আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফ্লাইওভারে জড়িয়ে থাকা কিছু স্মৃতি



ছলছল চোখে ফ্লাই ওভারের দিকে তাকিয়ে আছে সারা। চোখ ভীষণ জ্বালা করছে। চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে ও। বার বার নিজেকে শাসন করার চেষ্টায় বিড়বিড় করছিলো, "কেন এমন হয়? আশ্চর্য! যে মানুষটা তোমাকে এত্ত কষ্ট দিয়ে গেলো তার জন্য দুই চোখ এখনও কেন ভেজাও?" প্রায় দুই বছর আগের কথা। বড়দিনের আগের দিন কনকনে শীতের সন্ধ্যায় এই এদিকটা দিয়েই গিয়েছিলো ওরা।

তখন ফ্লাই ওভার নির্মাণের কাজ চলছিল বলে রাস্তাটার এক পাশ আটকানো থাকাতে রাস্তাটা আরও সরু হয়ে গিয়েছিলো। ট্রেন যাবার সময় হয়ে যাওয়াতে কুড়িল রেলক্রসিঙের গেট ফেলে দেয়ায় আটকা পরে অনেকটা সময় এখানে বসেছিল ওরা। এরই মাঝে পাভেল আচমকা হাত বাড়িয়ে সারার বাম হাত আঁকড়ে ধরল। পাভেলের অস্বস্তি বুঝতে পেরে তার হাতের ভেতর থেকে সারা তার নিজের হাত টেনে নিলো। একটানে বাম হাতের আঙটি খুলে ব্যাগে রেখে হাসিমুখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "এখন ধরো।

আঙটি খুলে নিয়েছি। এখন আর অস্বস্তি লাগবে না"। থতমত খেয়ে পাভেল সারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। লজ্জাবনত মুখে ব্যাগের গায়ে ডান হাতের আঙুল বাজাতে বাজাতে মিটি মিটি হাসছিল সারা আর তার হাত নিজের হাতে জড়িয়ে নিয়ে বসেছিল পাভেল। অনেক অনেক কথা বলছিল পাভেল।

শ্রোতা হিসেবে সারা বরাবরই ভালো। ও শুধু যে শোনার ভান করে তা না। আসলেই মন দিয়ে সবার সব কথাই শুনে সে। আর পাভেলের কথা তো মন দিয়ে শুনবেই। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে দুই বছর বাদে বিয়ে করবে ওরা।

মুখ তুলে এক ঝলক পাভেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, "আচ্ছা, এই লোকটাকে যে আমি কত্ত ভালোবাসি এইটা কি সে জানে?" ঠিক তখুনি চোখে চোখ পড়ে গেলো। সারার পুরো গায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। অপলক দৃষ্টিতে পাভেলের চোখের দিকে চেয়ে চেয়ে রাস্তার পাশের লাইটপোস্টের আলোয় সে নিজেকে দেখতে লাগলো। -অ্যাই মেয়ে! অ্যাই! -হুম। -কি দেখছ অমন হা করে।

-হুম। -আরে আজিব তো! -হুম। -আরে! খালি হুম হুম করছ কেন? মুখ বন্ধ করো। রাস্তায় যে ধুলোবালি। মুখে ঢুকে যাবে।

-কই? -কই মানে? এইতো এতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়েছিলে আর খালি হুম হুম করছিলে। -কই? না তো! -আচ্ছা। তোমার কি হয়েছে? -কিছু হয়নি তো! আমার আবার কি হবে? -কি দেখছ এত্ত মন দিয়ে? -উমম ... আমাকে। -তোমাকে? -হুম। আমাকে।

-কোথায়? -উফ! নড়বে না একদম। তোমার চোখের ভেতর আমাকে দেখতে পাচ্ছি। নড়ে গেলে আর দেখতে পাবো না। -তুমি আসলেই একটা পাগলী। -হুম।

জানি তো আমি। ফিক করে হেসে দিলো সারা। সারার বাম হাত আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাভেল ও তার সাথে যোগ দিলো। হুড খোলা রিকশায় বসে হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো দুজন। -অ্যাই সারা! অ্যাই! -হুম? -কি হয়েছে তোমার? -কই কিছু না তো! -তোমার চোখ ভেজা কেন? -কই? না তো! -লুকাচ্ছ কেন? কি হয়েছে? -কিছু না।

-বাড়ির জন্য খুব বেশি মন কেমন করছে? -উঁহু। -তাহলে? -চোখে হয়তো ময়লা গেছে। -কই দেখি? মাহিন বাম দিকে সরে সারার গা ঘেঁষে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে বাতি জ্বালিয়ে দেখতে লাগলো আসলেই চোখে ময়লা পড়েছে কিনা। রুমাল দিয়ে সারার চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে নিতে নিতে বলল, -এই জন্যেই জানালার কাঁচ নামিয়ে বসতে মানা করেছিলাম। কথা না শুনে জানালা খুলে বসে এখন চোখের কি হাল করেছো দেখো।

দুই চোখই লাল হয়ে গেছে। এরপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, -সামনে রাস্তার পাশে একটু থামাও তো। গাড়ি থামতেই মাহিন এক লাফে নেমে গিয়ে দরোজা খুলে সারার দিকে পানির বোতল বাড়িয়ে ধরল। -চোখমুখ ধুয়ে নাও। ভালো লাগবে।

