আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাকস্বাধীনতা কাহাকে বলে ... উদাহরণসহ ব্যাখ্যা ...

আমার মনে হয় এই ব্লগ এর অধিকাংশ ব্লগারই বাকস্বাধীনতার অর্থ ঠিকভাবে বোঝেন না। বিশেষ করে আসিফের স্টিকি পোস্ট এর যে ধরনের মন্তব্য দেখছি তাতে এটা স্পষ্ট। সবাইকে দেখি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দাবি করতে যে তারা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু এই ব্লগের বিতর্কিত পোস্টগুলোতে যেসব মন্তব্য পড়ে তাতে মনে হয় এই টার্মটার আসল অর্থ খুব কম ব্লগারই সঠিকভাবে বোঝেন। আমার এমন মনে হবার কারনটা নিচে explain করছি।

আমি নিজে কঠোরভাবে বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও আমি মনে করি, বাকস্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ না জেনে তা সমর্থন করার চেয়ে এর প্রকৃত অর্থ জেনে এর বিরোধিতা করাটা অনেক ভালো, কারণ এতে অন্তত আপনার অবস্থানটা অন্যের কাছে সঠিকভাবে পরিষ্কার থাকছে। বাক এর অর্থ হচ্ছে কথা, এবং বাকস্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে কথা বলার স্বাধীনতা। সেটা কিছু নির্দিষ্ট কথা বলার স্বাধীনতা নয়, বরং যা খুশি ঝেভাবে খুশি বলার (কিনবা লেখার) স্বাধীনতা। সেই কথা কেউকে কোনভাবে আঘাত করলো কিনা বা করতে পারে কিনা, তার ওপর কিন্তু বাকস্বাধীনতা কোনরকম শর্ত আরোপ করে না। বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এর অর্থ হচ্ছে, একজন মানুষ তার যাই মতামত থাকুক না কেন, তা বলে কিনবা লিখে প্রকাশ করার অধিকার রাখেন।

এই মতামত আমার কিনবা আপনার মতে জঘন্য খারাপ হতে পারে কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। স্বাধীনতা স্বাধীনতাই। যদি স্বীকার করে নেন যে আমার বাকস্বাধীনতা আছে, এর অর্থ হচ্ছে, আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করার অধিকার রাখি, সেটা আপনার যতই অপছন্দ হোক না কেন। যেমন ধরুন আমার যদি মনে হয় রেপ করা ভালো, আমি তা বলার বা লিখার অধিকার রাখি, এবং তা বলাতে আমি আইনত অপরাধী হব না যদি আইনত আমার বাকস্বাধীনতা থেকে থাকে। যেহেতু আপনারও বাকস্বাধীনতা রয়েছে, আমার কথা আপনার জঘন্য মনে হলে, আপত্তিকর মনে হলে আপনিও তা বলে বা লিখে প্রকাশ করার অধিকার রাখেন।

কিন্তু আমার কথা শুনে আপনি আমাকে আক্রমন করতে পারেন না, কারণ সেটা বাকস্বাধীনতার মধ্যে পড়ে না। একইভাবে আপনার যদি আমাকে বলতে ইচ্ছা করে যে আমি একটা শুওর, বা আরো খারাপ কিছু, আপনিও তা বলার আইনগত অধিকার রাখেন। তা শুনে আমি আহত কিনবা রাগান্নিত হতে পারি, আপনাকে ঘৃনা করতে পারি, এবং এইসব প্রকাশও করতে পারি কিন্তু আপনাকে মারতে যেতে পারি না বা মারার আইনগত অধিকার রাখিনা। যা ইচ্ছা, যা খুশি, কিনবা যাই মনে হোক, সেটা অন্যকে যতই আঘাত করুক সেটা প্রকাশ করার অধিকারকেই বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলা হয়। খেয়াল করুন, এই অধিকার প্রকাশ করা পর্যন্তই।

