আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং শ্রমজীবি শিশুদের জন্য স্কুল- 'ঘাসফুল শিশু নিকেতন'।



'বদলে যাও, বদলে দাও' বা 'এক একটি পদক্ষেপ, বদলে দেবো বাংলাদেশ'; এই শ্লোগানগুলো মিডিয়ায় শুনতে শুনতে আর পত্রিকায় পড়তে পড়তে ক্লান্ত, যখন ভেবেই নিয়েছি এসব শুধু মিডিয়াতেই শোনা যায়, বাস্তব জীবনের সাথে যায়না, তখনই সৌভাগ্যক্রমে অনলাইনে পরিচয় হয়ে গেলো স্বপ্ন ফেরি করা একদল স্বপ্নবাজের সাথে। এরা শ্লোগান বলে গলা ব্যাথা করে না, এরা রাস্তায় নেমে কিছু একটা করে দেখানোয় বিশ্বাসী দল। অনলাইন থেকে ধীরে ধীরে পরিচয় অফলাইনে যেতে থাকে। জানতে থাকি ক'দিন আগেই 'জেগে ওঠো ময়মনসিংহ' নামের একটা অনলাইন গ্রুপের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হয়ে তারা বিতরণ করে এসেছেন শীতবস্ত্র। তার কিছুদিন পরেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণসংযোগ করে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দিলো এরা।

কিছুদিন পরপরই আমার ইভেন্ট রিকোয়েস্ট আসে। আমি ইগনোর করে যাই। এরকম কত রিকোয়েস্টই তো হররোজ আসে। ইভেন্টের দিন রাতে ছবি দেখে চোখ কপালে ওঠে আমার। ভাবি, এসব তো ঢাকায় সম্ভব, ময়মনসিংহেও? নিজেই আগ্রহী হই এরপর থেকে।

মাঝে মধ্যে উদ্যোক্তাদের সাথে যোগাযোগ হতে থাকে। এরপর একদিন হঠাৎ ইনবক্স, আমরা পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং শ্রমজীবি শিশুদের জন্য কিছু করার কথা ভাবছি। একটা স্কুল, সাথে স্বাস্থ্য সুবিধা, একটা মানসিক বিকাশ কেন্দ্র বা আরও কিছু। এজন্য একটা সভার আয়োজন করেছি। আমি যোগ দিবো কি-না? অ্যালেক্স সং বার্সেলোনাতে যোগ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, 'বার্সা ট্রেইন কামস্ִ ওয়ানস্ִ অ্যা লাইফ'।

এই ব্যাপারটা আমার জন্য সেরকমই ছিলো। দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। তারপরের স্কুল প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত ইতিহাস লেখার চেয়ে বরং উদ্যোক্তা এবং কার্যক্রম নিয়ে একটু লিখি। সম্পূর্ণ একটা অরাজনৈতিক, নির্দলীয়, কর্মঠ কিছু যুবকের প্রচেষ্টার ফল এই স্কুল, যাদের কেউ কেউ নিজেদের ক্যারিয়ারকেই সেকেন্ডারি মনে করে এই পথে এসেছে। দিন রাত দৌড়াদৌড়ি করে, বস্তিতে, হোটেলে, রেল লাইনে, সিএনজি স্ট্যান্ডে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করেছে সুবিধা বঞ্চিত শিশুগুলোকে।

কয়েকবার নিজেদের খরচে মিটিং করে, সবার মতামত নিয়ে মোটামুটি স্কুলের কার্যক্রম ইলেভেনথ আওয়ারে নিয়ে এসেছে। আই মিন, ইউ ক্যল দেম, 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পাবলিক'। হুম, খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি কয়েকটা যুবকের চোখে আসলেই দেশটাকে বদলে ফেলার স্বপ্ন। তারা শুধু ময়মনসিংহের কিছু সুবিধাবঞ্চিত, শ্রমজীবি শিশুর জন্যেই না, কয়েক বছরের মাঝে পুরো প্রোগ্রামটা দেশের আরও কয়েকটা শহরে ছড়িয়ে দিতে আশাবাদী। এবং এটুকু বিশ্বাস করি, তাদের দ্বারা সেটা সম্ভবও।

