়।

কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলে। তবে এরপরেও কথা আছে। অনিদ্রা অনেক সময় জীবনহানির মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনিদ্রা নিয়ে চালানো এক গবেষণা থেকে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে অনিদ্রা নিয়ে জাপানে চালানো এই গবেষণায় দেখা যায় যারা দিনে 8 ঘণ্টা ঘুমায় তাদের চেয়ে যারা দিনে 5 ঘণ্টা বা তারচেয়ে কম ঘুমায় তাদের হৃদরোগের সম্ভাবনা দ্বিগুণ।

সামপ্রতিক গবেষণায় আরও যে সব তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো_ঘুমহীনতা অনেক সময় ডায়াবেটিসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ওজনও বেড়ে যায়। আবার ছোট বাচ্চাদের মধ্যে যারা অনিদ্রায় ভোগে তাদের বেশির ভাগেরই শারীরিক গঠন বেঁটে হয়ে থাকে। কারণ যে হরমোনের প্রভাবে শরীর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা সেই হরমোনগুলোকে দমন করে রাখে। অনিদ্রা থেকে পরিত্রাণের জন্য অনেকেই প্রতীকের মত পিল সেবন পদ্ধতি বেছে নেন। আসলে পিল খেলে ঘুম হয়তো আসে তবে তা খুবই সাময়িক।

তবে অনেকেই যেটা বোঝেন না সেটা হচ্ছে পিল খেয়ে ঘুমের অভ্যাস করলে এক সময় এটা নেশার মত হয়ে যায়। তা হলে কী স্লিপিং পিল খাওয়া যাবে না? যাবে। তবে তা হতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ মতে। আসলে পিল খেয়ে অনিদ্রা দূর না করাই উচিত। এমন কিছু টিপস্ আছে যা পালন করতে পারলে অনিদ্রা তো দূর হয়ই, স্বাভাবিক ঘুমও ফিরে আসে।

কী সেই টিপস্? তা হলে আসুন জেনে নেওয়া যাক... ঠিক সময় বিছানায় যাওয়া অনেকেই আছেন, ছুটির দিন ছাড়া অন্যদিনগুলোতে একই সময়ে ঘুমাতে যান। ঘুম থেকে ওঠেনও সময় মেনে। তবে এই নিয়মের ছন্দ পতন ঘটে বন্ধের আগের রাতে। ভাবেন, কাল তো ছুটি, আজ একটু দেরি করেই ঘুমাই। অবশ্য পরের দিন ঘুমও ভাঙে দেরিতে।

কেউ কেউ আবার পুরো সপ্তাহের ঘুম পুষিয়ে নিতে ছুটির দিনটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেন। আসলে এভাবে কখনও স্বাভাবিক ঘুম হয় না, আবার অনিদ্রা ভাবও দূর হয় না। স্বাভাবিক ঘুম কিংবা ঘুমহীনতা দূর করবার জন্য প্রতিদিনই চাই একই নিয়মের ঘুম। অর্থাৎ প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে উঠা এবং একই সময়ে বিছানায় যাওয়া। বাদ দিন দিবা ঘুম যারা অধিকাংশ সময় বাসায় অবস্থান করেন তাদের বেশির ভাগই দুপুরের খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

এই ধরনের দিবা নিদ্রা স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এমনকী এই ধরনের ঘুম অনিদ্রারও কারণ সৃষ্টি করে। হঁ্যা, আপনার ঘুমে সমস্যা থাকলেও দিনে ঘুমতে যাবেন না। দিনের সামান্য ঘুমও রাতের ঘুমের সময় কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করে। ব্যায়াম এবং ব্যায়াম করুন ঘুমের জন্য চাই ক্লান্তি।

