আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুদ্ধদেব বসুর একগুচ্ছ কবিতা এবং বুদ্ধদেব বসু

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে।
নদী-স্বপ্ন কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনা দিকি এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও, আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও। নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবে কি অনেক দূরে? পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।

দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো, মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষ্মী, মিষ্টি, ভালো! বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট, তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট। চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে, এই ফাঁকে মোরে- আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে। কোনো ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে যত দোষ সব আমার- না, আমি একা লব মাথা পেতে। নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারী নই, কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই। চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়, একা ফেলে গেলে ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।

অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামি? সোনালি? লাল? সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালিটা দিয়ো কাল। সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়, দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায় শুয়ে শুয়ে মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়, পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়। মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই, আকাশেরে কে যে ধোয় বার বার, তুমি কি জানো তা ভাই? কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে, উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে? রুপোর নদীতে রুপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ, ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ। ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।

এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর? ছোকানু, চল রে, চান করে আসি দিয়ে সাতশোটা ডুব, ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব। ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বেশ তুমি খুব ভালো, মাঝি উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি। খাওয়া হলো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও, হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও। আমর দু’জন দেখি বসে বসে আকাশ কত না নীল, ছোটো পাখি আরো ছোটো হয়ে যায়- আকাশের মুখে তিল সারাদিন গেলো, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে, সোনা হয়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হলো তার পরে। সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।

ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি, গান গাওয়া হলে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি? শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা – মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়, ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়। চিল্কায় সকাল কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়, কেমন করে বলি! কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর! যেন গুণীর কণ্ঠে অবাধ উন্মুক্ত তান, দিগন্ত থেকে দিগন্তে। কী ভালো আমার লাগল এই আকাশের দিকে তাকিয়ে। চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে, মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে। তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে, ইস্টিশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।

গাড়ি চলে গেল। - কী ভালো তোমাকে বাসি, কেমন করে বলি! আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না। গরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত। - তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাব যা এতদিন পাই নি? রুপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে, নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর সমস্ত আকাশ সূর্যের চুম্বনে। - এখানে জ্বলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে কখনো কি ভেবেছিলে? কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে জলের উপর দিয়ে।

- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে, আর আমার কী ভালো লেগেছিল তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ সুখ। দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন নীল এই আকাশ। - আর তোমার চোখে কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম কেমন করে বলি। অচেনা মানুষ (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদ – বুদ্ধদেব বসু) বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালবাসো? তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে? পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নী- কিছুই নেই আমার।

তোমার বন্ধুরা? ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনোই জানি নি। তোমার দেশ? জানি না কোন্ দ্রাঘিমায় তার অবস্থান। সৌন্দর্য? পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি অমরা। কাঞ্চন? ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ঈশ্বরকে। বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি? আমি ভালবাসি মেঘ,…..চলিষ্ণু মেঘ……. উঁচুতে……..ঐ উঁচুতে…….. আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।

ইলিশ আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল। মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল। মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল। রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব, নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়। তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁজে।

এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব। দায়িত্বের ভার কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর। লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন, যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার- সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ হয়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড়। সেই যুদ্ধে বার বার হেরে গিয়ে, মরে গিয়ে, মন যখন বলছে; শুধু দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা তার সবচেয়ে নির্বাচিত, প্রার্থনীয়, কেননা তা ছাড়া আর কিছু নেই শান্ত, স্নিগ্ধ, অবিচল প্রীতিপরায়ণ- আমি তাকে তখন বিশ্বস্ত ভেবে, কোনো-এক দীপ্ত প্রেমিকার আলিঙ্গনে সত্তার সারাত্সার করে সমর্পণ- দেখেছি দাঁড়িয়ে দূরে, যদিও সে উদার উদ্ধার লুপ্ত করে দিল ভাবা, লেখা, পড়া, কথোপকথন, তবু প্রেম, প্রেমিকেরে ঈর্ষা করে, নিয়ে এলো ক্রূর বরপণ- দুরূহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার। কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।

