আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ... ...

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই,তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। (http://www.ishakkhan.blogspot.com)

“দশ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে”। আমার গায়ে তাই লেখা আছে।

সেই সাথে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সই, জলছাপ ইত্যাদি। এই মুহূর্তে আমার গা ঘিনঘিন করছে। সারা গায়ে আঁশটে গন্ধ। মাছওয়ালার ভেজা হাত থেকে একজনের পকেটে ঢুকলাম কীনা। একবার গোসল করে নিতে পারলে ভাল হতো।

তবে আমি একটা পার্চমেন্টের টুকরো, কে আমাকে গোসল করাবে? বৃষ্টিবাদলায় ভিজে গেলে আমাকে মেলে দিয়ে শুকিয়ে নেয় বড়জোর, কিন্তু কেউ গোসল করায় না। এর চেয়ে কয়েন হলে ভাল হতো। আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে অসংখ্যবার। সিগারেট কিনতে দু’হাজার তিনশো একষট্টিবার, চকোলেট কিনতে আটশো তিন বার, রিকশাভাড়ায় ... ... থাক, জটিল হিসাব, দরকার নেই। নানা রূপে এসেছি আমি।

কখনো আমার গায়ে টাঙ্গাইলের আতিয়া জামে মসজিদের ছবি ছিল, কখনো বায়তুল মোকাররম। একটা সময় প্লাস্টিকের দেহও ধারণ করেছিলাম। আমার গায়ে নানারকম আজব লেখা আছে। না, ছাপার অক্ষরে নয়, হাতে লেখা। এক ছোকরা আমার গায়ে লিখে দিয়েছিল, “একটা মন চাই”।

সেই সাথে নিজের ফোন নম্বর, ০১ ... ...। এখনো সে নিশ্চয়ই মন পায় নি। কারণ, আমার গায়ে লেখা ফোন নম্বর দেখে কোন তরুণী ডায়াল করে নি। এ যুগের মানুষ খুব সাবধানী, নয়তো ছোটখাটো জিনিস খেয়াল করে না। ব্যাংকে ছিলাম কয়েকদিন।

বেরুবার আগে অনেক নোটের সাথে মিশে ছিলাম। তবে স্তূপের একেবারে উপরে ছিলাম বলে ব্যাংকের লোকটা লাল কালিতে লিখে দিয়েছে, ১০x১০০। অর্থাৎ একশোটা নোটের মধ্যে আমি একটা। কোন এক বেকুব আমার গায়ে কীসের সিলও যেন মেরে দিয়েছে। মেশিনে গোণার পর শরীরটা কয়েকদিন বেশ ঝরঝরে ছিল! কত হাত যে ঘুরলাম।

পকেটমার থেকে পুলিশ, রিকশাওয়ালা থেকে শিল্পপতি। হ্যাঁ, বড় বড় ঘরেও গেছি। টাকার ব্যাপারে কারো কাছে কোন ভেদাভেদ নেই। পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাকে রীতিমতো ঈশ্বরের মতো গণ্য করা হয়। এখানে সরাসরি কেউ বলে না, তবে আচরণে সে ভাবটা স্পষ্ট।

একজন আমাকে নাকের সামনে ধরে নিজের ছেলেকে বলেছিল, বাজান রে, মূল বিষয় হইল ট্যাকা। আর সব মামুলী বিষয়। ট্যাকা যার আছে, তার আর কিছুই লাগে না। টাকশাল থেকে নতুন বেরুবার দিনটার কথা মনে পড়ে। শরীরে কি আশ্চর্য মাদকতা মেশানো একটা গন্ধ ছিল, যে হাতে নিত সে-ই একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতো আর গন্ধ শুঁকত।

মানুষের লোমে ভর্তি নাকের ফুটো কাছ থেকে দেখতে দেখতে একটা সময় ঘেন্নাই ধরে গেছিল! এখন আর আমাকে কেউ শুঁকে দেখে না। আমার চেহারা বদখৎ, গায়ে বিশ্রী গন্ধ। ডাক্তাররা চিমটে দিয়ে ধরে। তারপরও যে আরামে আছি তা নয়। শত হলেও আমি টাকা।

