আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঁচতে পারলেন না রবিনও

নাহিদ মোড়লের মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা পরে মামাতো ভাই রবিনও পাড়ি দিল নাহিদের কাছে। তারা একসঙ্গে শীতের জামা কিনতে বেরিয়ে ছিল বাসা থেকে। আর জামা কিনে ফেরার পথেই পেট্রলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে একসঙ্গে বার্ন ইউনিটে পৌঁছেছিলেন দুই ভাই। স্বজন এবং সাংবাদিকদের রবিন জানিয়েছিলেন নাহিদসহ শীতের জামা কিনতে যাওয়ার কথা। কিন্তু আগুনের খরতাপে দুজনই পরাহত হয়েছেন মৃত্যুর কাছে।

গতকাল বিকাল ৩টায় মৃত্যু হয় রবিনের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জরুরি বিভাগের গেট দিয়ে ঢুকতেই পূর্ব পাশে বার্ন ইউনিটের স্বতন্ত্র ভবন। ভবনের নিচে চার-পাঁচজন মানুষের ছোট ছোট জটলা। কারও চোখে-মুখে আতঙ্ক, কারও চোখে পানি।

আবার কেউ অঝোরে কাঁদছেন। ফটকে আনসার বাহিনীর পাহারা। দুই তলা থেকে ভেসে আসছে গোঁঙানির শব্দ। কখনো যন্ত্রণায় কাতর মানুষগুলোর চিৎকার। দুই তলার ফটকে মানুষের ভিড়।

বাম পাশে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র। ডান পাশে সাধারণ ইউনিট। সেখানে পড়ে আছে আগুনে পোড়া আর বোমায় আহত মানুষ। শরীরের গভীর ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ভাগ্যহতরা। স্বজনদের চেহারা মলিন।

ঘুমহীন ঢুলুঢুলু চোখ, আর উসকুখুসকু চুল। এত কিছুতে খেয়াল নেই তাদের। শুধুই স্বজনদের আরোগ্য লাভের আকুতি। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) ফটকে তালা। চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আনসার বাহিনীর সদস্যরা।

জানতে চাইলে একবাক্যে বলেন, রোগীদের সমস্যা হচ্ছে, তাই প্রবেশ নিষেধ। বাইরে অগি্নদগ্ধ স্বজনদের প্রতীক্ষা। কেমন আছেন তাদের আপনজন সে সংবাদ জানতে আনসার সদস্যকে অনুনয়-বিনয় করছেন।

অপেক্ষারত স্বজনদের কিছুক্ষণ পর পর জানানো হচ্ছে সংবাদ। কিছুক্ষণ পর চিকিৎসক এসে জানাচ্ছেন তাদের প্রিয় মানুষটি না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার খবরটিও।

রোগীদের সেবায় নার্সদের দৌড়ঝাঁপ। চিকিৎসকদের ব্যস্ততা। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের বিছানায় শুয়ে আছে সজ্ঞাহীন পোড়া মানুষ। মুখে অক্সিজেন মাউস। হাতে-পায়ে স্যালাইন।

শরীরে সাদা ব্যান্ডেজ। মাথার পাশে মনিটরে নির্দেশনা আসছে রোগীর শারীরিক অবস্থার। গত পরশু যেই মানুষটি একসঙ্গে রাতে ঘুমিয়েছে সেই মানুষটিও এখন পোড়া মানুষের সারিতে। এমনটা মেনে নিতে পারছেন না রোগীর স্বজনরা। গতকাল বার্ন ইউনিটের পরিবেশ স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে আসছিল।

ভবন জুড়ে শুধুই হাহাকার।

আইসিইউর ফটকে চিৎকার করে কাঁদছিলেন আইসিইউর বেডে শুয়ে থাকা সজ্ঞাহীন আইনজীবী খোদেজা নাসরিন আক্তার সেলিনার বড় ভাই টুকু বাঙালি। তিনি বললেন, শাহবাগে আত্দহত্যা করলে এর চেয়ে যন্ত্রণা কম হতো। কিসের বাংলাদেশ। যেখানে জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই।

ক্ষমতার লিপ্সায় অশুভ রাজনীতির ডলাডলিতে আমার বোন কেন পুড়ে কয়লা হবে। পোস্ট অপারেটিভ কক্ষে শুয়ে আছেন আগুনে দগ্ধ রাজ্জাক। তাকে দেখতে আসা দুলাভাই লাল মিয়া জানান, রাজ্জাক সরকারি গাড়ি চালান। লক্ষ্মীবাজার থাকে। দুই সন্তানের বাবা।

একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির কিছু হলে তছনছ হয়ে যাবে তার সংসার। আইসিইউতে অচেতন শুয়ে আছে কিশোরী সুস্মিতা সেন। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন সুস্মিতার মা গীতা সেন। রূপালী ব্যাংকের শ্যামবাজার শাখার সিনিয়র অফিসার মাসুমা আক্তার। তার হাত-মুখ, মাথার চুল পড়ে লেপ্টে আছে।

মাসুমা স্পষ্ট করে কথাই বলতে পারছিলেন না। তবুও যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন, আমরা কি ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারব না? আমাদের আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হবে কেন? পাশে বসা উৎকণ্ঠিত বড় বোন আছমা বলছিলেন, তার বোন প্রতিদিনই অফিস শেষ করে বাসে বাসায় ফেরেন। হঠাৎ অপরিচিত ফোন থেকে বলা হয়, মাসুমা আগুনে পুড়ে গেছে। বার্ন ইউনিটে এসে দেখেন গায়ে সাদা ব্যান্ডেজ। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আল্লাহকে ডাকছিলেন শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা। দুই শিশুসন্তান আবীর আর শিশু অহনাকে নিয়ে স্ত্রী থাকেন মিরপুরের বাসায়। স্বামীর এমন অবস্থায় বোধ হারিয়ে সিটের পাশে বসে আছেন। বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, ভর্তি হয়েছেন ১৯ জন। সেখান থেকে স্কুলছাত্র নাহিদ মোড়ল (২২) এবং রবিনের (২২) মৃত্যু হয়েছে।

বাকি ১৭ জনের কেউই আশঙ্কামুক্ত নন। চিকিৎসক হোসাইন ইমাম জানান, ঢাকা কলেজের ছাত্র ওয়াহিদুর রহমান বাবু এবং পুলিশের এএসআই নুরুন্নবী বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। তাদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে আলাদা কেয়ার নেওয়া হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে শিশুপার্কের সামনে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে ছুড়ে মারা পেট্রলবোমার আগুনে সাংবাদিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও গাড়িচালকসহ ১৯ জন দগ্ধ হন। এদিকে গতকাল বার্ন ইউনিটে আহতদের দেখতে যান নির্বাচনকালীন সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুজিবুর রহমান ফকির।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, যারা জ্বলন্ত বাসে আর রেলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে তারা মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ হামলার নেপথ্যে রয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা। তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।