আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উনিশ শ একাত্তরে দেশের একটি সাধারন ঘটনা, যা আমাদের পরিবারের অসাধারণ।



আমার বাপ-চাচারা ছিলেন সাতজন। ব্রিটিশ আমলে স্কুল ইন্সেপেক্টর আমার দাদা অত্যন্ত রাশভারী , রক্ষনশীল এবং অতি সৎ মুসলমান ছিলেন। বাপ-চাচারা আমার দাদার মতই কর্মজীবনে সততার ত্রুটি করেন নেই। তবে অতিরিক্ত শাসনের কারনে হয়তো কখনও কেউ তেমন প্রতিবাদী, উচ্ছলতা চরিত্র পায়নি। অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতিবাদ আমাদের প্রথম জেনারেশনের মধ্যে তেমন দেখা যায়নি।

এর ব্যতিক্রম ছিলেন আমার মেঝচাচা। উনি বাড়ির একঘেয়েমির মধ্যে অনেক সময়ই নতুন কিছু করতেন, কোন অন্যায় দেখলে উনি প্রতিবাদ করতেন। দাদার কথার উপরে কেউ কোন কথা বলতে সাহস না পেলেও মেঝচাচা অনেক সময় এগিয়ে যেতেন। বড় পরিবারের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অর্থিকভাবে অস্বচ্ছল সদস্যদের ব্যাপারে তিনি সব সময় খেয়াল রাখতেন। দেশের দক্ষিনাঞ্চলের ১৯৭০এর ভয়াবহ প্লাবনের সময় ঘরের প্রায় সবকিছু তিনি ত্রানের জন্য দিয়ে দেন।

আমার মেঝচাচার মতন মানুষ দেশে বিরল নয় অবশ্যই, কিন্তু আমাদের পরিবারে উনি ছিলেন ব্যতিক্রম। মেঝচাচা ৫০দশকের প্রথমদিকে এমএসসি ফাইনাল দেয়ার পরপরই পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে অফিসার পদে যোগ দিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। খুব সম্ভবত প্রায় ১৬বছর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে চাকরী করেন। পাকিস্তানিদের বৈষম্য খুবসম্ভত তার কাছে শেষের দিকে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে থাকাকালীন সময়ে চাচা স্বেচ্ছা অবসরে যান এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য তৎকালীন ওয়াপদাতে কাজ নেন।

৭ই মার্র্চের বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে নির্দেশের আলোকে প্রাক্তন সেনাবাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের সাথে আমার মেঝচাচা শহীদমিনারে এবং পরে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে শপথ নেন বাঙালীর স্বাধীনতা আদায়ের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে প্রস্তুত হবার। ৭১এ চাচা ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্ঝ পাওয়ার স্টেশনে কর্মরত। সেখানে স্থানীয় শ্রমিক কর্মচারীদের প্রথমিক সামরিক ট্রেনিং-এ সহায়তা করতে লাগলেন। এ পর্যায়ে পাকিস্তানী কর্মকর্তা এবং সেখানকার এক জেসিওএর সাথে তার বচসাও হয়। এরপর ২৫শে মার্চ ১৯৭১।

স্বাধীনতাকামী বিমানবহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা হিসাবে কর্মস্থলসহ প্রায় সারা দেশ তার জন্য বিপদজনক হয়ে পড়ে। তিনি তার দুইকন্যা আর স্ত্রী কে দেশে রেখে ভারতে পাড়ি দেবার মনস্থির করেন। যাবার পথে পৈতৃক বাড়িতে অসহায় অবস্থায় তার দুই ভাই (আমার ছোট দুই চাচা)এর একটা ব্যবস্থা করার জন্য বহু ক্লেশ স্বীকার করে প্রায় হেটে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কুষ্টিয়াতে পৌছেন। কুষ্টিয়া তখনো পাকিস্তানীদের দখলে আসেনি। তবে কুষ্টিয়া পতনের লক্ষ্যে চারিদিক দিয়ে সাড়াশি আক্রমন করার জন্য পাকিস্তানী আর্মি জড়ো হতে থাকে।

কুষ্টিয়ার প্রতি পাকিস্থানীদের আক্রোশ প্রবল ছিল কয়েকটি কারনে। কুষ্টিয়ার একটি গ্রামে (বৈদ্যনাথতলা) আনুষ্ঠানিক ভাবে মুজিবনগর সরকার ঘোষনা, মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়াকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্ত অঞ্চল হিসাবে রক্ষা করে এবং সামরিক অভিযানকালে তারা কুষ্টিয়াস্থ পাকিস্থানী বাহিনীর বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক সদস্যদের হত্যা করেছিল । এর সব কিছুই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী অবহিত ছিল। ফলে প্রচন্ড আক্রোশে প্রানী এবং সম্পদ সবকিছু ধ্বংস করতে করতে তারা শহরে প্রবেশ করে, যাকে বলে পোড়ামাটির পন্থা। ১৪ এবং ১৫ই এপ্রিল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তদারিকের শহরের সাধারন জনতা শহর ছেড়ে গ্রাম এবং ভারতের দিকে চলে যেতে থাকে এবং ১৬ই এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী প্রচন্ড ধ্বংসযজ্ঞ করতে করতে শহরের ঢুকতে শুরু করে।

