আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘৃণ্য সময় এবং হাতঘড়ির গল্প

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

সকালে পুব দিকে যেই সূর্যটা উঠেছে সেই সূর্যের আলো মাথার উপরে চারিদিকে নিজের ঝাঁঝালো উপস্থিতির সাক্ষর রেখে চলেছে অবিরাম । টর্চার সেলে গ্রেফতারকৃত কাউকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বের সময়গুলোতে সেই ব্যক্তি যেমন শূন্য অনুভূতি নিয়ে সেই সময়টা কাটায় বর্তমানে যেন ঠিক সেই সময়টাই চলছে । পশ্চীম দিকের গাছের ডালে চার থেকে পাঁচটার মতো পাখি ডেকে চলেছে তবুও কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । কিছু কিছু সময় এমন আসে ।

মানুষ দূরে থাক পাখির ডাকের জন্যেও কারো জীবন দুই সেকেন্ডের জন্য গতানুগতিকতার ঘেরাটোপ থেকে বাইরে বের হয়ে আসেনা । এমনই এক ক্রান্তিকালে আসন্ন প্রহরগুলো আরো বেশী বিপদসংকুল হয়ে উঠবে বলে ধারণা করতে থাকে স্টেশনের দুইশো গজ দুরত্বের বস্তিতে বাস করা তোরাব আলী । ক্র্যাচে ভর দিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে সে । এটা তার রুটিনওয়ার্ক । প্রতি বিকালেই কিছু সময়ের জন্য কাজটা সে করে থাকে ।

প্ল্যাটফর্মে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় । আজকে বুক ভরে বাতাস নেওয়ার সাথে সাথে আঁচ করতে পারে সামনের সময়টা বিশেষ ভালো যাবেনা । নিজের এই ভাবনার সাথে সাথে সে অস্বস্তিবোধ করতে থাকে । এরকম যে কোন অস্বস্তির প্রথম কোপটা বরাবর তার উপরেই যায় , তাদের উপরেই যায় । অস্বস্তি না থেকে উপায় কোথায় ? এই অস্বস্তি দূর করার জন্য প্রথমে মুখ খোলে সে ।

হাতের কাছে স্টেশনমাস্টারকে পেয়ে কথা বলতে যাবার আগে তার দিকে ভালো করে তাকায় তোরাব আলী । স্টেশনমাস্টারও তার মতোই চিন্তিত । কপালে ভাঁজ পড়া চেহারা নিয়ে এক কোনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ । সামনে কতো মানুষ আসছে যাচ্ছে অথচ তার বিশেষ কোন ভাবান্তর নেই । “ ও মাস্টার সাব , এমন চুপচাপ খাড়াইয়া রইছেন কিলা ? শইল ভালা নাই আপনের ? “ স্টেশনমাস্টারের বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হয়না তোরাব আলীর প্রশ্ন শুনে ।

কিছুক্ষণ আগে রেডিওতে দেশের খবর শুনেছেন । যা শুনেছেন তাতে মন ভালো থাকবার কোন কারণ নেই । আগের মতই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন । “ মাস্টার সাব , কিছু বলতেছেন না ? সবাইরেই তো দেখতেছি চলতে ফিরতে । আপনেই খালি খাড়াইয়া রইছেন একলা , ঘটনা কি ? “ “ চুপ থাকতো এখন , কথা বলিসনা ।

" তোরাব আলীকে থামিয়ে দেওয়ার পর স্টেশনমাস্টার রমেন দাশের কপালে আরো কিছু ভাঁজ পড়ে । রেডিওতে একের পর এক মন্দির , প্যাগোডা পোড়ানোর খবর আসতে থাকে । ইতোমধ্যেই মরেছে জনা বিশেকের মতো । এই পোড়ার দেশে লাশেরও জাত থাকে । মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত কোন আচড় ছাড়াই লাশের জাত মোহরাঙ্কিত থাকে ।

ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে অবস্থান করা নিজের পরিবারের কথা মনে করে ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছেন । স্ত্রী শেফালী , অষ্টাদশী কন্যা নীপা , বছর বারোর পুত্র সুমিত এদের চেহারা ভেসে উঠছে আর অস্থিরবোধ করছেন । এই ট্রেনটা সাড়ে ছয়টার ছিলো । দেশের অবস্থার জন্য এক ঘন্টা আগে নিয়ে আসা হয়েছে । হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন আর মাত্র মিনিট বিশেক আছে সাড়ে পাঁচটা বাজতে ।