কথা না বাড়িয়ে বাধ্য মেয়েটির মতো চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ধুয়ে নিলো সারা। মুখ ধুয়ে মাহিনের হাতে বাড়িয়ে রাখা সুগন্ধিবিহীন সাদা টিস্যু টেনে নিয়ে মুখ মুছে নিলো সারা। ততক্ষনে মাহিন আবার তার পাশে এসে বসেছে। এবার আর জানালা খুলে নয় বরং সব জানালা বন্ধ করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে মাহিন। মাহিন সারার স্বামী।

মাত্র দুই সপ্তাহ আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। পাভেল স্বেচ্ছায় সারার জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। সারার অমন পাগলের মতো ভালোবাসাও তাকে আটকে রাখতে পারেনি। শীতের শেষের দিকের এক মাঝরাতে ফোন দিয়ে পাভেল বলল, -শোনো, আমি অনেক ভেবে দেখলাম যে আমাদের এই সম্পর্কটাকে আর সামনে এগিয়ে নিয়ে না যাওয়াটাই ভালো। এর চেয়ে ভালো তুমি তোমার পথে যাও আর আমি আমার পথে যাই।

-কি বলছ তুমি? -যা সত্যি ওইটাই বলেছি। -কি সত্যি? -তুমি যা কিছু শুনেছ। -আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি এই সব কথা বলছ? তুমি? -হ্যা। আমি।

-কেন? -কারণ আমি চিন্তা করে দেখেছি আমার জন্য দুই বছর তোমার অপেক্ষা করার মানে হল খামাকা সময় নষ্ট করা। আমার জন্য শুধু শুধু তুমি কেন সময় নষ্ট করবে? তুমি ইচ্ছে করলেই আমার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য একজনকে বিয়ে করতে পারো। -আমি তোমার চেয়ে যোগ্য একজনকে চাইনি কখনও। আমি শুধু তোমাকেই বিয়ে করতে চাই। -দুঃখিত।

আমি এখন আর এইটা চাই না। -পাভেল! তুমি কি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছ? -দেখো, আমার যা কিছু বলার ছিল তা আমি বলে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার যা ইচ্ছা তাই ভাবতে পারো। তোমার ভাবনাগুলিকে তো আর আমি বদলে দিতে পারবো না। তাই না? -আমাকে এভাবে একলা ছেড়ে যাচ্ছ তুমি? তোমাকে বাদ দিয়ে আমি যে কিছুই ভাবতে পারছি না।

সারার কথার কোনও উত্তর না দিয়েই ফোন রেখে দিয়েছিলো পাভেল। এরপর সারা অনেক ফোন করেছে তাকে। একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি পাভেল। অসীম ধৈর্য নিয়ে একের পর এক মেসেজ দিয়ে গেছে সারা। একটার ও উত্তর আসেনি ওপাশ থেকে।

রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কেঁদে কেঁদে পার করেছে ও। বাসায় সবাই দেখেও না দেখার ভান করে ছিলো। কেউ ওকে কিছুই বলার সাহস করেনি। আর ওদিকে সারার সব কিছুতেই রাজ্যের যতো বিতৃষ্ণা এসে ভর করেছিলো। এরই মাঝে এক মামাত বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে বাসার সবাই মিলে একরকম জোর করেই নিয়ে গেলো ওকে।

ওখানেই মাহিনের সাথে দেখা। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার কিছুদিন বাদেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হল মাহিন। প্রথম দিকে রাজি না থাকলেও মায়ের চাপাচাপিতে বিয়েতে রাজি হয়ে যায় ও। আর রাজি না হয়ে কিই বা করবে? বাবার মৃত্যুর পর মা অনেক কষ্টে ঘর চালাচ্ছেন। সারার বিয়ে না হলে ছোট বোনটার বিয়ে হবে না।

নিজের কারণে সবাইকে আর কষ্ট দেয়া কেন? সামনে ঈদ বলে রাস্তায় বেশ ভিড়। একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসতে চাইলো সারা। সে নড়ে উঠতেই মাহিন আদুরে গলায় জানতে চাইলো, -কি হয়েছে? -কিছু না। -বাড়ির জন্য মন কেমন করছে? -না। -এইতো ঈদের দিন বিকেলেই তোমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।

মন খারাপ করো না। হাত বাড়িয়ে সারার হাত ধরল মাহিন। ইতস্তত করে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নড়ে উঠলো সারা। এই ছেলেটাকে বিয়ের আগে থেকেই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আসছে সে। তবুও ছেলেটা কতো দরদী গলায় তার সাথে কথা বলে।

তার প্রতিটি খুঁটিনাটি কি রকম খেয়াল করে। সারাক্ষণই বাচ্চা মেয়ের মতো করে আগলে রাখছে তাকে। মাহিনকে এভাবে এড়িয়ে গিয়ে ভুল করছে না তো সে? না। অনেক ভুল হয়েছে। এবার আর কোনও ভুল নয়।

রিয়ার ভিউতে আড়চোখে তাকিয়ে সারা দেখার চেষ্টা করলো ফ্লাই ওভারটা এখনও দেখা যাচ্ছে কিনা। নাহ। পেছনে চলে গেছে ফ্লাই ওভার। সে চায় ওই ফ্লাই ওভার, পাভেল আর পাভেল সম্পর্কিত যা কিছু আছে সব তার দৃষ্টি সীমানা থেকে আর তার জীবন থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাক।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.