শরীর যত বেশি ক্লান্ত হবে, ঘুম তত দ্রুত আসবে। আর অফুরন্ত ক্লান্তির জন্য চাই ব্যায়াম। হঁ্যা, শরীরকে ক্লান্ত বানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় ব্যায়াম। জগিং, সাইকেল চালানো কিংবা সাঁতার কাটা যে কোন ভাবেই ব্যায়াম করা যাবে। সপ্তাহে তিনবার করে আধা ঘণ্টার জন্য ব্যায়াম করলে দারুণ ঘুম হয়।

ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন সব কিছুই নিয়মের চাকায় বন্দি। আর সামান্য হলেও নিয়মে হেরফের করা মানেই বিপত্তি ডেকে আনা। ঘুমের ব্যাপারটা মোটেও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই যখন তখন না ঘুমিয়ে, ঘুমের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নেওয়াই ভাল। কথায় আছে, মানুষ অভ্যাসের দাস।

ঘুমের এই নিয়মিত অভ্যাসটা যদি সত্যিই গড়ে ওঠে তা হলে ভাল ঘুমের জন্য আর হা-হুতাশ করতে হবে না। ঘুমের আগে যদি করা যায়... যদি সম্ভব হয় তা হলে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার আগে গোসল করে নেওয়া ভাল। তবে গোসল সেরেই বিছানায় উঠে পড়বেন না যেন। হালকা কিছু খেয়েও নিন। বিশেষ করে কলা বা হালকা গরম দুধ খাওয়া যেতে পারে।

কারণ কলা আর হালকা গরম দুধে থাকে এল-ট্রিপটোফ্যান নামক এক ধরনের প্রোটিন, যা মস্তিষ্কে ঘুমের আবেশ তৈরিতে সাহায্য করে! ভাল ঘুমের জন্য সঠিক জায়গা বাছাই যেখানে সেখানে শুয়ে পড়লেই কিন্তু ঘুম আসে না। ঘুমের জন্য চাই সঠিক রুম এবং বিছানা। মোটামুটিভাবে যে রুমটি শান্ত, নিরিবিলি ঘুমের জন্য সেই রুমটিই বেছে নেওয়া ভাল। তবে রুমটি কেবল শান্ত আর নিরিবিলি হলেই হবে না, বাতাস আসা যাওয়ার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। আর হঁ্যা, দিনের বেলায় না হলেও রাতে ঘুমানোর সময় শয়নকক্ষের জানালাটি হালকা খুলে রাখবেন।

ঘুমানোর সময় রুমটি যথাসম্ভব অন্ধকার রাখবার চেষ্টা করবেন। এবার বিছানার কথা। ঘুমানোর জন্য সঠিক জাজিম বা তোশকটিই বেছে নেবেন। বিছানায় পিঠ দিলেই পিঠের কষ্ট হয় এমন জাজিম বিছানার জন্য নির্বাচন করবেন না। না খেয়ে বিছানায় যাবেন না কবি বলেছেন 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়'।

হঁ্যা পেটে খিদে থাকলে মাথায় ছন্দ আসে না। সবকিছু কেমন এলোমেলো মনে হয়। সুতরাং একেবারে খালি পেটে বিছানায় যাবেন না। পেট ঠাণ্ডা, সব ঠাণ্ডা। তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে পেটের চাহিদাটা মিটিয়ে নিন।

ঘুমাতে যাওয়ার সময় কোন চিন্তা নয় এক ঢিলে দুই পাখি কেবল প্রবাদেই মারা যায়, বাস্তবে নয়; তেমনি এক সাথে কখনও দুই কাজ করা যায় না। কথাটা ঘুমের বেলাতে খুব প্রযোজ্য। চিন্তা আর ঘুম পাশাপাশি চলতে পারে না। যে কোন একটা করতে হবে। যেহেতু বিছানায় যাচ্ছেন তাই যে কোন প্রকারের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।

চমৎকার ঘুমের জন্য কিংবা অনিদ্রা দূর করবার জন্য এটা খুব জরুরি। ( সৌজন্যে ঃ প্রতীক রহমান )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।