আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রযত্নে শাপলাপুকুর

বিকট
* প্রিয় মুক্ত, শান্তর কাছে তোমার জন্যে সামান্য একটা উপহার পাঠালাম। সময়াভাবে দেখা করা হল না। ভালো থেকো। শাপলা আপা ক্ষুদে চিঠির মত করে লেখা এই মেসেজটা আমার সেলফোনে একটা জলতরঙ্গের মত শব্দ তুলে রোদ চড়ে বেড়ানো মার্চের সকালবেলার আধোঘুম আর বিভ্রান্তিকর স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবতায় নিয়ে এলো। শাপলা আপা।

মায়াবতী, যত্নশীলা, দেবীতমা বড়বোন, পাড়াতো সম্পর্কে। উনি কখন আসলেন আর কখন চলে গেলেন জানাই হলো না। অবশ্য জানলেই যে আমি ছুটে গিয়ে দেখা করে আসতাম তার সাথে দামী উপহার বগলদাবা করে, এমনটা না। তার হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে আমার কোন অভিযোগও নেই। তিনি এসেছিলেন, আমার কথা মনে করে উপহার সাথে এনেছিলেন, সেটাই বড় ব্যাপার।

শান্তর বাসাটা কোথাও তা আমার জানা নেই। সম্ভবত মোহাম্মদপুরের দিকে। দেখি, নাম্বারটা যোগাড় করে ফোন করতে হবে ওকে। মেসেজ এর রিপ্লাই দিতে আলসেমী লাগছিলো, শাপলা আপার নম্বরে কলব্যাক করতে গিয়ে দেখি নম্বরটা বন্ধ। ভালোই হয়েছে, প্রতিউত্তর কেন করিনি এমন তাগাদাও অনুভব করবো না ভেতর থেকে, টাকাও বেঁচে গেলো বেশ কিছু।

জাপানে ফোন করা মানেই পঁচিশ টাকা খরচ। এর চেয়ে বিনা খরচে স্মৃতির কলোনীতে ঘুরতে ঘুরতে শাপলা আপার বাসায় কড়া নাড়া যায়। ঠক ঠক! -কে রে? মুক্ত? কেমন আছিস? -শাপলা আপা, তোমরা নাকি জাপান চলে যাচ্ছো? -হ্যাঁ। আগামী মাসের ২৪ তারিখে। দেরী আছে এখনও।

জানি না কেন অভিমানে ঠোঁট ফুলে উঠেছিলো আমার সেইদিন। শাপলা আপা তার জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে যেখানে খুশি যেতে পারেন, তাকে বাধা দেবার অধিকার আমার ছিলো না, অভিমান করারও কোন কারণ নেই। তবে কারণ ছাড়াও তো কতকিছু হয়! আমাদের কলোনি থেকে কিছু দূরে, প্রাচীর টপকে এক আশ্চর্য স্বচ্ছপানির শাপলাপুকুরে যাওয়া যেতো। সেখানে দুপুরবেলায় সবাই যখন ভাতঘুমে ব্যস্ত, উচ্ছল কিশোরীর ঠোঁটের মত তিরতির করে কাঁপতো ফুলগুলো, পানির প্রবাহে ছিলো মেঘ আর হাওয়ার অবাধ আনুকূল্য আর সূর্যের রোশনাই। হঠাৎ করে সেই পুকুর কেন শুকিয়ে গেল কেউ বলতে পারে না।

আমারও জানতে ইচ্ছে করে নি। কারণ ছাড়া তো কতকিছুই হয়! -তুই যাবি নাকি আমাদের সাথে? তোর জন্যে একটা টিকেট কাটবো নাকি হু? শাপলা আপুর টিকিটের রসিকতা আমার কাছে টিটকিরির মত লাগে। আমি চলে যাবার উপক্রম করি। ক্ষীণস্বরে বলি 'যাই'। ক্ষীণস্বরে বলা শব্দেও হয়তোবা মনের মেঘ ঢুকে পড়ে সন্তর্পণে।

তারা গুমগুম শব্দ করে। তারা চোখকে বলে অশ্রূকে বৃষ্টির মত ঝরাতে। ঝুমবৃষ্টি না, টিপটিপ। বোঝা যায় কী যায় না, গায়ে লাগে কী লাগে না এমন। শাপলা আপু ঠিক ঠিক বুঝতে পারেন।