যা খুশি বলা, আর যা খুশি করার মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা আশা করি বুঝতে পারছেন। যেমন ধরুন, বাকস্বাধীনতার কারণে আমি "খুন করা খুব ভালো কাজ" এই কথা বলার অধিকার রাখি, কিন্তু খুন করার অধিকার রাখি না। ঠিক তেমনি, কথার মাধ্যমে আপনাকে আঘাত বা আহত করার অধিকার আমি রাখি কিন্তু কোনো কাজের মাধ্যমে নয়, যেমন ধরুন অস্ত্র বা হাতের মাধ্যমে। আশা করি পার্থক্যটা বোঝাতে পেরেছি। মত প্রকাশ কেবল বলে বা লিখেই হতে পারে।

অন্য কোনভাবে নয়। যেমন ধরুন, আসিফের স্টিকিতে একজন লিখছেন, আসিফ যেমন মত প্রকাশ করেছেন, হামলাকারিরাও ছুরি চাপাতির সাহায্যে মত প্রকাশ করেছে। আসিফ যে তার মতামত কারো প্রতি অস্ত্রের সাহায্যে করেনি তা বোধহয় বলা বাহুল্য। কলম আর ছুরির মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে তা যদি বুঝতে পারেন, তাহলে বাকস্বাধীনতা এবং হামলা এর মাঝে পার্থক্যটাও ধরতে পারবেন। আসিফ কিন্তু কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করেনি, এবং একারণেই আসিফের ওপর যে হামলাটা হলো সেটা মানবতাবিরোধী কিন্তু আসিফের লেখাগুলো অন্তত বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কারো কাছে মানবতাবিরোধী নয়।

এই ব্লগে বিভিন্ন নাস্তিক পোস্টগুলোতে দেখি প্রায়ই অনেকে মন্তব্য করেন "বাকস্বাধীনতার নামে ইসলাম/নবী এর অবমাননা করা হচ্ছে" বা এই জাতীয় কথা। যারা এমন কথা লেখেন, উনারা বাকস্বাধীনতার অর্থটা বোধহয় ঠিকমত জানেননা। কেউ যদি বলে X এর নামে Y করা হচ্ছে, তার অর্থ দাড়ায় X এবং Y দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ, এবং X করার কথা বলে Y করা হচ্ছে। যেমন ধরুন যদি বলা হয়, কলেজে ক্লাস করার নাম করে প্রেম করে বেড়ানো হচ্ছে, এর মানে হলো, কলেজে ক্লাস করা এবং প্রেম করা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো কাজ, এবং প্রেম করাটা কোনভাবেই কলেজে ক্লাস করার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বাকস্বাধীনতার মানে হলো, শুধু ইসলাম কিনবা নবীকে নয়, যাকে খুশি যেই ধর্মকে খুশি বা যেই রাজনৈতিক দলকে খুশি অবমাননা করা, সমালোচনা করা কিনবা বিদ্রুপ করার অধিকার।

কাজেই আসিফ বাকস্বাধীনতার নামে ইসলাম/নবী এর অবমাননা করেনি, বরং ইসলাম/নবী এর অবমাননা করার মাধ্যমে নিজের বাকস্বাধীনতার চর্চা করেছে মাত্র এবং তাকে যারা অকথ্য গালিগালাজ করেছে তারাও তাদের বাকস্বাধীনতারই চর্চা করেছে কারণ তারা আসিফ সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। দুই পক্ষের কাউকেই আমি নৈতিকভাবে দোষী মনে করছিনা তবে যারা মুখে বলেন বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিন্তু আসিফকে কিনবা হুমায়ুন আজাদকে কপানোতে উচিত শিক্ষা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন, তাদেরকে হিপোক্রিট না ভেবে উপায় নেই, যদিও এসব মন্তব্য করার অধিকার ওনারা রাখেন, সেটাও বাকস্বাধীনতারই কারণে। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাকস্বাধীনতা বিষয়টাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকারগুলোর একটি হিসেবে দেখা হয়। সেসব দেশে যেমন ধর্মপালনের স্বাধীনতা রয়েছে তেমনি রয়েছে ধর্মকে অবমাননা বা ধর্মের বিরোধিতা করার অধিকার। আমার মনে হয় জাতি হিসেবে উন্নতি করতে হলে নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং আজকের উন্নত দেশগুলো বাপারটা ভালকরে বোঝে, অথচ আমরা এই কনসেপ্টটাই এখনো বুঝি না।