একটা মেয়ে বুড়ি হয়ে গেলেও তার দিকে যেমন অনেকে খারাপ নজর দেয়, আমারও তেমনি শেষ দিন পর্যন্ত রেহাই নেই। শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। হাত ঘুরতে ঘুরতে, ধুলোবালি লেগে, অসংখ্য জানা আর অজানা রোগের জীবাণু মাখামাখি হয়ে, ভাঁজ খেতে খেতে, কচলানোর শিকার হয়ে আর মানুষের পশ্চাদ্দেশের নিচে থাকতে থাকতে আমার আর কিছু বাকি নেই। সারা গায়ে ব্যথা। হ্যাঁ, শেষ ব্যাপারটা তো রীতিমতো পীড়াদায়ক।

আমাকে পেছনের পকেটে নিয়ে গতকাল এক ধুমসো লোক সারাদিন গাড়ি চালিয়েছে। আমার থাকার জন্য কি সৃষ্টিকর্তা আরেকটু সম্মানজনক ব্যবস্থা করতে পারতেন না? আর কারো কারো রুচির তো বলিহারি যাই। জাঙ্গিয়ার গোপন খুপরিতেও আমাকে ঢোকাতে সংকোচ করে না। যেন টাকা বলে আমরা মানুষ না। তবে আমার একটা দিক ভাল।

ছোট নোট বলে কেউ এখনো ঘুষের কাজে, তদবিরে কিংবা ফাইলপত্র উদ্ধার করতে ব্যবহার করে নি। ওসব কাজে একশো, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট কাজে লাগে। আমার বিচরণ মূলত রিকশাভাড়ায়, চায়ের স্টলে, খুচরো বাজারে, ভিক্ষার পাত্রে, বড়জোর মসজিদের দানবাক্সে। কপালের ফেরে কয়েকবার ঢাকার বাইরেও গেছি! তবে আবার ফিরে এসেছি এবং রাজধানীর অনেকের পশ্চাদ্দেশের নিচে বসে এখান থেকে সেখানে ভ্রমণ করছি। সেদিক থেকে মেয়েরা আমার সাথে বেশ ভদ্র আচরণ করে।

তাদের কোলে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে মাঝেমধ্যে আরাম করে ঘুম দিই। একবার জেল খেটেছি। হ্যাঁ, একটা বাচ্চা মেয়ে যখন তার মাটির ব্যাংকে আমাকে বন্দী করে ফেলেছিল তখন বছরখানেক আলোর মুখ দেখিনি। যেদিন ব্যাংক ভেঙে বের করল, তখন সে কি খুশি! এখন আর আমার আদর নেই। কেউ যখন এতখানি জিভ বের করে থুথু দিয়ে বিশ্রীভাবে আমাদের গোণে, তখন নাড়িভুঁড়ি উল্টে বমি আসে, কিন্তু কিছু বলতে পারি না।

টাকা দেখলে বোবার মুখেও কথা ফোটে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, টাকা নিজে কোন কথা বলতে পারে না। পারলে বলতাম, ও ভাই, একটু আস্তে, কিছুটা থুথু মুখের ভেতরই রেখে দাও! স্কচটেপ পড়েছে দু’জায়গায়। তবে ঠাহর না করলে বোঝা যায় না। বুদ্ধিমান কেউ কেউ প্রথম প্রথম দুয়েক দানা ভাত দিয়ে জোড়া লাগাতে চেষ্টা করেছিল।

শরীরের কলকব্জা খুলে পড়তে আর দেরী নেই ভাই। ক’দিন এভাবে টেনেটুনে চলবে জানি না। আজকাল অনেকেই আমাকে দেখে বলে, ভাই পাল্টে দেন। একটা সময় হয়তো আমি একেবারেই অচল হয়ে যাবো, পুড়িয়ে ফেলা হবে। আমার জায়গা এসে দখল করবে অনেকদিন আগে আমি যেমন দেখতে ছিলাম, ঠিক তেমন কোন চকচকে দশ টাকার নোট।

আমার মতোই রঙ হবে ওটার, তবে অনেক উজ্জ্বল। সবাই শুঁকে দেখবে, যত্ন করে মানিব্যাগে রাখবে। ওটার গায়েও লেখা থাকবে, “চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দশ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে”। ছাপা অক্ষরে লেখা থাকবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। তারপর আমার মতোই একদিন মলিন হয়ে যেতে শুরু করবে।

মানুষের সাথে থাকি বলেই হয়তো মানুষের সাথে আমাদের অনেক মিল। (৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।