প্রত্যহের ভার যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনা ছন্দের সুন্দর নীড়ে বার বার, কখনো ব্যর্থ না হোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পন জীবনের জটিল গ্রন্থিল বৃক্ষে; যে-ছন্দোবন্ধন দিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকে বত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে, কুটিল ক্রান্তিতে; যদি ক্লান্তি আসে, যদি শান্তি যায়, যদি হৃত্পিণ্ড শুধু হতাশার ডম্বরু বাজায়, রক্ত শোনে মৃত্যুর মৃদঙ্গ শুধু; … তবুও মনের চরম চূড়ায় থাক সে-অমর্ত্য অতিথি-ক্ষণের চিহ্ন, যে-মূহূর্তে বাণীর আত্মারে জেনেছি আপন সত্তা বলে, স্তব্ধ মেনেছি কালেরে, মূঢ় প্রবচন মরত্বে; খন মন অনিচ্ছার অবশ্য বাঁচার ভুলেছে ভীষণ ভার, ভুলে গেছে প্রত্যহের ভার। ব্যাঙ বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক; উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক। আদিম উল্লাসে বাজে উন্মুক্ত কণ্ঠের উচ্চ সুর। আজ কোনো ভয় নেই- বিচ্ছেদের, ক্ষুধার মৃত্যুর।

ঘাস হল ঘন মেঘ; স্বচ্ছ জল জমে আছে মাঠে উদ্ধত আনন্দগানে উত্সবের দ্বিপ্রহর কাটে। স্পর্শময় বর্ষা এল; কী মসৃণ তরুণ কর্দম! স্ফীতকণ্ঠ, বীতস্কন্ধ- সংগীতের শরীরী সপ্তম। আহা কী চিক্কণ কান্তি মেঘস্নিগ্ধ হলুদে-সবুজে! কাচ-স্বচ্ছ উর্ধ্ব দৃষ্টি চক্ষু যেন ঈশ্বরের খোঁজে ধ্যানমগ্ন ঋষি-সম। বৃষ্টি শেষ, বেলা পড়ে আসে; গম্ভীর বন্দনাগান বেজে ওঠে স্তম্ভিত আকাশে। উচ্চকিত উচ্চ সুর ক্ষীণ হলো; দিন মরে ধুঁকে; অন্ধকার শতচ্ছিদ্র একচ্ছন্দা তন্দ্রা-আনা ডাকে।

মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী, স্তব্ধ পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী উত্সাহী একটি অক্লান্ত সুর; নিগূঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক- নিঃসঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উত্সারিত- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক। রূপান্তর দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু, রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে। ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা, বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী, মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা। জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে, চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়, ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন। দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম, মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন।

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে, শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন, ঘুমিয়ে পড়ো না, কথা বলেও নষ্ট করো না এই রাত্রি- শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব। কেননা কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হয়ে গেছে, কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই; তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল- অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন। কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন, তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু? বলো না ‘সুন্দর’, বলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না নিজেদের- শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে। আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই, যার উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে, যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ- নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন। আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।

দেখবে কেমন ছোটো হতেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধরে যায়, যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ- সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত, যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়, রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ- যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়- সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের। আমাকে ভুল বোঝো না। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ, প্রাণ কত বিপন্ন। কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান, যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর মৃত্তিকায়- চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত। তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি, আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া? মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের- যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।

নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক, যারা ভোলো নি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে, রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা : আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ- সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে নিশান। মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার। স্টিল্ লাইফ সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয় দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে? ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়? এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র। হেমন্তের যেন অন্ত নেই। গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে।

তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার। কিন্তু শুধু এই? তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে আসে ভারী-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে ছুঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে হয়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা- যা দেখে, হঠাৎ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হতে কোনো মৃতার প্রতি ‘ভুলিবো না’ - এত বড় স্পর্ধিত শপথে জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক। তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে ব্যপ্ত হোক।

তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে। শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে জ্বেলে রাখি এই রাত্রে - তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে। বিদ্যাসুন্দর বলতে পারো, সরস্বতীর মস্ত কেন সম্মান? বিদ্যে যদি বলো, তবে গণেশ কেন কম যান? সরস্বতী কী করেছেন? মহাভারত লেখেন নি। ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে, তর্ক করাও শেখেন নি। তিন ভুবনে গণেশদাদার নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে অথচ তার বোনের দিকেই ভক্তি কেন চিত্তে? সমস্ত রাত ভেবে ভেবে এই পেয়েছি উত্তর- বিদ্যা যাকে বলি, তারই আর একটি নাম সুন্দর।

প্রেমের কবিতা শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন। শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার। শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন। -কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ। পুষ্পের নিশ্বাস, রেশমের শিহরণ, রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ।

গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার অঙ্গের অঙ্গনে আনলো যে-উপহার- সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন। -কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন। বিলাসিত বলয়ের মত্ত আবর্তন, মূর্ছিত রজনির বিদ্যুৎ-নর্তন। বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণা তার উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার- সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন। ---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।

শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন, নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন। রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার, সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ। -কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য। এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ, যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার, মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার;--- সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ। ---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।

শেষের রাত্রি পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা, আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা, যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা। (তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার, তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার; তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার- কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। ) বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে, ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে; দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ। (আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার, প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার; তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার- কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। ) নেমেছে হাজার আঁধার রজনি, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া, হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।

চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা (তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার, তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার; তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার- কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। ) এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো, পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো। ---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা (এসো, চলে এসো; সেখানে সময় সীমাহীন হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন; সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন, কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। ) অনেক ধূসর স্বপনের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম, ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম, আদিম রাতের বেণিতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা। (ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার, পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার, তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সাওয়ার--- কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।

) যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা, হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভরে উন্মাদনা। কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা। (কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার; তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার- কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। ) তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে আদিম রাতের আঁধার-বেণিতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,--- সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা। (এসো চলে এসো যেকানে সময় সীমানাহীন, সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।

যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। ) বিতৃষ্ণা-৩ (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) আমি যেন রাজা, যার সারা দেশ বৃষ্টিতে মলিন, ধনবান, নষ্টশক্তি, যুবা, তবু অতীব প্রবীণ, শিক্ষকের নমস্কার প্রত্যহ যে দূরে ঠেলে রেখে শিকারি কুকুর নিয়ে ক্লান্ত করে নিজেই নিজেকেই কিছুই দেয় না সুখ- না মৃগয়া, না শ্যেনচালন, না তার অলিন্দতলে মৃতপায় তারই প্রজাগন! মনঃপূত বিদূষক প্রহসনে যত গান গাঁথে আনত ললাট থেকে রোগচ্ছায়া পারে নাসরাতে; ফুলচিহ্ন আঁকা তার শয্যা, তাও নেয় রূপান্তর কবরে, এবং যার সাধনায় রাজারা সুন্দর, জানে না সে-মেয়েরাও, লজ্জাহীন কোন প্রসাধনে আমোদ ফোটানো যায় এ-তরুণ কঙ্কালের মনে। করেন কাঞ্চনসৃষ্টি, সে-মুনিরও মেলে নি সন্ধান কোন বিষময় দ্রব্যে অহোরাত্রি নষ্ট তার প্রাণ। এমন কী রক্তস্নান, লিপ্ত যাতে সব ইতিহাস, পুরাতনী রোমকের, অর্বাচীন দস্যুর বিলাস, তাও এই মূঢ় শবে তাপলেপ পারে না জোগাতে, লিথির সবুজ স্রোত-রক্ত নয়- বহে যেশিরাতে।