এইসব দেশে দেখা যায়, ফ্রিডম অফ রিলিজিওন যেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, অনুরূপ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ফ্রিডম অফ স্পিচ কে এবং যে যেই মতাদর্শেরই হোক না কেন, প্রত্যকেই অন্যের বাকস্বাধীনতাকে (এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে) রেসপেক্ট করছে, কেননা তাদের নিজেদের বাকস্বাধীনতার মুল্য তাদের কাছে অনেক। এই কারণেই উন্নত দেশে চরমভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারছে। এসব দেশে দেখা যায় ধার্মিকেরা যেমন ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে, তেমনি ধর্মবিরোধীরা ধর্মের সমালোচনা, বিদ্রুপ, সবই করছে কিন্তু তাতে করে কেউ কারো শত্রু হয়ে যাচ্ছে না, কেউ কাউকে কোপাতে আসছেনা, কাউকে মনের ভাব প্রকাশের অপরাধে জেলে ভরা হচ্ছে না, কাউকে মুরতাদ ঘোষণা করা হচ্ছেনা কিনবা কাউকে দেশ থেকে নির্বাসন দেয়াও হচ্ছেনা। কারণ তারা এইটুকু বোঝার মত ক্ষমতা অর্জন করেছে যে তার মতে ধর্ম ভালো হলেও, অন্য কারো মতে ধর্ম খারাপ হতেই পারে। তার যেমন অধিকার আছে ধর্মের প্রচার করার এবং ধর্মের বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করার, ধর্মবিরোধীদেরও অধিকার রয়েছে ধর্মের বিষয়ে তাদের মত প্রকাশ করার।

আমি মনে করি জাতি হিসেবে উন্নতি করতে হলে আমাদেরকেও এই পরমতসহিষ্ণুতা অর্জন করতে হবে। অন্তত অপরের কথাকে, সেটা যেই কথাই হোক না কেন সহ্য করার মানসিকতা তৈরী করা আমাদের খুবই দরকার। কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধুর সাথে আড্ডা হচ্ছিল, এবং একপর্যায় কোন প্রসঙ্গে যেন আমি বলেছিলাম "free speech must prevail"। তখন সে বলেছিল free speech না বরঞ্চ responsible speech must prevail. এটা অনেকেই মনে করেন। কিন্তু সমস্যা হলো ইটা absolutely enforce করবার কোনো উপায় নেই।

কারণ কোন কথাটা responsible আর কোনটা irresponsible সেটা তর্কসাপেক্ষ এবং মতনির্ভর। একেকজন একেকটাকে responsible বলবে, যেমন মুসলিমরা ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই তা irresponsible দাবি করবে, আবার লীগাররা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই তা irresponsible দাবি করবে। সেক্ষেত্রে যখন যারা ক্ষমতায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই তারা বলবে কথাটা irresponsible। কাজেই responsible speech কথাটা শুনতে ভালো লাগলেও সেটা enforce করাটা বাস্তবসম্মত নয়। পরিশেষে বলতে চাই, কোন এক বিখ্যাত মনীষী যেন বলেছিলেন : I may not agree with what you say but I will fight for your right to say it. বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হিসেবে আমি কথাটাকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে বলতে চাই, I may be hurt, insulted and/or angered by what you say and even dislike you for it, but I will still fight for your right to say it. ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.