আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাশকতার নেপথ্যে কারা

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

গত সপ্তাহে হরতাল ছিল না দেশে। তার পরও তাণ্ডবে উত্তপ্ত ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে থাকা সীতাকুণ্ড উপজেলা। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও গত সাত দিনে এখানে ভাংচুর করা হয়েছে শতাধিক গাড়ি। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বন্দর থেকে নিয়ে আসা অর্ধশত পণ্যবোঝাই গাড়ি।

লুট হয়েছে যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্রও। পরিকল্পিত এ নাশকতা থেকে রক্ষা পেতে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও আনসারের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন পয়েন্টে। সীতাকুণ্ডে ৫২ কিলোমিটার মহাসড়কে যান চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে মোতায়েন রাখা হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত শতাধিক সদস্যকে। তার পরও শান্ত করা যাচ্ছে না অগি্নগর্ভ সীতাকুণ্ড। বরং দিন যত যাচ্ছে, ততই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সীতাকুণ্ডের পরিস্থিতি।

এ অবস্থা চলতে থাকলে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে চট্টগ্রাম। অচল হবে চট্টগ্রাম বন্দরও। সীতাকুণ্ডকে শান্ত করতে গত এক সপ্তাহে দফায় দফায় বৈঠক করেছে ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বুধবার সীতাকুণ্ড নিয়ে জরুরি বৈঠক করে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। এর আগের দিন মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নিয়ে বৈঠক করেন আন্তঃজেলা পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা।

প্রশাসনের টনক নড়াতে গত বুধবার ধর্মঘটেরও ডাক দিয়েছিল পরিবহন মালিক সমিতি। জেলা প্রশাসকের অনুরোধে পরে সে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয় তারা। তার পরও বন্ধ হয়নি তাণ্ডব। গত বুধবারও অন্তত এক ডজন গাড়িতে অগি্নসংযোগ ও ভাংচুর করে দুর্বৃত্তরা। গাড়ি ভাংচুর হয় বৃহস্পতিবার রাতেও।

গত সাড়ে ১০ মাসে শুধু সীতাকুণ্ডেই এমন অগি্নসংযোগ ও ভাংচুরের শিকার হয়েছে চার শতাধিক গাড়ি। আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন বলেন, সীতাকুণ্ডে চলমান তাণ্ডবে তাদের ক্ষতি ছাড়িয়ে গেছে ১০০ কোটি টাকার ঘর। জামায়াত নেতা আমিনুলের হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করলে আজ শনিবার রাত থেকে ফের তাণ্ডব চলতে পারে সীতাকুণ্ডে। কারণ, রোববার সীতাকুণ্ডসহ উত্তর চট্টগ্রামে হরতাল পালন করার হুমকি দিয়েছে জামায়াত। আবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে সোমবার থেকে সারাদেশে টানা হরতালের প্রস্তুতি নিচ্ছে ১৮ দলীয় জোট।

পুলিশ বলছে, সীতাকুণ্ডে এমন তাণ্ডবের নেপথ্যে রয়েছে বিএনপি। আর সরাসরি তাণ্ডব চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির। সীতাকুণ্ড থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী এখন সিঙ্গাপুরে; কিন্তু সেখানে বসেই কলকাঠি নাড়ছেন তিনি। ধনাঢ্য এ শিল্পপতি উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এলাকায় রয়েছে তার ব্যাপক প্রভাব। সীতাকুণ্ড এলাকায় থাকা শতাধিক শিপইয়ার্ডে আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নিম্নবিত্তের অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক।

অর্থের লোভ দেখিয়ে বহিরাগত এসব শ্রমিককে নাশকতার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন উপজেলা জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোস্তফা নূর, উপজেলা জামায়াতের আমির শফিকুল মাওলা, সেক্রেটারি আবু তাহের ও পৌর সভাপতি তৌহিদুল হক চৌধুরী । সামনে নির্বাচন থাকায় সীতাকুণ্ড নিয়ে নীরব আছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ আবুল কাসেম মাস্টার। এলাকায় তার সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরীর গ্রুপিং রয়েছে। এটিকেও কাজে লাগাচ্ছেন জামায়াত ও বিএনপির নাটের গুরুরা।

যাদের দিয়ে গাড়ি ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট চালানো হচ্ছে তাদের সংখ্যা অন্তত তিন শতাধিক। তাণ্ডবের বিভিন্ন ঘটনায় এরই মধ্যে শতাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে মামলাও করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৪ এপ্রিলের নাশকতায় জড়িত ছিল উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের উত্তর কেদারখিল গ্রামের সারেং বাড়ির নুরুন্নবীর ছেলে জুয়েল, উত্তর বগাচতর এলাকার হাজি নুরুল আমীনের ছেলে রুবেল, দক্ষিণ কেদারখিল দর্জি বাড়ির হাজি মাহমুদুল হকের ছেলে মোশারফ, একই এলাকার ছবির আহম্মদ সওদাগরের ছেলে আকবর হোসেন, আবুল কাশেমের ছেলে আরিফ হাসান, শেখ আহাম্মদ মেম্বারের ছেলে আরাফাত, নুনাছড়া এলাকার আনোয়ার হোসেনের ছেলে ইমাম হোসেন ও নুর হোসেনের ছেলে ফারুক হোসেন। ৮ আগস্ট রাতে যারা মহাসড়কে তাণ্ডব চালিয়ে অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাংচুর করে তাদের মধ্যে রয়েছে জামায়াত নেতা হুসেইন মুহাম্মদ আশ্রাফ, তৌহিদুল আলম চৌধুরী, দিদারুল আলম, ইকবাল হোসেন, রায়হান উদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন, মিজানুর রহমান, চান মিয়া, তৌহিদুল ইসলাম, আজাদ, শামীম, খোরশেদ আলম, রুবেল, মহিউদ্দিন, তৌহিদুল, রুবেল, ইউসুফ হারুন, মোতালেব হোসেন, রিপন, নুরনবী, সাইদুল ইসলাম, এরশাদ, নাজিম উদ্দিন, সোহাগ, রেজাউল করিম, ফরহাদ, আজম, আলমগীর হোসেন, জামশেদ আলম, মেজবাহুল আলম, নুর উদ্দিন, জসীম উদ্দিন, জুয়েল, জাফর, ইমাম হোসেন, বাদশা ও আবদুল কাদের। মহাসড়কে গত ৯ নভেম্বর গাড়ি ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনায় জড়িত ছিল জামায়াত কর্মী সাইফুল ইসলাম ও রাকিব নামে দুই ব্যক্তি।