সংবেদনশীল কিশোর মনের মর্যাদাকে সম্মান করে তিনি এই চেপে রাখা কান্না না বোঝার ভান করেন। মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বাসায় বানানো সন্দেশ খাবার জন্যে ভেতরে ডাকেন। স্মৃতিসংলগ্ন হয়ে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। আবার বেজে ওঠে সেলফোন। -হ্যালো মুক্ত ভাই, আমি শান্ত বলছি।

-কী খবর শান্ত? কেমন আছো? -এইতো ভাই। শাপলা আপা আমার কাছে একটা প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিলো আপনার জন্যে। সময় করে নিয়ে যেয়েন। -আচ্ছা। তোমাদের বাসাটা যেন কোথায়? -মোহাম্মদপুরে।

রিং রোড দিয়ে ঢোকার পরে... সে আমাকে লোকেশন বুঝাতে থাকে। আমি তাকে বলি যে সময় করে একদিন নিশ্চয়ই নিয়ে আসবো উপহারগুলো, এবং সে সময়টা সন্নিকটেই। মিরপুর থেকে মোহাম্মদপুর, দূরত্বটা খুবই অল্প। ঢাকা থেকে জাপান অনেক বেশি দূর। আর তার থেকেও বেশি দূরত্বে শুকিয়ে যাওয়া সেই শাপলাপুকুর যা একসময় অলসদুপুরে ঘরপালানো কিশোরের রূপকথাকালের মায়ামঞ্চ ছিলো।

শাপলা আপা আর শাপলাপুকুর, কে আমাকে ডাক দিয়ে নিয়ে যায় নিভৃতের ধূসর জমিনে, অবহেলে পড়ে থাকা শরৎকালের ঝকঝকে রোদ্দুরে...। শাপলা আপারা জাপানে গেছেন প্রায় সাত বছর হলো। এরপর কয়েকবার এসেছিলেন, মনে পড়ে প্রথমবার ঢাকায় ফেরার কথা জানার পর আমার সেই উত্তেজনাকাল! তখন আমাদের মধ্যে চিঠি লেখার খুব চল ছিলো। দীর্ঘ সুললিত এক চিঠিতে শাপলা আপা আমাকে জানান তারা খুব শীঘ্রই ঢাকায় আসছেন, থাকবেনও অনেকদিন। প্রায় মাসখানেক।

আমার সে কী আনন্দ! কত পরিকল্পনা, কত জমে থাকা গল্প, কত দুরন্তপনার কথা ভেবে মিটমিটিয়ে হাসি! সেদিন আমি ছুটে গিয়েছিলাম সেই হাজা-মজা শাপলাপুকুরটায় অনেকদিন পরে কিছু সংস্কারকাজ করবো বলে। কচুরিপানাগুলো পরিষ্কার করা দরকার। শাপলা আপা এসে নিশ্চয়ই খুব রাগ করবেন পুকুরের এই অবস্থা দেখে? এখন অবশ্য শাপলা ফোটার মৌসুম না, তাতে কী! শাপলা আপা তো আসছেন! আমার সেলফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে কী মনে করে আবার শাপলা আপার নাম্বারটা রি-ডায়াল করি। নাহ নাম্বারটা মনে হয় পার্মানেন্টলিই বন্ধ। আর ব্যবহার করেন না হয়তো।

পঁচিশ টাকা বেঁচে যাওয়ার পরিতৃপ্তিতে হৃষ্টচিত্তে আমি আবারও স্মৃতিকলোনিতে নিখরচা ভ্রমণে বেরুই। শাপলা আপারা এসে গেছেন। বাসার কলিংবেল বাজাই আমি। সুন্দর একটা মেলোডি ভেসে বেড়ায় ঘর-বাহির জুড়ে। -কে? -আমি মুক্ত।

-ও, মুক্ত! কী খবর বাবা? আসো ভেতরে আসো। উফ বাসায় এত মানুষ। কোনটা ছেড়ে কোনটা সামলাই। এই শিউলি, শিউলি... খালাম্মা অকারণেই তারস্বরে কাজের মেয়েটিকে ডাকতে থাকেন। ততদিনে আমার বয়স বেড়েছে, বুঝতে শিখেছি নতুন অনেক কিছুই।

