আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদর্শ না ক্ষমতা- কোনটি ঠিক

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুটি আলাদা জোট গঠন করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত এই জোটে জাতীয় পার্টি এবং দেশের কতিপয় বামপন্থি দল ছিল যারা পরবর্তীতে মহাজোট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই মহাজোট গঠনের একটি পথপরিক্রমা অবশ্য আছে। আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, সিপিবি ও অন্য বামপন্থিরা মিলে গঠন করেছিল ১১ দল। যা পরে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।

পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এতে যোগ দেয় এবং এটি মহাজোটে পরিণত হয়।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মহাজোটে যোগ দেওয়া নিয়ে অনেক বিতর্কের সূত্রপাত হয়, যা এখনো চলছে। পক্ষান্তরে বিএনপি জামায়াতে ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করে চারদলীয় জোট। এই জোট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক তেমন একটা ছিল না। কিন্তু বাইরে থেকে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল জামায়াতকে নেওয়া নিয়ে।

একপক্ষ আরেকপক্ষকে অভিযোগ করে স্বৈরাচার অথবা রাজাকারকে সঙ্গে নেওয়া নিয়ে।

এটি কি একটি আদর্শিক প্রশ্ন ছিল? অবশ্যই! স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও জামায়াতে ইসলামী আজ এটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন। দলটির মূল নেতাদের অধিকাংশই যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের বিচার হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে।

মূল নেতার ফাঁসির যোগ্য অপরাধ প্রমাণিত বলা হলেও বয়স বিবেচনায় তাকে ৯০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। সেই রকম একটি দলের সঙ্গে জোট বেঁধে গণতন্ত্র কিংবা জাতীয়তাবাদী লড়াই করা যায় কি? বিএনপি এখনো তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছে আর আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে ওই বিএনপির বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল যা পরবর্তীকালে টিকে থাকেনি। আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা জামায়াতের সঙ্গে কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে শক্তি বাড়ানোর জন্য এই সমঝোতা করেছিল। কোনো নির্বাচনী ঐক্য করেনি। তাদের সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন বা গড়ার কথা ভাবেনি।

কথাটি আন্তরিক সত্য কথন কি না সে প্রশ্ন করা যেতে পারে? কিন্তু তার জবাবের জন্য আমাদের ইতিহাসের ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো পথ নেই। কারণ আওয়ামী লীগ এরপর খেলাফতে মজলিসের সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। খেলাফত মজলিসও একটি মৌলবাদী সংগঠন। এর সমালোচনা এত তীব্র হয়ে ওঠে যে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সে চুক্তি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অতঃপর আসছে এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির কথা।

দেশবাসীর মনে আছে ৯ বছর কি লাগাতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে। সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সেটি ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘতম লড়াই। সামরিক শাসক আইয়ুব খানও এক দশক শাসন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান। '৬৯-এ বিশাল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এরশাদের বিরুদ্ধে যেরকম ধারাবাহিক ও লাগাতার সংগ্রাম হয়েছিল তা ষাটের দশকে হয়নি।

এই সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ প্রায় সব দল দুটি জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল। এরশাদ সরকারের পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে পিষে হত্যা করেছিল সেলিম দেলোয়ারকে। গুলি করে হত্যা করেছিল রউফুন বসুনিয়া, শাহজাহান সিরাজ, তিতাসসহ অনেক ছাত্রনেতাকে। রক্তের নদী বইতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত বুকে পিঠে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তিপাক' লিখে জীবন দিয়েছিল নূর হোসেন।

তবেই দেশ স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পেয়েছিল। ততদিনে ১৫ দল ভেঙে আলাদা করে পাঁচদলীয় জোট গঠিত হয়েছে। সাতদলীয় জোট তো আগে থেকেই ছিল। তিনদলীয় জোট একটি রূপরেখা ঘোষণা করেছিল, যাতে স্বৈরতন্ত্র পতনের পর দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র কীভাবে নির্মিত হবে তার রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছিল।

বলাবাহুল্য, পরবর্তীকালে তিন জোটের এই রূপরেখা কেউ মেনে চলেনি।

গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য কেউ ওই রূপরেখা অনুযায়ী চেষ্টাও করেনি। ফলে দেশে গণতন্ত্র নির্মিত হয়েছে সেই কথা বলার অবকাশ তৈরি হয়নি। বরং স্বাধীনতার চার দশক পরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে সেটি কেবল প্রশ্নবিদ্ধই হয়নি তা নিয়ে এক উদ্বেগজনক সংঘর্ষের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই কাজে বিএনপি আওয়ামী লীগ যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, তখনই তারা আগুনে ঘি ঢেলেছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে যখন জোটে টানা হয় তখন অনেকেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

তা হলে নয় বছরের এই সংগ্রাম কি কেবলই ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগেই মানুষ অবাক হয়ে দেখল এরশাদকে নিয়ে এই রশি টানাটানির প্রতিযোগিতায় বিএনপিও নেমেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার দলকেই (বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ) ভোট দেওয়া উচিত এরকম বক্তব্য দিল উভয় দলই। নির্বাচনে তাদের বিজয়ের জন্যই এরশাদকে প্রয়োজন এরকম হিসাব করতে লাগলেন তারা। তাদের বিজয় মানে গণতন্ত্রের বিজয় এবং সে জন্য এরশাদকে প্রয়োজন।