আমার মেঝচাচা খুব সম্ভবত এপ্রিলের ১০/১২ তারিখে কুষ্টিয়াতে পৌছেন, তার পরিকল্পনা ছিল ছোট ভাই দুজনকে সাথে নিয়ে ভারতের পথে রওনা দিবেন অথবা ভাই দুজনকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে, তিনি পরিস্থিতি বুঝে পরে যাবেন। ১৬এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়া শহরের পতন হলো। পাক বাহিনী শহরে কারফিউ দিয়ে তাদের সাগরেদের নিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এই সময় খুব সম্ভবত আমার চাচা পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শান্ত বা কারফিউর বিরতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি তার পৈতৃক বাড়িতে বসে প্রতিবেশী এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ী ও অন্য একজন (সমবয়সী বন্ধুসম)এর সাথে দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত এবং সে সময়ের জন্য সাধারন। পাকিস্তানী সেনারা আমাদের বাড়িতে এসে পৌছায়, দরজায় লাথি মারার সাথে সাথে তিনি (আমার মেঝচাচা) দরজা খুলে দেন। হানাদাররা পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় তিনি নিজের পরিচয় দেন। পরিচয় পাওয়ার পর প্রাক্তন বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা হিসাবে ওরা নিশ্চয় ভেবেছিল ভাল শিকারই পাওয়া গেছে। তাকেসহ তার সঙ্গীদের (বৃদ্ধ ব্যবসায়ী ও বন্ধু) বাড়ির আঙ্গিনায় দাড় করিয়ে গুলি করে হানাদাররা।

আমার মেঝচাচার রক্তে রঞ্জিত হলো পৈতৃক ভিটা। চাচা এবং বৃদ্ধ ব্যবসায়ী শহীদ হলেন বন্ধুটি বেঁচে গেলেন (?) হানাদাররা বাড়িতে ঢুকে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের লাশ সমাধিস্ত করার সুযোগ আর হয়নি। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আমার চাচার সেই বন্ধুটির কাছ থেকে সেই সময়ের ঘটনার বিবরণ আমরা জানতে পারি। তিনি এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরা তৎকালীন সময়ে কুষ্টিয়ার জামাতে ইসলামীর প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, এখনও আছেন এডভোকেট সমৃদ্ধ এই পরিবারের একজন সদস্য তৎকালীন মালেক মন্ত্রীসভার মন্ত্রী হয়েছিল।

আমার চাচার হত্যাকালীন সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী, আশ্চর্যজনক বেঁচে যাওয়া সঙ্গীটি ঢাকায় এসে আমাদেকে সেই করুন সময়ের বর্ননা দেন। তার ভাষ্য মতে, তাদের তিন জনকে (সে, আমার চাচা আর বৃদ্ধ ব্যবসায়ী) বাড়ির আঙ্গিনায় দাড় করায় হানাদাররা। এ সময় আমার চাচার সাথে সেনাদলের কোন অফিসারের বাকবিতন্ডা চলছিল। এক পর্যায়ে তিন জনের দিকে খুব স্বল্প দুরত্বে গুলি ছোড়ে একাধিক বার, বেয়নেটও চার্জ করে তারা। কিন্তু এই জামাতী এডভোকেট বন্ধুটি সেই সন্ধিক্ষনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেয়ে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যায়।

পরবর্তীতে যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে সে নিজেকে দুটি লাশের পাশে আবিষ্কার করে এবং আগুনে প্রজ্জ্বলিত নির্জন বাড়ি থেকে সে অর্ধমৃত অবস্থায় পালিয়ে আসে। এসব ঘটনা যখন সে বর্ননা দিচ্ছিল তখন সদ্য বিধবা আমার চাচী লক্ষ্য করেন যে, তার মৃত স্বামীর ঘড়িটি জামাতী এডভোকেটির হাতে শোভা পাচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়, প্রচন্ড ক্ষমতা তখন তাদের তারপরও বিষয়টি তার গোচরে আনেন আমার বাবা নিতান্ত বাধ্য হয়ে। কারন এই স্মৃতি চিহ্নটি ছিল আমার চাচার পরিবারের জন্য মূল্যবান। তার (জামাতী এডভোকেট) ভাষ্য অনুযায়ী, স্মৃতিচিহ্ন হিসাবেই সে আমার চাচার লাশের হাত থেকে খুলে রেখেছিল।

যাহোক, পরে সে চাচার এই ঘড়িটি ফেরত দেয়। বেশ কিছুদিন পর আমাদের আর এক প্রতিবেশী (আমাদের বাড়ির নিকটস্থ বসবাসকারী) জানায় যে, ১৬ই এপ্রিল কুষ্টিয়া পতনের সময়, প্রচন্ড গন্ডগোলের মুহুর্তে কুষ্টিয়া শহর থেকে পালতে ব্যর্থ হয়ে শহরে থেকে যায়, ঐ ঘটনার মুহূর্তে সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে, বিশিষ্ট জামাতী এডভোকেটটি পাকিস্তানী সেনাদলকে সাথে নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকছে। যেখানে আমার মেঝচাচা এবং সেই বৃদ্ধ ব্যবসায়ী অপেক্ষা করছেন শহরের পরিস্থিতি শান্ত হবার।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.