স্কুলটাতে যেহেতু কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য নেই, স্পন্সর নেই, সম্পূর্ণটাই একদল স্বপ্নবাজ তরুণের একটা স্বপ্নের প্রতিফলন এবং তাদের সবাইই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তাই ৫০ জন শিশুর সার্বিক দায়িত্ব নিতে, তাদের জন্যে একটা স্কুল ভাড়া নিতে, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী থাকলেও একজন নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ দিতে, তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি চিকিৎসা, বিনোদন এবং সার্বিক খরচ চালানোর জন্যে আপাত হিসেবে মাসিক ১৫০০০-২০০০০ টাকা প্রয়োজন। এবং সেটা মাত্র শ' খানেক মেম্বারের মাধ্যমে সম্ভবপর না। এটা চালাতে ন্যূনতম ৭০০-১০০০ মেম্বার প্রয়োজন যারা মাসে মাত্র একটা বার্গার-পিৎজা বা মাউন্টেন ডিউয়ের ৫০ টাকা বিক্যাশ করে দেবে ৫০ জন শিশুর জন্যে। মাত্র ৫০ টাকা বলে ভিক্ষা ভাববেন না। এই ৫০ টাকা ছাড়াও যারা ইতিমধ্যে আছেন তাদের দ্বারাই এই সংগঠনটা ঠিকই চলবে।

হয়তো ৫০ জনের জায়গায় ২০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর দায়িত্ব নিতে হবে তখন। কিন্তু, স্বপ্নটা আটকে থাকবে না। পুরো প্রক্রিয়াটায় কতৃপক্ষ খুব স্বচ্ছ। ইতিমধ্যেই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যে একটা গ্রুপ আছে (Click This Link) এবং সেখানে এই মাস থেকে ডাটাবেজের মাধ্যমে প্রতি মাসে কে কত অনুদান দিচ্ছেন বা দিবেন সেটা সংরক্ষিত হচ্ছে, হবে। ৫০ টাকা দিলে নামের পাশে ৫০ টাকা এবং মাসের নাম লেখা হচ্ছে।

কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে তার খতিয়ান দেওয়া হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটাই ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। গ্রুপটাতে তাদেরই অ্যাড করা হচ্ছে যারা সক্রিয় ভাবে ন্যূনতম ৫০ টাকা অনুদান করছেন। বাকিদের জন্যে আজকেই একটা পেজ খোলা হয়েছে 'পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং শ্রমজীবি শিশুদের জন্য ঘাসফুল শিশু নিকেতন'(Click This Link) নামে। আপনি চাইলেই এমন একটা স্কুল কিভাবে চলছে জানতে 'লাইক' দিয়ে রাখতে পারেন।

সেক্ষেত্রে আপনাকে অংশগ্রহণ না করলেও হবে, আপনার মূল্যবান ৫০ টাকা ব্যয় না করলেও হবে। সেটা একান্তই আপনার ইচ্ছা। কোথাও কোনো জোর জবরদোস্তি নেই। সম্পূর্ণটাই স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহনের ব্যাপার। স্কুলের নাম রাখা হয়েছে 'ঘাসফুল শিশু নিকেতন'।

আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের যেকোনো দিন স্কুলটা শুরু হচ্ছে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। স্কুলটার সাথে জড়িত এক বড় ভাইয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এসব দিয়ে আপনার লাভটা কী হবে? উনি বলেছিলেন, শেষ বয়সে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া স্কুলটা দেখিয়ে বলবো একটা দোকানে চা খেতে খেতে এই স্বপ্নটা আমরাই দেখেছিলাম! ওই কথাটা শোনার পর থেকে আমার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। ব্লগে-ফেসবুকে আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের লেখা কতজন পড়ে সে সংখ্যাটা আমার জানা। তার মাত্র ১০% মানুষও যদি একটা বার্গার বা একটা পিৎজার টাকা সেক্রিফাইস করতে পারে পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং শ্রমজীবি শিশুদের অক্ষর দানের নিমিত্তে, তাহলেই কৃতার্থ হবো।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.