বুঝতে শিখেছি ভদ্রতার আড়ালে মানুষ কীভাবে প্রচ্ছন্ন অনিচ্ছা আর অবহেলা লুকিয়ে রাখে। ঘরভর্তি মানুষের সাথে আমাকে যোগ করতে তার অনীহা আমার কাছে স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। আমি নিঃশব্দে চলে আসি। শাপলা আপারা সেবার একমাস থাকলেও এই বাড়ি, ওই বাড়ি, চট্টগ্রামের শ্বশুরবাড়ি, কক্সবাজারে সমুদ্রযাপন, সৈয়দপুরে গ্রামের বাড়ি, তার বিয়ের দাওয়াত, ওর জন্মদিনের দাওয়াত ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিকতায় আমাকে খুব বেশি সময় দিতে পারেন নি। প্রবাসফেরতা এক মাস যে সাধারণ হিসেবের এক দিনের চেয়ে খুব বেশি না, বিশেষ করে দিনটা যদি হয় আকাঙ্খিত কোন প্রিয়জনের কাছ থেকে; এই বোধ আমাকে বিষাদী করে।

আমি উন্মনা হয়ে শাপলাপুকুরটার পাশে গিয়ে মাটির ঢেলা ছুড়ে ওটাকে আরো নোংরা করতে থাকি। এরপরে গত কয়েকবছরে শাপলা আপারা এসেছে, গিয়েছে তেমন খোঁজখবর, দেখা সাক্ষাৎ কিছুই হয় নি। ধীরে ধীরে আমার জীবনগ্রন্থ থেকে শাপলা আপা এবং শাপলাপুকুরের অধ্যায়গুলি বিবর্ণ হতে থাকে, বিদীর্ণ হতে থাকে পৃষ্ঠাগুলো। ছেড়া পৃষ্ঠাগুলো কোথাও রাখবার জায়গা না পেয়ে কোন শার্টের কোন পকেটে যে রেখেছি মনে পড়ে না। এইবারের ঢাকা সফরে হঠাৎ করে শাপলা আপা কী মনে করে আমার জন্যে উপহার রেখে গেলেন? প্রশ্নটা করে আমি নিজেই নিজেকে তিরস্কার করি।

দিবেন নাই বা কেনো? সব পৃষ্ঠা তো এখনও ছিড়ে যায় নি! আর যা কিছু ছিড়ে গেছে তা তো সযতনে আমি তুলেই রেখেছি শার্টের পকেটে। অনেক খুঁজতে হবে এই যা। * শান্ত আমাকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে প্যাকেটটা নিয়ে যাবার জন্যে। আমি সময় ও সুযোগ এক করতে পারি নি। খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে ইদানিং।

নতুন ব্যবসা ধরেছি, ইতালিয়ান গেলাতো আইসক্রিমের বাংলাদেশি ব্র্যাান্ড বাজারজাত করবো, রমরমা ব্যবসা। চাকরি-বাকরি করার ইচ্ছা আমার কোনকালেই ছিলো না তেমন। তক্কে তক্কে ছিলাম কবে একটা মনমতো ব্যবসা ধরে ভালো দাঁও মারতে পারবো। বাবাকে বুঝিয়ে টাকা ম্যানেজ করতে ঝামেলা গেছে ভালো। এরপর লাইসেন্স যোগাড় করা, ভালো জায়গায় দোকান স্থাপন, ডেকোরেশন, সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ততা গেছে।

সূচনাটা বেশ ভালোই হয়েছে বলা যায়। আর্থিকভাবেও যেমন সফল, তেমন প্রেস্টিজিয়াসও। 'ব্যবসা', 'দোকান' এসব নাম শুনলে পাত্রীপক্ষ যেমন নাক কুঁচকিয়ে একটা হামবড়া ভাব ধরে, এক্ষেত্রে তা হবে না মোটেও। গেলাতো আইসক্রিম মেয়েরা খুব আগ্রহ করেই খায়। শান্তকে আমি ফোন করে বলি আমার দোকানে এসে একদিন আতিথ্য গ্রহণ করে যেতে।

