আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ নিয়ে বহির্বিশ্বে উৎকণ্ঠা

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ এখন নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে এই দেশটির প্রতি ভিনদেশের সাংবাদিক, আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বেশ মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছেন। সর্বশেষ তাতে যোগ দিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের যে শহরটিতে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলাম, সেই শহর থেকে দুটি মাত্র পত্রিকা বের হতো। পত্রিকাজুড়ে থাকত ওই শহর আর পার্শ্ববর্তী এলাকার খবর।



পেছনের পৃষ্ঠায় নিচের দিকে ছয় কলাম ইঞ্চির মতো জায়গায় থাকত বিশ্বসংবাদ। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের দু-এক লাইনের সংবাদ ছাপা হতো। সংবাদের নমুনা—বাংলাদেশে দুই মাথাওয়ালা শিশুর জন্ম অথবা যৌতুকের দাবিতে বউ পিটিয়ে মারার ঘটনা। অবশ্য সেই যুগ এখন পাল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রও এখন স্বীকার করেছে, বাংলাদেশ থেকে আর কিছু না হোক অন্তত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তারা তালিম নিতে পারে।

সেই যুগের তুলনায় এখন বাংলাদেশের অনেক সংবাদ, ভালো এবং মন্দ দুটোই বিদেশের পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয় আর ইদানীং বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গন এত সংবাদের জন্ম দেয় যে বিদেশের গণমাধ্যম ইচ্ছা করলেও তা থেকে দূরে থাকতে পারে না।

সম্প্রতি যে সংবাদটি বাংলাদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে পাকিস্তানের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানির ৩ নভেম্বর লাহোর থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি নিউজ পত্রিকায় ছাপা একটি লেখা, যেখানে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তুমুল সমালোচনা করে তাঁর পারিবারিক বন্ধু সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি এও বলেছেন, বাংলাদেশে, বিশেষ করে লাখ লাখ পাকিস্তানি সমর্থক আছে। তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে সমালোচনা করেছেন।

খাকওয়ানি বর্তমানে ক্রিকেটার ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট।

পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ধারণা, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ মদদে দলটি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দলটির তালেবানদের সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তেহরিক জামায়াতে ইসলাম ও কট্টর মৌলবাদী দল কওমি ওয়াতান পার্টির সঙ্গে মিলে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে।

২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের সময় বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের এক অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছিল, তা এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। আবার বাংলাদেশকে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী দলগুলো নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও বেআইনি অস্ত্র চোরাচালানের রুট হিসেবেও ব্যবহার করত।

বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ একবার এদের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা বলে অভিহিত করেছিলেন। চমৎকার ওকালতি যুক্তি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হলে খালেদা জিয়ার সরকার আন্তর্জাতিক মহলে তুমুলভাবে সমালোচিত হয়।

উইকিলিকস কর্তৃক ফাঁস করা দলিল থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস আর মরিয়ার্টি তারেক রহমানের ব্যাপারে ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠিয়ে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে যেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া না হয়।

তখন বিএনপি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা খুবই নেতিবাচক থাকলেও তা বর্তমানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার দৌড়ঝাঁপ দেখলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, তাদের আগের সে ধারণা অনেকটা পাল্টেছে।

সম্প্রতি মজীনা দিল্লি গিয়েছিলেন বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিএনপির পুনরায় ক্ষমতায় ফেরা সম্পর্কে ভারতের মনোভাব জানতে। দিল্লিযাত্রার আগে মজীনা বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করেন। বৈঠক করেন খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে।

দিল্লি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, মজীনার এই সফর ছিল তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে, অনেকটা রবাহূত। যদিও দিল্লি মজীনার সফরে কিছুটা বিরক্ত, তথাপি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কারণে মজীনাকে তারা যথাযথ সম্মান দেখিয়েছে এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু-একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন।



দিল্লি কূটনৈতিক ভাষায় সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ কাকে নির্বাচিত করবে, তা তাদের নিজস্ব বিষয়, সেখানে ভারতের বা অন্য কারও কিছু করার নেই। তারা আরও বলেছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করেছে, তাতে দিল্লি সন্তুষ্ট। ভারতের পূর্বাঞ্চল আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ ও শান্ত।

ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে মজীনা সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অভিন্ন মত পোষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, এটি একটি বিভ্রান্তমূলক উক্তি।