এক পথচারিণীকে (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) গর্জনে বধির করে রাজপথে বেগ ওঠে দুলে। কৃশতনু, দীর্ঘকায়, ঘন কালো বসনে সংবৃত, চলে নারী, শোকের সম্পদে এক সম্রাজ্ঞীর মতো, মহিমামন্থর হাতে ঘাঘরার প্রান্তটুকু তুলে– সাবলীল, শোভমান, ভাস্করিত কপোল, চিবুক। আর আমি – আমি তার চক্ষু থেকে, যেখানে পিঙ্গল আকাশে ঝড়ের বীজ বেড়ে ওঠে, পান করি, কম্পিত বিহবল মোহময় কোমলতা, আর এক মর্মঘাতী সুখ। রশ্মি জ্বলে… রাত্রি ফের! মায়াবিনী, কোথায় লুকোলে? আমাকে নতুন জন্ম দিল যার দৃষ্টির প্রতিভা– আর কি হবে না দেখা ত্রিকালের সমাপ্তি না হলে? অন্য কোথা, বহু দূরে! অসম্ভব! নেই আর সময় বুঝি বা! পরস্পর – অজ্ঞতায় সরে যাই – আমারই যদিও কথা ছিল তোমাকে ভালোবাসার, জানো তা তুমিও! লাল চুলের ভিখিরি মেয়েকে (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার।

অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) লাল চুলের, ফর্সা, একমুঠো বালিকা, তোর ঘাঘরা – ভরা ফুটো দেখায় তোকে অকিঞ্চন অতি এবং রূপবতী। স্বাস্থ্যহীন তরুণ তনু তোর ছুলির দাগে চোখে লাগায় ঘোর, আমাকে দেয় মধুরতার ছবি– আমি গরীব কবি। কাঠের জুতোর গরবে তোর, মানি, লজ্জা পায় উপন্যাসের রানি; চলুন তিনি কিংখাবের জুতোয়; - ভঙ্গি তোকে জিতোয়। ন্যাকড়া – কানি ঢাকে না তোর লাজ; তার বদলে দরবারি এক সাজ নিস্বনিত লম্বা ভাঁজে-ভাঁজে পড়ুক পায়ের খাঁজে; রন্ধ্রময়, ছিন্ন মোজা জোড়া, তার বদলে সোনার এক ছোরা জঙ্ঘা তোর যেন মোহন রেখায় লম্পটেরে দেখায়; হালকা গেরো উন্মোচন করুক দুটি চোখের মতো রে তোর বুক দীপ্তিময় – লাবণ্যের চাপে আমরা জ্বলি পাপে; নির্বাসনের সময় বাহুযুগল যেন অনেক আরজিতে হয় উতল, ফিরিয়ে দিতে না যেন হয় ভুল দুর্জনের আঙুল, যত সনেট লিখে গেছেন বেলো, বাছাই করা মুক্তো ঝলোমলো, বান্দারা তোর বন্দনাতে দান দিক না অফুরান, হতচ্ছাড়া কবির দল, খাতায় নামটি তোর লিখুক প্রথম পাতায়, কুড়িয়ে নিতে খুঁজুক ছলছুতো সিঁড়ির চটিজুতো;- চটি তো নয়, কোমল এক নীড়, তার লোভে যে বেয়ারাগুলোর ভিড়, আড়ি পাতেন ওমরাহেরা নাচার, এবং অনেক রঁসার! ফুলের চেয়ে আরো অনেক বেশি শয্যা তোর চুমোয় মেশামেশি, তোর ক্ষমতার বিপুল পরিমাণে ভালোয়া হার মানে! অবশ্য তুই এখন ভিখারিণী ঐ যেখানে চলছে বিকিকিনি, হাত বাড়িয়ে দাঁড়াস চৌকাঠে সস্তা মালের হাটে; আহারে তোর চক্ষু ভরে জ্বালায় চৌদ্দ আনা দামের মোতির মালায়, সেটাও তোকে – মাপ করো গো মিতে– পারি না আজ দিতে। তাহলে তুই এমনি চলে যা রে, বিনা সাজে, গন্ধে, অলংকারে, শীর্ণ দেহে নগ্নতাই শুধু সাজাক তোকে বঁধু! আত্ম-প্রতিহিংসা (জে. জি. এফ কে) (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার।

অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) মারবো আমি তোকে, যেন কসাই, ঘৃণার লেশ নেই, শূন্য মন, কিংবা শিলাতটে মুশা যেমন! তাহলে আঁখি তোর যদি খসায় আমার সাহারার সান্ত্বনাতে দুঃখধারা এক উচ্ছ্বসিত; - আমার অভিলাষ, আশায় স্ফীত সে – লোনা জলে পারে ভাসতে যাতে নোঙর-তুলে-নেয়া তরী যেমন। মাতাল এ হৃদয়ে কান্না তোর শব্দ তুলে করে দিক বিভোর, ঢাকের নাদে যেন আক্রমণ! নই কি আমি এই দিব্য গানে স্বরের অন্বয়ে এক বেসুর, যেহেতু ব্যঙ্গের মুঠি চতুর আমার সত্তারে নিত্য হানে? আমারই কণ্ঠ সে – কি জঞ্জাল! আমারই কালো বিষ রক্তে মাতে! আমি সে – উৎকট মুকুর, যাতে আপন মুখ দ্যাখে সে – দজ্জাল! আমিই চাকা, দেহ আমারই দলি! আঘাত আমি, আর ছুরিকা লাল! চপেটাঘাত, আর খিন্ন গাল! আমিই জল্লাদ, আমিই বলি। ছন্নছাড়া আমি শূন্যবাসী আপন হৃদয়ের রক্ত গিলে, কখনো প্রীত হতে শিখি নি বলে আমার আছে শুধু অট্টহাসি। স্মারক লিপি (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) এমন মানুষ কে আছে, বুকের তলে না পোষে হলদে সাপের তীব্র ফণা মসনদে বসে অনবরত যে বলে: ‘আমি রাজি’, আর উত্তরে ‘পারবো না!’ কিন্নর, পরী, অপ্সরীদের স্তব্ধ নয়নে তোমার নয়ন করো নিবদ্ধ, বিষদাঁত বলে : ‘মন দাও কর্তব্যে!’ গাছে ঢালো জল, সন্তানে দাও জন্ম, গড়ো কবিতায়, মর্মরে কারুকর্ম, সে বলের : ‘হয়তো আজকেই তুমি মরবে!’ মানুষ যতই ভাবুক, করুক চেষ্টা, মেলে না জীবনে এমন কোনো মুহূর্ত মানতে যখন না হয় – দারুণ ধূর্ত এই অসহ্য সর্পই উপদেষ্টা।

দিনের শেষে (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) উদ্ধত বেগে, পাংশু আলোর তলে, চেঁচিয়ে, পেঁচিয়ে অকারণ অভিযাত্রী, মত্ত জীবন নেচে-নেচে ছুটে চলে। তারপর, যেন রতিবিলাসিনী রাত্রি দিকমণ্ডলে উঠে এসে, দেয় মুছে এমনকি উন্মুখর বুভুক্ষারে, সে-নীরবতায় লজ্জাও যায় ঘুচে– তখন কবির মনে হয়: ‘এই বারে আত্মা আমার বিশ্রামে পায় যত্ন, ক্লান্ত পাঁজর কাতর মিনতি করে; হৃদয়ে আমার শত বিষণ্ণ স্বপ্ন! তবে ফিরে যাই, শিথিল শয্যা পরে অন্ধকারের পর্দা জড়ানো ঘরে শুশ্রূষাময় কালিমায় হই মগ্ন!’ প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা, সুন্দরতর দূর আকাশেরে ফুটিয়ে দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুলসজ্জা। যুগল হৃদয়, চরম দহনে গলিত, বিশাল যুগল-মশালের উল্লাসে হবে মুখোমুখি – দর্পণে প্রতিফলিত যুগ্ম প্রাণের ভাস্বর উদ্ভাসে।

