আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শীতার্তদের পাশে আছি আমরা সবসময়...........

এবার শীতের তীব্রতা যে কতটা মারাত্মক, তা বোধহয় আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। হাতমোজা খুলে কীবোর্ড ধরতে গিয়েই আমার হাতদুটো তা খুব ভাল করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। গত বছর শীতে সিলেট থেকে কমলাপুরে নামলাম বেশ রাতে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, শত শত মানুষ যে যেখানে পারে ইচ্ছেমত শুয়ে আছে। ওদের গায়ে কি শীত লাগে না, এ নিয়ে ভাবতেই আমার অনেক্ষণ চলে গেল।

অভাব বোধহয় ওদের অনুভূতিকেও ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। তখন থেকেই মনের ভেতরে একটা ইচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। সেটি হল শীতার্তদের জন্য কিছু একটা করা। আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র রিয়েল ভাইয়ের কাছ থেকে যখন শুনলাম যে এবার শীতে আমাদের সি.এস.ই ডিপার্টমেন্ট থেকে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে, খুশিতে মনটা নেচে উঠল। শীতের তীব্রতা উত্তরবঙ্গে সবথেকে ভয়ানক।

সে ভয় আরও বাড়িয়ে দেয় উত্তরের মানুষদের অভাব-দারিদ্র্য। প্রতিবছর শীতে অনেকেই মারা যায়। কিন্তু তারপরও তারা বেঁচে থাকে। কারণ তারা পরিশ্রম করতে জানে, তারা শরীরের শক্তিকে কাজে লাগাতে জানে। আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধায়।

তাই আমাদের শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম গাইবান্ধাতেই হবে। আমার আনন্দ আর দেখে কে ? অর্থসংগ্রহের কাজ শুরু হল। ছাত্র-ছাত্রীরা যে যেমন পারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। আমাদের দেশে-বিদেশে থাকা বড় ভাইয়া-আপুরা এগিয়ে এলেন। এমন পূণ্যকাজের ভাগিদার কে না হতে চায়, বলতে পারেন? কাপড়-চোপড় কেনা থেকে শুরু করে বাঁধাই করা- সব দায়িত্ব নিল বড়ভাইয়ারা।

আমার দায়িত্ব পড়ল গাইবান্ধায় সবকিছু ঠিকঠাক করা। এদিক থেকে আমি আবার খুবই সৌভাগ্যবান। কারণ, আমার রয়েছে এমন একজন মামা, যার কাছে জীবনে কোনদিন কিছু চেয়ে পাইনি- এমন নজির নেই। মামাকে বলে দিলাম। আর কোন সমস্যাই নেই।

আমরা শীতবস্ত্র দেব গাইবান্ধার কামারজানিতে ব্রক্ষ্মপুত্র পাড়ের নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদেরকে, যারা হাড়কাঁপনো শীতের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে। প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যকে দেয়া হবে একটি করে জ্যাকেট,একটি সোয়েটার এবং একটি গলাবন্ধনী বা মাফলার। থাকবেন স্থানীয় চেয়ারমেন গোলাম সাদেক লেবু। থাকবেন গ্রাম পুলিশ। আমরা দিতে পারব দু’শ জনকে, মানে দু’শ পরিবারকে।

এবার শুধু যাবার জন্য অপেক্ষা। আমরা যাচ্ছি আট জন। রিয়েল ভাই,সাইফ ভাই,মিরাল ভাই,রুদ্র দা,জাকি ভাই,আকাশ ভাই, বন্ধু মেহেদী এবং আমি। ৬ তারিখ রাত সাড়ে দশটায় আমাদের বাস। শীতের কাপড়গুলোকে দশটি বস্তায় ভরানো হল।

আমাদের সাহায্য করল আমাদের জুনিয়ররা। সব সহ বাসে চেপে বসলাম। শীতের রাতে ফাঁকা রাস্তায় বাস খুব দ্রুত চলতে লাগল। গাইবান্ধায় পৌঁছলাম ভোর চারটায়। বাস থেকে নেমে স্থানীয় বাসদ অফিসে বস্তাগুলো রেখে আমরা বাসায় চলে গেলাম।

সকালে হালকা নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম। তখন বেলা দশটা-সাড়েদশটা হবে। রিয়েল ভাই জানালো, ফান্ডে এখনও বেশ কিছু টাকা-পয়সা আছে। সে দিয়ে আমরা স্কুলের আড়াইশ বাচ্চাদের জন্য কিনে নিলাম খাতা-কলম ও এনার্জি বিস্কুট। একটি পিকআপ জোগাড় করা হল।

বাসদ অফিসের সামন থেকে আমরা রওনা দিলাম। গাইবান্ধা শহর থেকে কামারজানি যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল। ব্রক্ষ্মপুত্র শুকিয়ে চলে গ্যাছে বহুদুর। বালুময় চর জেগে আছে এর সিংহভাগ জুড়ে। চারদিকে ফাঁকা।