৬ নভেম্বর উপজেলার মাদামবিবিরহাট এলাকায় সংঘটিত তাণ্ডবে নেতৃত্ব দেয় ছাত্রদল নেতা শাহাদাৎ হোসেন, সাইফুল ইসলাম, রহিম উদ্দিন ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মিয়া। আর পন্থীছিলা এলাকায় নাশকতা চালায় কুতুবউদ্দিন, মামুন ও নোমান। গত ১৬ নভেম্বর নাশকতা চালানোর ঘটনায় জড়িত ছিল সীতাকুণ্ড সদরের আবুল বশর, মাইনুল ইসলাম ও কারিমুল মাওলা। গত ৭ মার্চ ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতালে সীতাকুণ্ড পয়েন্টে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দেয় জাফর, সবুজ, হারুন, একরাম, সাহাব উদ্দিন ও রাজু। সীতাকুণ্ড থেকে নাশকতার পয়েন্ট বিস্তৃত হচ্ছে মিরসরাই পর্যন্ত।

গত ৪ অক্টোবর মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের ভালুকিয়া গ্রামের মাহমুদুল হাসান ও বারৈয়ারহাট পৌর এলাকার মেহেদীনগর গ্রামের মেহেদী হাসান সোহাগকে নাশকতার সরঞ্জামসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। সীতাকুণ্ডের পাশাপাশি মিরসরাইয়ে নাশকতা পরিকল্পনা হচ্ছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে তারা। গত ১৭ নভেম্বর নাশকতা পরিকল্পনার সময় অভিযান চালিয়ে ১৯ জামায়াত-শিবির কর্মীকে আটক করে র‌্যাব ও পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুই কেজি গানপাউডার, একটি পিস্তল, ৭টি কিরিচ, ৫টি চাপাতি, ৫ লিটার পেট্রোল, জাহাজের পাঁচটি সিগন্যাল লাইট উদ্ধার করা হয়। অচল হওয়ার পথে চট্টগ্রাম বন্দর :হরতালে অচল থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক; কিন্তু এখন হরতাল ছাড়াই তাণ্ডব চলছে মহাসড়কের সীতাকুণ্ড এলাকায়।

বন্দরে আসা পণ্যের ৭০ শতাংশ সীতাকুণ্ড পয়েন্ট দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ায় অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে বন্দরে। হরতালসহ নানা কারণে পণ্য আসা-যাওয়া কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে জমেছে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রায় ২৬ হাজার কনটেইনার। যার ভেতরে আছে প্রায় আড়াই লাখ টন আমদানি পণ্য। বন্দরের বিভিন্ন জেটি ও বহির্নোঙরে থাকা ৩০টি জাহাজে আছে প্রায় ১০ লাখ টন পণ্য। আবার চট্টগ্রামের পাঁচ শতাধিক গুদামে আছে প্রায় তিন লাখ টন ভোগ্যপণ্য।

সীতাকুণ্ডে প্রতিদিন অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় বন্দর থেকে কিংবা গুদাম থেকে এসব পণ্য যেতে পারছে না দেশের অন্য কোথাও। কে কী বলেন :সীতাকুণ্ডে চলমান নাশকতা প্রসঙ্গে পুলিশের ডিআইজি মো. নওশের আলী খান বলেন, 'সীতাকুণ্ড অচল থাকলে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে চট্টগ্রাম। এ গুরুত্ব বুঝে ইতিমধ্যে সেখানে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প করা হয়েছে। প্রয়োজনে এ ফোর্স আরও বাড়ানো হবে। ' পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আকতার বলেন, 'সীতাকুণ্ডে তাণ্ডব চালানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি আমরা।

তারা প্রতিনিয়ত কৌশল পাল্টে নাশকতা চালাচ্ছে। আমরা তাদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াচ্ছি। ' পুলিশের সীতাকুণ্ড সার্কেলের এএসপি ইকবাল আলী বলেন, 'সীতাকুণ্ডকে পরিকল্পিতভাবে অচল করা হচ্ছে। এ জন্য আমাদের ফোর্স বাড়ানো হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে গ্রেফতার অভিযানও।

' চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'গত কয়েক দিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬৯টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। দশ মাসের হিসাব টানলে পণ্যসহ ক্ষতিগ্রস্ত এমন গাড়ির সংখ্যা হবে চার শতাধিক। এমন ধারাবাহিক নাশকতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি পণ্য, কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য পরিবহন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। ' সুত্র

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.