তিনি এও বিলক্ষণ জানেন প্রশাসনের সহযোগীতায় শুয়োরের বাচ্চারা এই এলাকায় আক্রমন করবে , করবেই । দুইশো গজ দূরত্বের বস্তিতে কম করে হলেও আশিটি হিন্দু পরিবার বসবাস করে । গোটা চারেক মন্দির আছে সেই বস্তি থেকে আরো পাঁচশো গজ দূরত্বে । তবে তার সবচেয়ে বড় ভয় মিনিট বিশেক পরের ট্রেন যাত্রা নিয়ে । ট্রেনলাইনের স্লিপার উপড়ে অতর্কিত আক্রমন করাটা বেশ পুরনো এক পন্থা ।

এক ঘন্টা আগে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পিছনে এটা একটা বড় কারণ । রমেন দাশ নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকেন । তার সোনালী রঙের হাতঘড়িটা বিকালের সূর্যের অন্তিম আলোর মাঝে উজ্জ্বলতর দেখাতে থাকে । তোরাব আলী মাস্টার সাহেবের মন মেজাজের মতিগতি বুঝতে পেরে ক্র্যাচে ভর দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে যেতে থাকে নিজের আস্তানায় । নিজের ক্ষুদ্র মাথায় আরো একবার বুঝে নেয় সময়টা আজ ভালো যাবেনা ।

শ্যামাগঞ্জ বস্তির পুরো এলাকাটা জুড়েই চাপা আতংক । ধর্মবেশ্যাদের ভাংচুর , জ্বালাও – পোড়াওয়ের খবর ধীরে ধীরে মানুষজনের কানে আসতে শুরু করেছে । ঘন্টা দুয়েক আগেও বস্তির ভেতরেই বাচ্চা ছেলেপেলেরা অন্যান্য দিনের মতই ছোটাছুটি করছিলো । এখন জায়গাটা বেশ ফাঁকা । তাদের প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছে ।

অপেক্ষার এই প্রহর কনামাত্র আশা জাগানিয়া নয় । প্রতিটা ক্ষণ ভয়ের , অতিক্রম করা প্রতিটি মুহূর্ত হারানো জীবনে আরো কিছু হারিয়ে ফেলার সংকেত মাত্র । প্ল্যাটফর্ম থেকে তোরাব আলী নিজের আস্তানায় প্রবেশ করে বাতাসে আতঙ্কের ঘ্রাণ অনুভব করে । দুই গজ সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু জপ করতে থাকা নির্মলকে প্রশ্ন করে , “ ও নির্মল ভাবগুতিক কিছু বুঝতেছো নি ? আমি তো ভালা পাইনা কিছু । স্টেশনে গেছিলাম , মাস্টার সাবরেও দেখলাম একলা খাড়াইয়া থাকতে ।

কথা জিগাইলাম জবাব দেয়নাই কোন । চাইরপাশে খবর ভালা না শুনতাছি । কানে আইলো বিষ্ণু মন্দির নাকি পুড়াইয়া ফালাইছে ? “ “ তুমি তো মিয়া সকালের খবর আমারে শুনাইতেছো । “ কাষ্ঠ হাসি হেসে নির্মল উত্তর দিলো । “ পুড়াইছে তো পুড়াইছেই সৌমেনরে চেনোনা যে মিষ্টির দোকানদার ? তারেও কোপাইয়া মাইরা ফালাইছে ।

তার ঘর থিকা আইলাম ঘন্টা হইলো । বুইড়া মা , পরিবার , তিন মাইয়া মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া কাইন্দা চোখের পানি শুকাইয়াও ফালাইছে অতক্ষণে । তুমি মিয়া থাহো কোন দুনিয়ায় ? “ “ হ , আমি শালার এক বোকাচোদাই রইয়া গেলাম গা । স্টেশনে মাস্টার সাবের চেহারা দেইখাও বুঝতারিনাই ঘটনা কি । মাস্টার সাবের পরিবার সেই কত্ত দূরে ।