হু হু করে শীতের বাতাস বইতে শুরু করেছে। এরই একপ্রান্তে গ্রাম। ঘর বানিয়ে আছে কিছু মানুষজন। চাষবাস করে জীবন চালায়। গোটা গ্রামে হাতেগোনা দু-একটি দালানঘর।

অধিকাংশই ছনের ঘর, কোনটার আবার টিনের চালা। আমাদের পিকআপ কামারজানিতে যাবার সাথে সাথেই অসহায় মানুষদের ভিড় বাড়তে লাগল। তখন দুপুর হয়ে গ্যাছে। তাই শুরুতেই আমরা চলে গেলাম স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে। বাচ্চাদের জন্য আমাদের আনা জিনিসগুলো দিতে।

পাশাপাশি দু’টো বিদ্যালয়-বাটিকামারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কড়াইবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে দু’টো বিদ্যালয়ে চলে গেলাম। বাচ্চাগুলো বেশ পরিপাটি হয়ে আমাদের ডাক পেয়ে স্কুলে চলে এসেছে। আমরা আসার সাথে সাথে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। আমরা হাসিমুখে ওদের বসতে বললাম।

ছিলেন ক্লাস টিচার। সবাই আমাদের সাহায্য করলেন। একটি ছেলেকে আমি কলম দিতে গেলাম। সাথে সাথে ছেলেটি বলে উঠল,স্যার আমি পেয়েছি। আমি কখনও আশা করিনি এইটুকুন বয়সের একটি ছেলে একটি অতিরিক্ত কলম পাবার লোভ ছেড়ে দেবে।

কেন জানিনা, মনটা বিশুদ্ধ একটা খুশিতে ভরে উঠল। এরপর শীতবস্ত্র বিতরণের পালা। দলে দলে আমাদের পিকআপের সামনে লোক এসে ভিড় করতে শুরু করল। মামা আগে থেকেই সবার জন্য স্লিপ এর ব্যবস্থা করেছিল। স্লিপ হাতে নিয়ে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমাদের শীতবস্ত্র বিতরণ……. এবং বাচ্চা কোলে নিয়ে একটি ছোট্ট মেয়ে……….. একটি লেদারের জ্যাকেট ছিল। দাম দশ হাজার টাকা। রিয়েল ভাই বলল, এমন একজনকে খুঁজে বের কর্ যে এদের মাঝে সবথেকে অসহায়। তার গায়ে দশ হাজার টাকার একটি জ্যাকেট থাকবে কিন্তু সে জানতেই পারবে না। কারণ জানতে পারলেই সে আর তা রাখতে পারবে না।

পাওয়া গেল এমন এক বৃদ্ধকে। একেবারে শেষের দিকে বিশৃঙ্খলা আর এড়ানো গেল না। সবার বাঁধা-নিষেধ অমান্য করে লোকজন আসতে শুরু করল। তাদেরকে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাই, এর মাঝে আবার দু-একজন এসে বলে তাদের পাওয়া কাপড় পাল্টিয়ে দেবার জন্য। শেষের বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে শেষে আমরা চলে এলাম কামারজানি বাজারে।

ঘুরে দেখলাম ব্রক্ষ্মপুত্র পাড়ের ভুট্টাখেত। স্থানীয় এক লোকের বাসায় দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। ফেরার পথে রওনা দিলাম সাড়ে চারটার দিকে। আমাদের সবার চোখেমুখে ক্লান্তি আর তৃপ্তি মাখামাখি করছে। শেষ বিকেলে সূর্য লাল হয়ে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে।

শীত বাড়তে শুরু করেছে। হু হু করে শীতল বাতাস বইছে। আমাদের হাত-মুখ শীতের বাতাসে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি না, আমাদের গায়ে বেশ ভারী ভারী কাপড় জড়িয়ে থাকা সত্বেও আমরা শীতের আক্রমনে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আর এখানকার মানুষগুলো এমন ছেড়া-ফাঁটা পাতলা জামা কাপড় পড়ে কিভাবে এই শীত পাড়ি দেয়?তারা কি সত্যিই এই শীত সহ্য করতে পারে?নাকি অনেকেই শেষ হয়ে যায়।

পেপার-পত্রিকায় তাদের খবর হয়ত কখনওই ছাপানো হয় না। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো, দেশের বিত্তশালীরা কেন যে আরও বেশি করে এদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না,কে জানে ? আগামী বছর আবার আমরা শীতার্তদের শীতবস্ত্র দেব। অনেক বেশি করে দেব, সবাইকে সাথে নিয়ে দেব। কি, সবাই থাকবেন তো আমাদের সাথে ?  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.