গোলাপি এবং মায়াবী নীলের সৃষ্টি এক সন্ধ্যায় মিলবে দুয়ের দৃষ্টি, যেন বিদায়ের দীর্ণ দীর্ঘশ্বাস; পরে, দ্বার খুলে, মলিন মুকুরে রাঙাবে এক দেবদূত, সুখী ও সবিশ্বাস; আমাদের মৃত আগুনের ঘুম ভাঙাবে। বিষাদগীতিকা-১ (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) কী এসে যায়, থাকলে তোমার সুমতি? হও রূপসী, বিষাদময়ী! অশ্রুজল নতুন রূপে করে তোমায় শ্রীমতী, বনের বুকে ঝরনাধারা যেমতি, কিংবা ঝড়ে সঞ্জীবিত ফুলের দল। পরম ভালোবাসি, যখন আনন্দ তোমার নত ললাট থেকে গেছে সরে; হৃদয় জুড়ে সংক্রমিত আতঙ্ক, এবং তোমার বর্তমানে, কবন্ধ গত কালের করাল ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসি, আয়ত ঐ চক্ষু যখন তপ্ত যেন রক্ত ঢালে জলের ফোঁটায়, ব্যর্থ করে আমার হাতের সাধ্যসাধন অতি পৃথুল দুঃখ তোমার ছেঁড়ে বাঁধন– নাভিশ্বাসের শব্দে যেন মৃত্যু রটায়।

নিশ্বাসে নিই – স্বর্গসুখের পরিমেলে– এ কি গভীর স্তোত্র, মধুর আরাধনা!– কান্না যত ওঠে তোমার বক্ষ ঠেলে; ভাবি, তোমার হৃদয়তল দেয় কি জ্বেলে নয়ন দুটি ঝরায় যত মুক্তোকণা? বিষাদগীতিকা-২ (মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু) জানি, তোমার হৃদয় শুধু উগরে তোলে জীর্ণ প্রেম, পরিত্যাগে পঁচে-ওঠা, আজও সেথায় কামারশালের চুল্লি জ্বলে, এবং রয় লুকিয়ে তোমার বুকের তলে মহাপাপীর অহমিকার ছিটেফোঁটা। কিন্তু, শোনো, স্বপ্নে তোমার যতক্ষণে না দেয় ধরা বিকট আভা নরকের, এবং ডুবে অন্তহীন দুঃস্বপনে না চাও বিষ, তীক্ষ্ণ ফলা মনে-মনে বারুদ, ছোরা, কিংবা ছোয়া মড়কের, না পাও ভয় দরজাটুকু খুলতে হলে, কারো নিখিল অমঙ্গলের পাঠোদ্ধার, কেঁপে ওঠো, ঘণ্টা পাছে বেজে বলে– জানলে না, কোন অপ্রতিরোধ অন্ধ বলে আঁকড়ে ধরে কঠিন মুঠি বিতৃষ্ণার; রানি, দাসী, সভয় তোমার ভালোবাসায় তা না হলে ফুটবে না এই উচ্চারণ অস্বাস্থ্যকর আতঙ্কিত কালো নিশায় আমার প্রতি পূর্ণ প্রাণের বিবমিষায়– ‘রাজা! আমি তোমার সমকক্ষ এখন!’ নবযৌবন (এটি অগ্রন্থিত কবিতা) বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি যুগ হতে যুগান্তর ধরি কী গান উঠেছে বাজি, কী সঙ্গীত তুলিয়াছে তান কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান, কী সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া মর্ম-মাঝে রণিয়া-রণিয়া, ওগো মহাকাল, হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি, নিরবধি বয়ে চলা ফল্গুধারা সম ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম তোমার বুকের ’পরে জাগাইয়াছে যদি প্রতিধ্বনি সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী, তবে ওই ভীষণ মৌনতা কেন আজ টুটিল তা? কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন? প্রসন্ন নবীন উদিল প্রভাত অকস্মাৎ, পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী, কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী। আর ভয় নাই, নাই ভয়, জীবনে-মরণে আজ, প্রভূ মোর, হোক তব জয়! এনেছে যৌবন তার বিচিত্র সম্ভার; বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেছে সে নব অতিথির বেশে। তারে আজ করিনু বরণ, তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হল আমার মরণ, ধন্য হল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী, তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি, উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল, চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম, নিরূপম উচ্ছ্বাসের উন্মত্ত ধারায়, জীবনের সূত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়! চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার লহ নমস্কার! তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর, তাই তুমি অমন সুন্দর।

