আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রজাপতির অনুরোধে আমার গল্প

হেঁটে হেঁটে যতদূর চোখ যায়

ভিতর বাহির //এক// প্রতিদিন দুপুরবেলা মফিয মিয়াকে এখানে আসতেই হয়। শান্তিনগর মোড়। সারি সারি আকাশ ছোঁয়া দালান। ব্যস্ত রাস্তার দুপাশে অসংখ্য দোকান। ছুটে চলা বাস, সিএনজির সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যায় রিকশাওয়ালারা।

মফিয মিয়া তার ঠেলাগাড়ি নিয়ে অবশ্য কারো সাথে পাল্লা দিতে যায় না। চুপচাপ বসে থাকে সবচেয়ে বড় এপার্টমেন্টটার সামনে। সঙ্গী তার দশ বছরের ছেলে মতি। বাবাকে সে-ই ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত।

প্রায়ই বাবার সাথে সুর মিলিয়ে গায়, দিনে নবী মোস্তফা রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়, পাখি একটা বইসা ছিল গাছেরও ছায়ায়...। - আম্মা একটা টাকা দিয়া যান গো। মাঝবয়সি এক মহিলাকে বলল মফিয মিয়া। কথা শুনেই মহিলা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, এই ব্যাটা কি বললি? আম্মা মানে? কে তোর আম্মা? আপা বলতে পারিস না! - ভুল হয়ে গেছে আপা। থতমত খেয়ে যায় মফিয মিয়া।

একটা টাকা দ্যান গো আপা। মতি ঠিক বুঝতে পারে না যে কেন ঐ মহিলা তার বাবার উপর রাগ করল। সে তাই জিজ্ঞেস করল, বাবা উনি রাগ করল ক্যান? - কি জানি! যত্তসব পাগল ছাগল! আসলে বড়লোক তো এদের ভাব বোঝা দায়! যখন খুশি ইচ্ছা রাগ করে, যখন খুশি হাসে। - বাবা এরা খুব বড়লোক, না? - কি কয় ছ্যামড়ায়! বলদ নাকি? এরা বড়লোক মানে বিশাল বড়লোক। তা না হইলে এত বড় বাড়িতে থাকে ক্যামনে? কি সুন্দর গাড়িতে চড়ে।

কত রঙের ছোটবড় জামাকাপড় পরে। - এনাগো জীবনডা খুব মজার তাই না, বাবা? - হ রে বাপ খুব মজার। - ওনরা কি প্রতিদিন পোলাও মাংস খায়? - কি জানি খায় হয়ত! তোর কি খাইতে ইচ্ছা করতাছে? মতি হঁ্যাসূচক মাথা নাড়ে। ঠিক আছে চল। মফিয মিয়া তার ছেলেকে নিয়ে মালিবাগ মোড়ের দিকে পা বাড়ায়।

ওখানে ছোট্ট এক দোকানে 'দশ টাকা প্লেট বিরানি' পাওয়া যায়। মফিয মিয়া জানে কিভাবে এ বিরানি তৈরি করা হয়। তবে তার ছেলে জানে না যে, বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টের সমন্বিত রূপই এ বিরানি। //দুই// নয় তলার ফ্লাটে থাকে তিশারা। ফ্লাট নম্বর নাইন-বি।

তিন বেড, ডাইনিং, ড্রইং, কিচেন- বিশাল ফ্লাট। পাশে দক্ষিণের বারান্দা। প্রচুর আলো, প্রচুর বাতাস। কিন্তু এসব ভোগ করার লোক নেই বললেই চলে। এত বড় বাসায় বাসিন্দা মাত্র তিনজন, জামাল চৌধুরী, তার স্ত্রী মিথিলা চৌধুরী আর তাদের একমাত্র মেয়ে তিশা।

এছাড়া তিনজন কাজের বুয়া আছে। তিশা এবার ও-লেভেল দিয়েছে। দিনের অধিকাংশ সময়ই সে বাসাতে একা একা থাকে। তার বাবা জামাল চৌধুরীকে সে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে ব্যবসা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আজ ঢাকা তো কাল হংকং, পরশু জাপান, তার পরদিন বা অন্য কোথাও, তিনি ব্যবসার কাজে ছুটে বেড়ান।

পাশাপাশি মিথিলা চৌধুরীও কম যান না। তিনি একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। নানান সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত। সকালে মিটিং, বিকালে সেমিনার, রাতে কোন না কোন পার্টি যেন তার পিছনে লেগেই থাকে। - জীবনে তো অনেক সমাজসেবা করলে আর কত? বললেন জামাল চৌধুরী।

- মানে কি বলতে চাও তুমি? পাল্টা প্রশ্ন করলেন মিথিলা চৌধুরী। - মেয়েটা সারাদিন একা একা থাকে। ওকে একটু সময় দাও। - তুমি দিতে পার না? মেয়ে কি আমার একার নাকি? - এটা কোন ধরনের কথা! তুমি না ওর মা! - হঁ্যা, তুমি তো ওর বাবা। - আমি তো বিজেেনসে ব্যস্ত থাকি।

- আর আমি মনে হয় সারাদিন ঘোড়ার ঘাস কাটি? - এমন ইডিয়টের মত কথা বলছ কেন? - জামাল তুমি কিন্তু আমাকে গালি দিচ্ছ। ইউ রাসকেল...। শুরু হয়ে গেল। পাশের রুম থেকে তিশা সব শুনতে পাচ্ছিল। অবশ্য এভাবে সে প্রতিদিনই শুনতে পায়।

প্রতিদিন রাতেই একই ঘটনা। মাঝরাত...তর্কাতর্কি...গালাগালি...বাবার মদ গেলা...মায়ের চিৎকার...আর ভাল লাগে না। তিশা সিডি প্লেয়ারের ভলিয়ু্যম বাড়িয়ে দেয়। রুমের লাইট বন্ধ করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে। - হ্যালো ইফতি কি করছিস? - ছবি দেখছি।

- কি ছবি? - বলা যাবে না। - মানে? কি এমন ছবি দেখছিস যে আমাকে বলা যাবে না? - আরে বাবা তেমন কিছু না, মজা করলাম। আসলে গেম খেলতে ছিলাম, এনএফেস-সিক্স। তা তুই এত রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন? প্রায় একটা বাজে। - ঘুম আসে না।

কি করব? - একটা বিয়া কর তাইলেই ঘুম আসবে। - ধ্যাত! তিশা ফোন কেটে দেয়। তার ঘুমানো উচিৎ। কিন্তু ঘুম আসে না। তাই জেগে থাকে একা একা।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সে তো একা নয়। আকাশে এক ফালি চাঁদও তারমত জেগে আছে। তবে চাঁদটা না বড় বিষণ্ন! [প্রকাশ: বন্ধুসভা, দৈনিক প্রথম আলো, 28/06/06]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।