ভালোমন্দ কিছু হইয়া গেলে তার পরিবাররে দেখবো কেডায় কে জানে ? “ বলতে বলতে তোরাব আলী লক্ষ্য করলো তার ছোট ছেলে বশির গুটিগুটি পায়ে তার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে । খেঁকিয়ে উঠে দুই চারটা গালাগাল দিয়ে ছেলেকে ভিতরে পাঠিয়ে দেলো । নিজের পরিবারের উপরেও মেজাজ খারাপ করে মনে মনে গোটা দুয়েক খিস্তি করলো তোরাব আলী । এদিকে বিষ্ণু তার বস্তির চারপাশের দিকে লক্ষ্য করতে লাগলো সতর্ক চোখে । এর আগেও দেখেছে এমন আসন্ন আক্রমনের সূচনার কোন ইঙ্গিত বা আভাস কাছের কোন জায়গা থেকেই পাওয়া যায় ।

তাতেও বিশেষ কাজ হয়না । তাদের দাঁড়িয়ে থাকবার চল্লিশ গজ থেকে হইহই করে অস্ত্র হাতে নিয়ে একদঙ্গল শুয়োরেরা অবশেষে এসেই যায় বস্তিটায় । প্রথমেই কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় সুরেশের ঘরে । সুরেশের বউ ইন্দু বেরিয়ে আসতে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে আগুনের মাঝে ফেলে দেওয়ার পর তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকারের দৃশ্যে কিংকর্তব্যবিমূড় অবস্থা থেকে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে বিষ্ণু । তার সাথে তোরাব আলী ক্র্যাচে ভর দিয়ে দ্রুত চলতে থাকে ।

এদিকে চারিদিকে প্রবল চিৎকার , হইহই , জ্বালাও – পোড়াও , কোপাকুপিতে চারপাশের বাতাসের সেই নষ্ট ঘ্রাণ পুনরায় ফিরে আসে । বিষ্ণু গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ততোমধ্যে তার ঘর থেকে শুরু করে পরিবার – পরিজন আগুনে কয়লা হতে শুরু করেছে । তোরাব তার পরিজনদের অক্ষত দেখে তৎক্ষনাৎ তাদের অন্যদের সাথে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিলো । ক্র্যাচে ভর দিয়ে দুইশো গজ পার হবার পর একটু নিঃশ্বাস নিতে পারলো । চারিদিকে তখন আগুনের উল্লাস , ধর্মোন্মাদদের জয়োঃধ্বনি ।

পরিবার – পরিজন নিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রাতটা কাটাতে সেখানে পুনরায় আসলো তোরাব । চারপাশের দৃশ্য বর্ণনাতীত । রেল লাইনের স্লিপার উপড়ানো । চারপাশের অজস্র লাশের গন্ধে এক দমবন্ধকর পরিস্থিতি । বাতাসের সেই নষ্ট ঘ্রাণ নগ্ন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ।

ট্রেন যেই বিন্দু থেকে ছাড়ে তার একটু কাছে ক্র্যাচে ভর দিয়ে আসলো তোরাব আলী । দেখলো স্টেশনমাস্টারের নিথর দেহ পড়ে আছে । বিকালে তাকে শেষ দেখেছিলো নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে । মৃত্যুর বেলাতেও সেই একই দৃশ্য । তার মৃতদেহের আশেপাশে দ্বিতীয় কোন মৃত শরীর দেখা যাচ্ছেনা ।

তার উজ্জ্বল সোনালী রঙের হাতঘড়িটা এখনো হাতে রয়ে গেছে । তোরাব আলী ঘড়িটা দেখে সেকেন্ড দশেক কিছু ভাবলো । তারপর ধীরে ধীরে কবজি থেকে হাতঘড়িটা খুলে নিতে আরম্ভ করার সময়ে দূর থেকে একটা বৃদ্ধ কুকুর করুণ সুরে ডেকে উঠলো । তোরাব আলী অনেক চেষ্টা করছে । কিন্তু হাতঘড়িটা কিছুতেই মৃত স্টেশনমাস্টার রমেন দাশের কবজি থেকে খুলছেনা ।

নাকি খুলে যাক সেই ইচ্ছাটা খোদ তোরাব আলীরই কমে আসছে ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.