ওরা ততদিনে বাসা পরিবর্তন করে আরো দূরে জিগাতলার ওদিকে চলে গেছে। মিরপুর থেকে জিগাতলা খুব বেশি দূরে নয় অবশ্য। আর আমার ব্যস্ততাও ইদানিং বেশ কমে এসেছে। কোনই অযুহাত নেই না যাবার। শান্তর হয়তো কুন্ঠা হয় আমার দোকানে আসতে।

ও বেকার ছেলে, মফস্বঃল থেকে বাবার পাঠানো টাকায় কায়ক্লেশে মেস করে থাকে, আমার দোকানের দামী আইসক্রিম কেনার বিলাসিতা করা ওর সাজে না, আর ফ্রি খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, এ যে খাঁটি বাঙালি মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট! আমারই যাওয়া উচিত। বুঝতে পারি, একজনের জিনিস অন্যজনের কাছে গচ্ছিত রাখলে সেইজনের ফেরত দেবার তাগাদা একসময় যন্ত্রণাবিদ্ধ করতে থাকে তাকে যদি সে সুচেতনার অধিকারী মানুষ হয়। যতখানি বিরতি দিয়ে ফোন করলে ভদ্রতার লঙ্ঘন হবে না তা বজায় রেখে শান্ত আমাকে ফোন করতে লাগলো। আর আমিও উপহারটি শীঘ্রই নিতে আসবো বলে তাকে আশ্বস্ত করতে থাকলাম। * আমার জীবনের চলার পথ আশ্চর্য মসৃণ।

ঠিক যেন আইসক্রিমের ক্রিমের মতো। গেলাতো আইসক্রিমের জমিনে স্কি করে তড়তড়িয়ে উঠতে থাকলাম উচ্চ থেকে উচ্চতর ধাপে। দোকানের শাখা ছড়িয়ে গেলো ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেটে। বিয়ে করলাম ত্রিশ বছর বয়সে এক সুন্দরী এবং গুণবতী গেলাতো ফ্যানকে! যথাসময়ে নাদুসনুদুস সুস্থসবল একটা পুত্রসন্তানও লাভ করলাম। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ি, গাড়ি হলো।

লোন পরিশোধ করে ফেললাম যথাসময়েই। আমি নিয়মিত কর দিই, ফলে আয়কর অফিসের লোকেরা বছর দশেক পর হঠাৎ করে এসে একটা বিশাল অংকের টাকা চাপিয়ে দিয়ে যাবে আর আমাকে সেসব এড়াতে নানারকম ফন্দিফিকির করতে হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। ছুটি কাটাতে আমি বিদেশে যাই। শীতকালে ইতালি বা মালয়েসিয়া, গরমে দার্জিলিং। প্রচুর নতুন বন্ধুবান্ধব হয়েছে আমার।

একজন সফল ব্যবসায়ী, সুখী স্বামী, সন্তুষ্ট পিতার বন্ধু-বান্ধব, তুচ্ছার্থে সাঙ্গপাঙ্গ, হীনার্থে অনুচর হতে সময় লাগে না। আমাকে খুশি করতে তাদের উদ্যোগ আয়োজনেরও কমতি নেই। কারণ আমি সবাইকে খুশি করে চলি। এমন কী মাস্তানরাও আমার ওপর খুশি। ব্যবসা করতে গেলে মাস্তানদের সাথে যোগসাজস রাখতে হয় বৈ কি।

নইলে কবে আবার স্কুলে যাবার পথে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে এক কোটি টাকা মুক্তিপণ চেয়ে বসবে! সবাইকে তুষ্ট করা এই বিলাসদার জীবনে আমাকে তুষ্ট করতেও মুখিয়ে থাকে তারা সবাই। তাই আমার চল্লিশতম জন্মদিনে ধানমন্ডির বাসায় বিশাল আয়োজন। অনেককেই আসতে বলেছি। বেশিরভাগই আমার নতুন জীবনের নতুন বন্ধু-বান্ধব। পুরোনোদের সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই বললেই চলে।

ওহ, সেদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো শান্তর সাথে। ওরা এখনও জিগাতলাতেই থাকে। রাইফেলস স্কয়ারের ওখানে দেখা হয়ে গেলো। ওকে বললাম আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আসতে। বলার জন্যেই বলা।

