আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেকনোলোজি হয়ে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর ফ্রাঙ্কেস্টাইন

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে পরম শ্রদ্ধেয় লেখক বিনয় ঘোষ বলেছিলেন একবিংশ শতাব্দীর মানুষ মাত্র গোটাতিনেক কাজ করবে । এক – খাওয়া , দুই – রমন , তিন – সংবাদপত্র পঠন । তিনি “ বিপ্লব মহানগর মধ্যবিত্ত ও মার্ক্সবাদ “ এবং “ বিজ্ঞাপন ও মন “ শিরোনামে দুটি অনবদ্য লেখা তার “ মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ “ বইতে লিখে গিয়েছিলেন । ২০১৩ সালে এসে তার উপরিউক্ত দুটি লেখার সূত্র ধরে তারই উক্তিটিকে সম্প্রসারিত করলে বলা যায় সেই তিনটি কাজের সাথে আরো একটি কাজ সমাজের যেই শ্রেণীটির ‘ জনগণ ‘ থেকে ‘ নাগরিক ‘ এ উত্তরণ ঘটেছে তারা করছে , করতে বাধ্য হচ্ছে ।

এই শ্রেণীটি এক সময় টেকনোলজি গেলা শুরু করেছিলো । বর্তমানে টেকনোলোজিই তাদের গিলছে , বেহুশ করছে । ছয় মাস আগে যেই খবর শুনে তারা আনন্দিত হয়েছিলো পরবর্তীতে সেই খবরই কোনভাবে ব্যাকফায়ার করে তাদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় , দাঁড়াচ্ছে । সবই টেকনোলোজিকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার ফলাফল । কিন্তু হাতের মুঠোতে থাকা এই টেকনোলজি বালির মতো ।

যতোই ধরতে যাওয়া হবে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ততো পিছলে গিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে । ভোগপণ্যের প্রবল প্রাচুর্যতার এই যুগে অর্থনীতি , ‘ নাগরিক সমাজের ‘ জীবনযাপনের ধরণ দেখলে কার পক্ষে ঠাহর করা সম্ভব “ উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব “ এখনো কতটা ক্রিয়াশীল এবং প্রাসঙ্গিক ? ধরতে পারার কথা নয় । আপাতদৃষ্টিতে এফ্লুয়েন্ট এই শ্রেণীটিও এই তত্ত্বের ভিকটিমদের বাইরে নয় । তার সাথে প্রবল মুনাফাকেন্দ্রিক যুগের অনিবার্য পরিণতি ‘ এলিয়েনেশনের ‘ পরিণাম যা হয়েছে তা হলো এমনঃ আজকাল আলবেয়ার ক্যামুর ‘ আউটসাইডার ‘ উপন্যাসের নায়ক ‘ মারসোলকে ‘ খুঁজে নেওয়ার জন্য সুদূর আলবেনিয়াতে যেতে হবেনা । খোদ ঢাকা শহরেই অজস্র মারসোল ঘুরে বেড়ায় যারা নিস্পৃহ , উদাসীনকন্ঠে বলবে “ আমার মা গতপরশু মারা গেছেন ।

গতকালও হতে পারে । “ কিংবা তারা হতে পারে রবীন্দ্রনাথের ফটিক । সুস্থ – স্বাভাবিক অবস্থাতেই টেকনোলোজির ভিকটিম হয়ে তারা করুণ সুরে নিরন্তর বলে যেতে পারে “ এক বাও মেলেনা , দো বাও মেলেনা , মেলেনাআআআআ । “ খুবই প্রত্যাশিত । মানুষকে যন্ত্র বানিয়ে নিয়ে কার্যসমাধা করা যায় কিন্তু দিনের শেষে মানুষ যন্ত্র নয় ।

