আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘মেলায় জীবন্ত তাহের’

তাহেরের সেই স্বপ্ন নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়কদ্বীপে এই মেলার আয়োজন।  
মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তি তাহের, ৭ নভেম্বরসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও প্রতিবেদন নিয়ে প্রদর্শনীর পাশাপাশি এ প্রজন্মকে গল্পে গল্পে শোনানো হয়েছে তাহেরের জীবনী।
গল্পে গল্পে ওই জীবনী শুরু হয়েছে তাহেরের ১০ বছর বয়সের একটি ঘটনা দিয়ে। সে সময় তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চাকরি করতেন সিলেটের জুড়ী রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার হিসাবে।
১৯৪৭ সালের শেষ দিকে ওই ঘটনায় শাফাত বক্স নামের এক ডাকাত এক হিন্দু সাধুর সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল।

আশেপাশের লোকজন কেউ ওই ডাকাতকে বাঁধা দেয়ার সাহস না পেলেও শিশু তাহের একাই তার পথ আগলে দাঁড়ান। পরে সাধারণ মানুষও যোগ দেয়া তার সঙ্গে।
কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর, আসামের বদরপুরে। নেত্রকোনার পূর্বধলা থানার কাজলা গ্রামে তার পৈত্রিক নিবাস।
কৈশোরে চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ স্কুলে পড়ার সময়ই ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন তাহের।

১৯৫৯ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে নেন স্নাতক ডিগ্রি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন তাহের। এরপর ১৯৬০ সালে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর ও শিয়ালকোট রণাঙ্গনে লড়াই করে আহত হলে বীরত্বের জন্য খেতাব পান তাহের। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সেনানিবাসে থাকাকালে স্বাধীনতাকামী একদল বাঙালি যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।


১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২০ জুলাই মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন পাটোয়ারিকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের অ্যাটোবাবাদ থেকে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান তাহের, যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান তিনি।
১৪ নভেম্বর নিজের জন্মদিনে ঢাকার প্রবেশদ্বার কামালপুরের শত্রু ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানোর সময় আহত হন তাহের। তার বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ওই ঘটনার পর চিকিত্সার দিনগুলোতে ভারতের হাসপাতাল থেকে দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি এবং পরে সেনাবাহিনী থেকে তাহেরের পদত্যাগপত্রও রাখা হয়েছে মেলার প্রদর্শনীতে।


মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে লেখা সেই চিঠিতে তাহের বলেছিলেন, “যখনই তোমরা কারো বাড়িতে আশ্রয় নাও, তোমাদের উচিত তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজে সাহায্য করা। ”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীকে ‘উত্পাদনমুখী’ করার পরিবর্তে ‘ব্যারাকবন্দি’ রাখায় তিনি পদত্যাগ করেন।
ফাঁসির আগে স্ত্রী-স্বজনদের উদ্দেশ্যে হাতে লেখা তাহেরের শেষ চিঠিও স্থান পেয়েছে মেলায়।
 
ডাসের পেছনে আয়োজিত এই মেলার এক কোনায় রয়েছে তাহেরের ব্যবহৃত কৃত্রিম পা, স্ক্র্যাচ, কয়েকটি লাঠি, সামরিক পোশাক, বেল্ট, প্যান্ট, রক্তমাখা একটি শার্ট, প্লেট, পানি খাওয়ার গ্লাস ও ঘড়ির মতো কিছু সামগ্রী।
প্রহসনের বিচারে ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার ৩৭ বছর পর তাহের মেলায় জীবন্ত হয়ে উঠলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের, যিনি উত্পাদনমুখী সেনাবাহিনী আর সাম্যের সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন।


৩৬ তম তাহের দিবস উপলক্ষে শিশু কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় আসা ছবিও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
মেলায় আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে তাহেরের সঙ্গে তার পরিচয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ থেকে সেই পরিচয় আরো ঘনিষ্ট হয়।
“এক সময় বুঝতে পারি, তাহের অন্যদের মতো ছিলেন না। এমন কি তিনি অন্য মুক্তিযোদ্ধা বা সেক্টর কমান্ডারদের মতোও ছিলেন না।

আজকের এই মেলা একটি অসাধারণ আয়োজন। সবকিছু এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন মেলাতেই জীবন্ত হয়ে উঠেছেন তাহের। ”
আগে থেকে তাহের মেলার খবর না জানলেও এক ভর্তিচ্ছুকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে আসা মাহমুদুল বলেন, “তাহেরের মেলা হচ্ছে দেখে না এসে পারলাম না। ”
তাহের কে ছিলেন- এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরের চা দোকানের কর্মচারী রবিউল হাসান রবি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাহের স্বাধীনতার যুদ্ধ করছিল। তারে শত্রুরা ফাঁসি দিছে।


মেলায় ঘুরে, ছবি দেখে এবং অনুষ্ঠানের মাইকে শুনেই তাহের সম্পর্কে এই ধারণা পেয়েছেন পড়ালেখা না জানা রবি।
আরিফুর রহমান নামে অন্য আরেক দর্শনার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কর্নেল তাহের সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। তাহের একজন রাজনৈতিক দার্শনিক ছিলেন। তাকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরা উচিত। গ্রামে গ্রামে এ ধরনের তাহের মেলা করা উচিত।


দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিলে প্রথম অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নিযুক্ত হন তাহের। সেনাবাহিনী ছাড়ার পর ১৯৭২ সালের অক্টোবরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর টালমাটাল পরিস্থিতির তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি হলেও ৭ নভেম্বর তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্ত হন তিনি।
ওই ঘটনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়া, হন দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক।
এর কিছুদিন পর তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তাকে দাফন করা হয় নেত্রকোনার কাজলায় পারিবারিক গোরস্তানে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে কর্নেল তাহেরের আরো ছয় ভাই ও দুই বোন সরাসরি অংশ নেন। এদের মধ্যে চারজন বীরত্বসূচক খেতাব পান। চার সহোদরের খেতাব পাওয়ার দৃষ্টান্ত মুক্তিযুদ্ধে আর নেই।


২০১১ সালের ২২ মার্চ হাই কোর্ট ওই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
এতে তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি কথিত সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করারও নির্দেশ দেয়া হয়।
রায়ে বলা হয়, তখনকার সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার তাহেরকে বিচারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল।
জিয়া জীবিত না থাকায় তার বিচার সম্ভব নয়। তারপরও এ হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা উচিত বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।