প্রতিভাত হলো এরশাদ ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না। ব্যাপারটি কি আদর্শিক? নির্বাচনের খেলায় এই দুই দল, দলের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া কি আদর্শিক লড়াই করছেন? এরশাদ কিংবা জামায়াতকে সঙ্গে রাখা কি কোনো আদর্শিক বিষয়। অথচ এই দুই দল, দলের দুই নেত্রী অন্তত একজন দাবি করছেন যে, তিনি বা তারা আদর্শের লড়াই করছেন।

আমি কোনোভাবেই একজন তথাকথিত আদর্শবাদী কট্টরপন্থি অন্ধ নই। আমি জানি রাজনীতিতে চিরস্থায়ী কোনো সম্পর্ক নেই।

শত্রুমিত্র নেই। এমনকি রাজনীতি আবেগনির্ভর নয়। জাপানের হিরোশিমায় মার্কিনিরা আনবিক বোমা ফেলেছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওই জায়গাটা ঘুরে দেখার। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় নিষ্ঠুর ঘটনা আর নেই।

কিন্তু সেই জাপানিরা আমেরিকানদের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাপান আজ আমেরিকার শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বহু দিক দিয়ে অধিকতর শক্তিশালী। জাপানের পথই যে ঠিক পথ তা আমি বলছি না। কেউ সেটা মানেনি। হুগো শ্যাভেজ সেটি মানেননি, চীন বহু দিন লৌহ যবনিকার আড়ালে ছিল।

বেশ কয়েক বছর হয় চীন সেই পর্দা তুলে নিয়েছে। রাজনীতিতে শেষ কথা নেই, চিরস্থায়ী কোনো শত্রু কিংবা বন্ধু নেই_ এসব কথার মানে কি রাজনীতিতে যখন যা ইচ্ছা তাই বলা যায়। যখন যার সঙ্গে ইচ্ছা খাতির করব আর যখন পছন্দ হবে না তখন গলা ধাক্কা দিয়ে দিব, তা হলে ধরে নিতে হবে যে, রাজনীতিতে আর যাই হোক নীতির কোনো বালাই নেই। এ কেবলই ক্ষমতা দখল ও ভোগ করার এক কুৎসিত লড়াই। সে লড়াইয়ে জনগণের কি স্বার্থ? দুটো দল তো একই লড়াই করছে।

এর আগে আমি বলেছি, দুটি দলের জন্মের ইতিহাস থেকে শুরু করে তার পরবর্তী পর্যায় তাদের রাজনীতি ও আদর্শগত পার্থক্য রেখাটি মোটামুটি স্পষ্ট ছিল। যতই দিন গেছে সেই রেখা অস্পষ্ট হতে হতে এখন প্রায় ঝাপসা হয়ে গেছে। নীতিগত বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে দুটি দল, যা তাদের ঘোষিত নীতি থেকে বিপরীত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে পরবর্তীতে যে সখ্য তার নৈতিক ভিত্তি কি? এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টি যে রাজনীতির কথা বলে তা তো বিএনপির কাছাকাছি। দুটি দলই জন্মের আগে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে দল গঠন করেছে।

এ জন্য তারা আদালত কর্তৃক শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হয়েছে। এরশাদ যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ের শত্রু বলে বিবেচিত হয়েছেন। পটপরিবর্তনের পর সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে। মজার ব্যাপার, শেখ হাসিনা বিএনপিকে বা খালেদা জিয়াকে কখনো পছন্দ করেনি কিন্তু এরশাদকে মিত্র করেছেন। এটি ঠিক সময়ের ব্যবধানে শাসক হিসেবে, স্বেচ্ছাচারী হিসেবে, স্বৈরাচারী হিসেবে এরশাদের যে দুর্নাম হয়েছিল সেটাকে প্রায় সমান করে ফেলেছেন শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া।

আবার একই জায়গায় জন্ম, একই পথ দিয়ে চলা সত্ত্বেও এরশাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি বেগম জিয়ার। এখন দেখছি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোটে থেকেও জোটের শাসনের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলছেন। শোনা যাচ্ছে, আগামীতে নির্বাচনে অংশ নেবেন। এও শোনা যাচ্ছে, যদি কেউ নির্বাচনে অংশ না নেয় (যদিও তিনি বলছেন এই শেষ বয়সে ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আর দালাল হতে চান না) তাহলে এরশাদ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবেন এবং বিশাল এক বিরোধী দল গঠন করবেন। তখন আদর্শহীন ক্ষমতার রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ হবে।

পাঠকবৃন্দ, দেশে কি আদর্শের রাজনীতি চলছে? দুই নেত্রী বা দুই দল কি রাজনীতির চর্চা করছেন? শেখ হাসিনা যে দাবি করছেন তার সঙ্গে বিরোধী দলের নেতার পার্থক্য আদর্শিক তা কি ঠিক? রাজনীতি কেবল কাগজে বুলি নয়, বাস্তবে তার প্রয়োগ থাকা চাই। সেটা কেউ দেখছে না।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল :mrmanna51@yahoo.com

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.