বুর্জোয়া সংবিধানের বিচারে যেই নাগরিক সত্তাকেই উপজীব্য করে মানুষ বিচার্য প্রকৃতপক্ষে সেই পরিচয়ও মানুষকে যথার্থভাবে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ । মানুষ এমন হলে মানুষের দ্বারা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা সম্ভব ছিলোনা , দর্শন চর্চা করা সম্ভব ছিলোনা । দিনকে দিন মানুষ সিনিকাল হচ্ছে , আপাদমস্তক ব্রুটাল হচ্ছে , নিষ্ঠুর হচ্ছে এর সবই মানুষ যে যন্ত্র নয় তার প্রমাণ । তথাকথিত সমাজবিজ্ঞানীরা , সমাজবিশ্লেষকরা ‘ সমাজের অবক্ষয় ‘ , ‘ নৈতিক অধঃপতন ‘ নামক কিছু অস্পষ্ট , বিমূর্ত ধরণের কথাবার্তা বলে বিষয়গুলোকে বাইপাস করার চেষ্টা করুক তাতে আখেরে কাজ হচ্ছেনা , কাজ হবেওনা । সমাজকে বিচ্ছিন্ন , ক্ষুদ্রভাবে দেখানোর এবং ব্যাখ্যা করার কারিগর মনোবিজ্ঞানীদের কৃত্রিম চাহিদা তৈরী করেও এসব সমস্যার সমাধান হবেনা ।

কারণ দিনের শেষে সেই ‘ এলিয়েনেশন ‘ এমনই এক জগদ্দল পাথরের মতো দৃশ্যমান – অদৃশ্যমান হয়ে আমাদের সবার কাঁধে চেপে আছে যা আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো সিস্টেমের প্যারালাল হয়ে উঠেছে । বলা হচ্ছে টেকনোলোজি আমাদের হাতের মুঠোতে । কোথায় ? তাহলে আমাদের হাতের মুঠোতে থাকবার পরেও আমরা কেন জানতে পারিনা “ রাইট টু ইনফরমেশন “ আইনটি থেকে আমরা মানে রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন জনগণ কিভাবে বঞ্চিত ? আমাদের কি কারণে মনে হয় এনজিও কোম্পানীর পণ্যের সহজে সঞ্চালনের জন্য নয় বরং জনগণের চলার পথকে সুগম করতে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে ? দুই দশক যাবত কাঁচা পড়ে থাকা রাস্তা পাকা করা হচ্ছে ? সরকার কোন রাষ্ট্রের সাথে যে কোন চুক্তি করলে তার সম্পর্কে প্রায়শই আমরা যথাযথভাবে জানতে পারিনা কেন ? কি যুক্তিতে আমরা এই ভেবে শান্তিতে বসে থাকতে পারি গরীবের বন্ধু ডঃ ঈউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ ঝেটিয়ে দারিদ্র্যতা হটাচ্ছে ? যেমনভাবে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী “ গরিবী হটাও “ বলতে প্রকৃতপক্ষে বুঝিয়েছিলেন “ গরীব হটাও “ তার সাথে এই ক্ষুদ্র ঋণের মটোর কোন পার্থক্য নেই এটা আমরা টেকনোলোজির সাহায্যেও কেন বুঝতে ব্যর্থ ? কি কারণে আমাদের মনে হয় র্যারব দেশ থেকে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করছে ? সন্ত্রাস দমন করছে ? তাহলে হরতালে পিকেটারদের জ্বালানো-পোড়ানোতে দেদারসে মানুষ মরছে কেন ? প্রশ্নগুলা উদয় হয়না কেন আমাদের মধ্যে ? আমরা ভিকটিম হইনা বলে ? আমরা ভিকটিম হবোনা এমন কোন নিশ্চয়তা আমরা কোন এক দৈবক্রমে পেয়েছি বলে ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে গেলে কোনভাবেই কি মনে হবে টেকনোলোজি আমাদের হাতের মুঠোয় ? উত্তর হবে “ না । “ যদি প্রশ্ন করা হয় টেকনোলোজিই কি খোদ আমাদের গিলছে ? সৎ স্বীকারোক্তি হবে “ হ্যা । “ ১৯৯০ দশকে বিশ্বায়ন নামক সেই তথাকথিত ফেনোমেনা আমাদের অর্থাৎ সাধারণ জনগণকে এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো ।

তারও প্রায় আড়াই দশক পর এসে আমরা সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে হাঁসফাঁস করছি । একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখতে পারছি টেকনোলোজির চেয়ে বড় কোন কমোডিটি আর নেই । একইসাথে দেখতে পারছি সেই ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জকে পরাজিত করতে না পারলে আমাদের সম্ভাব্য পরিণতি গণহারে অসহায়ের মতো অস্ফুট কন্ঠে ফটিকের মতো বিড়বিড় করে যাওয়া “ এক বাও মেলেনা , দো বাও মেলেনা , মেলেনাআআআআ । “

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।