প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ম-জন্মান্তরে সাধ মোর; অন্ধতার ঘোর রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ, ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্মেষ, বক্ষে তব নবজন্ম আশা মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন। বুদ্ধদেব বসুর সংক্ষিপ্ত জীবন বুদ্ধদেব বসু (নভেম্বর ৩০, ১৯০৮-মার্চ ১৮, ১৯৭৪) ছিলেন বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার।

বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত। বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের অল্প পরেই তাঁর মাতার মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্নাসব্রত গ্রহন করে গৃহত্যাগ করেন।

বুদ্ধদেবের শৈশব কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর তিনি কলকাতায় গিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌজন্যেঃ বুদ্ধদেব বসু ব্লগস্পট বুদ্ধদেব বসু: জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য লেখক: আবদুল মান্নান সৈয়দ | ২৮ নভেম্বর ২০০৮ ৬:৫০ অপরাহ্ন সৌজন্যে: আর্টস.বিডিনিউজ২৪.কম …কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে; কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ।

ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না। – ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’: বুদ্ধদেব বসু কল্যাণীয়াসু, গতকাল রাতে একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)-র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সাক্ষাৎকার দিলাম। সাক্ষাৎকার নিল অনুজোপম —————————————————————– আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা তুলনাহীন। সাধারণ বাঙালি লেখকদের মতো তিনি কেবল আত্মরচনায় তৃপ্ত ছিলেন না। অন্যদের কবিতায়ও অসম্ভব অভিনিবেশ দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বিচার তো করেছেনই, তাঁর সমসাময়িক কবিদেরও একত্রিত করেছেন। …এই যে সমকালীন কবিতার প্রতি সর্বব্যপ্ত আগ্রহ এ তো শুধু তাঁর সমকালীন সাহিত্যেই নয়, আগে পরেও বিরল। শুধুমাত্র এই আশ্চর্য গ্রহিষ্ণুতার কারণেই বুদ্ধদেব বসুকে সম্মান জানাতে বাধ্য হই আমরা। —————————————————————- মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দশ মিনিটের সাক্ষাৎকারে কী আর বলা যায়।

কিন্তু জাহাঙ্গীরের প্রশ্নমালা আমার ভেতরে যে-জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছে, সেটাই একটু বিশদ বলি তোমাকে। প্রথম প্রশ্ন ছিল বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য কোথায়। এই একটি প্রশ্নের জবাবে যা বলা যায়, তারই মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর সারসত্তা ছেঁকে তুলে নেওয়া যায়। — কবি হিশেবে বুদ্ধদেব বসুকে আমি জীবনানন্দ দাশের মতো তাঁর কালের মহত্তম কবি বলব না, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে’র মতো অসাধারণও তিনি নন। তারপরেও বুদ্ধদেব বসুকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আলোচনা কি আমরা করতে পারি? পারি না।

কেন পারি না? এ জন্যে যে, রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার তথা সাহিত্যের পৌরোহিত্য করেছিলেন তিনি। ঠিক এরকম নায়কত্ব বাংলা সাহিত্যে দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কালে। বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য এঁদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বরং তাঁর সাহিত্য-সংবেদন-ও-গ্রহিষ্ণুতার সঙ্গে তুলনীয় আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের কবি-সমালোচক এজরা পাউন্ড অথবা আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের কবি-সমালোচক গিওম আপোলিনেয়ার। কবি ছিলেন আপোলিনেয়ার।

কিন্তু আশ্চর্য, তিনি পা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৫৫ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.