জানি তো আসবে না। যেমন মুখচোরা ছেলে ও। আচমকাই আমার মনে পড়ে যায় শাপলা আপার দেয়া উপহারটি ওর কাছ থেকে নেয়া হয়নি এখনও। কিন্তু তখন বড্ড তাড়া ছিলো আমার। চলে আসতে হলো বিদায় জানিয়ে।

আর তাছাড়া সামান্য একটা উপহারের জন্যে জিগাতলার সংকীর্ণ অলিগলিতে গাড়ি ঢোকানোর কোন মানে হয় না। গাড়ি রাখার জায়গা পাবো না। ওসব জায়গা কেমন হয় জানি তো আমি! * রঙীন গ্লাস। ঝাঁঝালো পানীয়। প্লাস্টিকের বল।

বাচ্চাদের কলরব। আড়ি পাতা ব্যবসায়ী কুশলতা। মেয়েদের মুখে হাসি মনে হিংসা, ওর পোষাকটা সুন্দর। কেউ কেউ বেশি পান করে ফেলেছে। বেসিন ঝকঝকে।

বমি লাগছে? ওখানটায় ওখানটায়! বাচ্চাদের জন্যে রয়েছে হরেক রকম চকলেট আর বেলুন। শানিয়ার ক্লিভেজে সন্ধ্যের আলো পড়ে তড়পাতে তড়পাতে আমাদের আন্ডারওয়্যারে ঢুকে যায় ওয়্যারউলফের মতো। হুল্লোড়ের শব্দ, কেউ লটারি জিতেছে। দারুণ গান গেয়ে কেউ তরুণীদের আর্দ্র করেছে। জানালাটা খুলে দাও না, দারুণ বাতাস! নতুন প্রজেক্ট প্রপোজালটা দেখলাম, একটু কস্টলি আর হাই এ্যাম্বিশাস।

ভাবী শোনেনতো একটু, ইউ আর গর্জিয়াস! থ্যাংকিউ! টুংটাং। গোপনে গোপনে চুমু। পরে। ইশারা। এই এখন কেক কাটা হবে, সবাই একসাথে বলো "হ্যাপি বার্থডে টু ইউ..." -মুক্ত ভাই? -আরেহ কে! শান্ত নাকি! হোয়াট্টা প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ! তুমি আসবে আমি সত্যিই ভাবি নি।

-একটু যদি বাইরে বাগানের এখানে আসতেন। আপনি তো জানেনই ভীড়ের মাঝে আমি একটু ইয়ে মানে আর কী... এত হেজিটেশনের কী হলো! ছোকড়ার ওপর আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। -ওহ বুঝেছি তুমি না বরাবরই বাড়াবাড়িরকম লাজুক। কোন ব্যাপার না। চলো ওখানটায়।

এই বাগানটা আমার নিজের করা। এখানে কত রকমের ফুল বুনেছি! কত রাত বারান্দায় জেগে তাদের শোভা দেখেছি, ঘ্রাণ নিয়েছি! মাঝেমধ্যে তুমুল ব্যস্ততায় যখন আমার নাভিঃশ্বাস ওঠে, তখন এই এক টুকরো স্বর্গের মাঝে আমি সতেজ বাতাস খুঁজে পাই। প্রাণ ভরে শ্বাস নেই, ফুলের দল আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে "এসবই তোমার, এসবই তোমার!"। -মুক্ত ভাই, শুভ জন্মদিন। আপনার জন্যে আমি কিছু আনতে পারি নি, দুঃখিত।

তবে শাপলা আপার দেয়া সেই উপহারের প্যাকেটটা নিয়ে এসেছি। -এতদিন ধরে ওটা রেখেছো! থ্যাংকস থ্যাংকস, মেনি থ্যাংকস! দাও ওটা আমার কাছে। -কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি মুক্ত ভাই? -হ্যাঁ শিওর, বলো! -এতদিন ধরে প্যাকেটটা আমার কাছে ছিলো, খুলে দেখি নি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এর ভেতর কী আছে। যদি একটু দেখাতেন... -নিশ্চয়ই! আমি প্যাকেটটা খুলতে শুরু করি।