কারণ, বাংলাদেশের নির্বাচন সে দেশের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। ১ নভেম্বর সাংবাদিক সুবির ভৌমিক টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে লিখেছেন, দিল্লির কোনো কোনো কূটনীতিবিদ মনে করেন মজীনা এখন অনেকটা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যের মতো আচরণ করছেন।

মজীনা সম্ভবত ভুলে গেছেন, ১৯৭১ সালের ভারত আর ২০১৩ সালের ভারত এক নয়। ভারত এখন একটা উঠতি পরাশক্তি এবং আগামী দিনগুলোতে এই অঞ্চলে দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিক কারণেই দিল্লি নিজ দেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সব সময় অগ্রাধিকার দেয়।



গত ২৯ অক্টোবর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভারতী জৈন টাইমস অব ইন্ডিয়ায় একটি প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আগের ধারাবাহিকতায় যদি বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফেরে, তা হবে ভারতের জন্য শঙ্কার কারণ। ভারতী লিখেছেন, ১৯৯১ সাল থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আইএসআই কীভাবে সহায়তা করেছে, তা আইএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান আসাদ দুররানির জবানিতে ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতী আরও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সামনের নির্বাচনে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাহলে আবারও বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আইএসআইয়ের সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পর্ক আছে বলে ভারতের একাধিক পত্রপত্রিকা খবর দিয়েছে, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি পরিষ্কার হয়েছে যে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের এবং ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য আছে।

ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গত শুক্রবার পিটিআইয়ের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে বলেছে, ওবামার সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে সহিংসতা বৃদ্ধি এবং মৌলবাদী শক্তির উত্থান ভারতসহ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ওবামা মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে আগামী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব আর পাকিস্তান বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে আগ্রহী। সৌদি আরব আর পাকিস্তানের চাওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে তাদের একমাত্র লক্ষ্য মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের যেসব শীর্ষস্থানীয় নেতা অভিযুক্ত, তাঁদের মুক্ত করতে জামায়াতকে সহায়তা করা। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়।

সামনের নির্বাচনে যদি ক্ষমতার পালাবদল হয়, বাংলাদেশ আবার জঙ্গিবাদের বিচরণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, তাহলে এই জঙ্গিবাদের ঢেউ তখন শুধু বাংলাদেশ বা ভারতের পূর্বাঞ্চলে সীমাবদ্ধ না-ও থাকতে পারে।

তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যাটি এবং মিয়ানমারের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তা প্রবেশ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্র দেশ থাইল্যান্ডে এবং সে দেশের ইসলামি জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে একটি অশুভ আঁতাত গড়ে তুলে এই পুরো অঞ্চলকে তারা অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। সেই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা বাংলাদেশে গণতন্ত্র রপ্তানি আর জঙ্গিবাদ দমনের নামে বহুজাতীয় শান্তির দূতদের বাংলাদেশে পাঠাতে উৎসাহী হতে পারে। যেমনটি ইরাক, মিসর, লিবিয়া অথবা তিউনিসিয়ায় হয়েছে এবং বর্তমানে সিরিয়ায় চেষ্টা করা হচ্ছে।

তবে শেষ কথা, দেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে তারা ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন।

ইরাক, মিসর অথবা লিবিয়ার মতো একটি চরম নৈরাজ্যের দেশ, নাকি একটি সম্ভাবনা আর প্রগতির বাংলাদেশ। দেশের মানুষ যেমনটি চাইবে, ঠিক তেমন দেশই হবে। অন্য দেশের নেতা-নেত্রীরা কী বললেন, তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না। বেশির ভাগ সময় তাঁরা অন্যের শান্তি ও সমৃদ্ধির বিনিময়ে নিজের উদ্দেশ্যই হাসিল করতে চান।

আগামী বছর ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে, তা নিয়ে সে দেশের মানুষ তেমন বিচলিত নন।

কারণ, এর আগেও বিজেপি ক্ষমতায় ছিল। তাতে তেমন একটা কিছু যায়-আসেনি। তারা বিচলিত নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে। যে নরেন্দ্র মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ ভিসা দিতে অস্বীকার করে, সেই রকম একজন ব্যক্তি গান্ধী-নেহরুর দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে তা নিশ্চয় সে দেশের মানুষের জন্য স্বস্তির কারণ হবে না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.