চমৎকার র্যাদপিং কাগজে মোড়ানো, এখনও রঙ চটে যায় নি। তার ভেতর একটা ছোট্ট বাক্স। বাক্সটার ভেতরে ফুজিয়ামা পর্বতের একটা ছোট্ট রেপ্লিকা। বাহ! সুন্দর। আর সাথে একটা সোনালী রঙা চাবির রিং।

শাপলা আপার সাথে লাস্ট যেন কবে দেখা হয়েছিলো? -শাপলা আপা এই কিছুদিন আগেও ঢাকায় এসেছিলেন। আপনার খোঁজ করেছিলেন। এতদিনেও মনে রেখেছে! অদ্ভুত মহিলাতো! -আমি যাই মুক্ত ভাই। শাপলা আপা বলেছে তাকে ই-মেইল করতে। মনে করে করবেন কিন্তু।

ই-মেইল ঠিকানা কোথায় কোন বাজে কাগজের স্তুপে বা সহস্র সেন্ট আইটেমের মাঝখানে সেঁধিয়ে আছে কে জানে! -আমি যাই এখন মুক্ত ভাই। ভালো থাকবেন। -হ্যাঁ যাও। বলে আমি আবার পুরোনো দিনের মতো করে স্মৃতিকলোনি, শাপলাপুকুর পেরিয়ে শাপলা আপার বাসায় কড়া নাড়তে গিয়ে কিছুতেই আর খুঁজে পাই না। ঠং করে কিচু পড়ার শব্দ হয়।

ফুজিয়ামা পর্বতের রেপ্লিকাটা পড়ে গেছে হাত থেকে। হাতে আছে শুধু চাবির রিংটা। চারিপাশে কোন ফুল নেই। গান নেই। আলো নেই।

আনন্দ নেই। অতিথিদের কলরব নেই। শিশুদের হুল্লোর নেই। যুবকের গান নেই। যুবতীর নৃত্য নেই।

জন্মদিনের কেক নেই। আঁধার আঁধার... বিবর্ণ মরাপাতা মাড়িয়ে আমি শাপলাপুকুরটার কাছে যাই। সেখানে আবার চারিদিকে গ্রিল দিয়ে ঘিরে রেখে তালা মেরে দিয়েছে কে? আমার হাতে চাবির রিং, কিন্তু চাবি তো নেই? কোথায় সে চাবি? কোথায়? আমি পকেটের আনাচে কানাচে, মরা পাতা আর ঘাসের স্তুপে, শ্যাওলা জমা সিমেন্টের আসনে খুঁজতে থাকি। চারিপাশে প্রহরীদের সতর্ক পাহাড়া, শ্রমিকদের নির্মাণ। সব জায়গা গ্রিল দিয়ে ঘিরে তালা মেরে দিচ্ছে।

আমার খোঁজার জায়গাগুলি রুদ্ধ হয়ে আসছে। কোথাও যেতে চাইলে সবাই বলে "চাবি কই? চাবি দেখান!"। আমি নিশ্চিত চাবিটা এই রিংয়ের সাথেই ছিলো। আতঙ্কে দৌড়ুতে গিয়ে আমি মুখ থুবড়ে পড়ি। তালাবদ্ধ সব জায়গা।

আমাকে টেনে তোলে শানিয়া, যার ক্লিভেজ থেকে সন্ধ্যের আলো তড়পিয়ে আমাদের আন্ডারওয়্যারের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো ওয়্যারউলফের মতো। -বোকা! ওসব জায়গায় পরে যেও। আর চাবি খুঁজছো? আমার লকেটটা দিয়ে চলবে নাকি দেখো তো? ঝলমলে পোষাকের আড়ালে তার তীব্র সাদা বুক... সাদা রঙয়ের সাথে তীব্রতা শুধু ওখানেই মানায়... শানিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আমি শাপলাপুকুর, স্মৃতিকলোনি, বিবর্ণ ঘাস পার হয়ে চলে আসি উৎসবস্থলে, গোপন আলোর তৈরি রম্বসে, নাহ চারিপাশে কেউ দেখছে না। শানিয়ার বুকে হাত দিয়ে তার লকেটটাকে কী মনে করে যেন চাবির রিংটার সাথে মেলাতে থাকি, নাহ... দুটো ম্যাচ করছে না কিছুতেই। ঐ চাবিটা যে কোথায়... শানিয়া আমার ছেলেমানুষী দেখে হাসে।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।