আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষ মারার নীতিহীন রাজনীতি

১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে গৃহহীন হয়ে দেশান্তর এবং হাজার হাজার মানুষের জীবন ও সংসারের ওলট-পালটের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের এই স্বাধীন ভূখণ্ড আর পতাকা অর্জন করেছিলাম। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আমাদের স্বাধীনতার মূল অর্জনগুলো থমকে যাওয়া আর ক্রমাগত পেছন যাত্রা। ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করলাম দু-দুটি সামরিক শাসন। এ সময়ে এসে জাতির রক্তমাখা লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখলাম সবেমাত্র যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলাম তাদেরই গাড়িতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক গৌরব নক্ষত্র জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বানালেন শাহ আজিজকে।

আর এভাবে শুরু হয়ে গেল রাষ্ট্রক্ষমতার মালিকানা আসল মালিকদের কাছ থেকে নকল মালিকদের হাতে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়া। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে এই স্রোতকে যেন আরও গতিবান করে তুললেন। আমাদের রাষ্ট্র দর্শনে ধর্মকে রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর তেমন পার্থক্য রাখা হলো না। এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আন্দোলন গড়ে তুলতে সময় লাগল প্রায় দীর্ঘ ৯ বছর।

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলনের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বর মাসে পতন ঘটল স্বৈরশাসক এরশাদ শাসনামলের।

ডা. মিলন ছিলেন চিকিৎসক এবং একজন পেশাজীবী নেতা। তাকে হত্যার জন্য দায়ী মনে করা হয় জেনারেল এরশাদকে। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ২৭ নভেম্বর ডাক্তারদের সমিতি-ড্যাব ডা. মিলন দিবস পালন করে থাকে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি সরকার নির্বিশেষে এ দিবসের সভাটিতে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এ বছর সরকার এমন একজনকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বানিয়েছেন যে হয়তো তিনি নৈতিক বল হারানোর কারণে এই সভায় উপস্থিত থাকেননি কিংবা মহাজোট সমর্থিত ডাক্তারদের সংগঠন বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদকে দাওয়াত করার মতো নৈতিক সাহস প্রদর্শন করেননি।

এরশাদের পতনের পর আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশ শাসনের অংশীদারিত্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধবাদীদের দাপট হয়তোবা আর থাকবে না। কিন্তু না, বরং দেখা গেল ২০০১ সালে এসে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোট সরকারের নামই হয়ে গেল বিএনপি-জামায়াত সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদী মূল রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামের আমির এবং সাধারণ সম্পাদক দুজনকেই মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং এই পতাকাধারী দুজনই (মতিউর রহমান নিজামী ও মোহাম্মদ মুজাহিদ) হলেন যুদ্ধাপরাধী। বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত সরকার এক সময়ে পরিচিত হয়ে গেল জামায়াত-বিএনপি সরকার হিসেবে। গত কয়েক বছরে বিএনপির রাজনীতিও ভয়ানকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল জামায়াতের ওপর।

যেন তাদের নির্দেশনাতেই চলতে লাগল বিএনপির রাজনীতি ও সব কর্মকাণ্ড। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের মধ্যে এমনটি অনুভূত হওয়া খুবই পীড়াদায়ক। মাত্রাগতভাবে ভিন্নতা থাকলেও আমাদের বড় দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিদ্যমান এই ঝোঁক দেশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক তা সবাইকে ভেবে দেখার সময় এসেছে।

সম্প্রতি দেশের উচ্চ আদালত রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত ইসলামের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল করেছে। এখন দরকার ছিল পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করা জামায়াতের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা।

তাহলে হয়তোবা জামায়াত অনুসারী স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম তাদের খানিকটা হলেও পরিশুদ্ধ করার একটি সুযোগ পেতে পারত। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে আজ দল নির্বিশেষে রাজনীতিতে পেশি এবং ধ্বংসাত্দক শক্তির উত্থান প্রবলভাবে লক্ষণীয়। মাঠের রাজনীতি আজ কর্মী-সমর্থক অপেক্ষা এসব উগ্রবাদী ও ধ্বংসাত্দক শক্তির দখলে। গত তিন দিনে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দল আহূত অবরোধ চলাকালে আমরা তাই প্রত্যক্ষ করলাম। রাজনীতি আন্দোলনের নামে অবরোধ চলাকালের চিত্র হচ্ছে গত তিন দিনে নারী-শিশু কর্মজীবী নির্বিশেষে প্রায় ২৫ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ নাশ।

কম বেশি ৩০ জন মানুষকে পেট্রল বোমা মেরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা, শত শত বোমা এবং গুলির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষকে আহত করা, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলা-ফিসপ্লেট তুলে নেওয়া, বাস টেম্পো-রিকশায় অগি্ন সংযোগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গৃহে আগুন লাগানো ইত্যাদি হরেক রকম চিত্র ছিল সাম্প্রতিকে এই অবরোধ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। এখানে রাস্তায় নেতা-নেত্রী, কর্মী-সমর্থকদেরও তেমন একটা দেখা নেই। জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই।

কিছু বোমাবাজ আর সহিংস সন্ত্রাসী তরুণদের রাস্তায় নামিয়ে সমাজে এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে আন্দোলনের নামে এটি কী হচ্ছে তা আমাদের ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। পেট্রোল বোমা মেরে পুড়িয়ে দেওয়া মানুষগুলোকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি চিত্রের ওপর একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল ১৩/১১/২০১৩ তারিখে একটি পত্রিকায়।

তাতে বর্ণনা করা হয়েছে_ '১০ মিনিটের মধ্যেই পাল্টে যায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের জরুরি বিভাগের চিত্র। একের পর এক ঢুকতে থাকে দগ্ধ মানুষ। মুহূর্তেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ জনে। কারও পুরো শরীরের চামড়া খসে পড়েছে, কারও মুখমণ্ডল চেনা যায় না, দগ্ধ হয়ে কারও পিঠের চামড়ার সঙ্গে লাল মাংসও দেখা যাচ্ছে। কী বীভৎস বার্ন ইউনিটের সেই দৃশ্য'।

ঢাকা মেডিকেলের ১০৩ নং ওয়ার্ডে পঞ্চাশোর্ধ একজন মায়ের মৃত্যু নিয়ে তার মেয়ের আহাজারীর ওপর বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি প্রতিবেদন ছেপেছে, ১২-১৩ বছর আগে তার বাবা মারা গেছে। চার সন্তান নিয়ে অন্যের খাবার রান্না আর বুয়ার কাজ করে এই মা জীবন যুদ্ধে লিপ্ত। খিলগাঁওয়ে তিলপাপাড়ায় জামায়াত-শিবিরের একটি মিছিল থেকে পেট্রল বোমা মেরে তার গা ঝলসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে এনেও তাকে বাঁচানো যায়নি। আন্দোলন -অবরোধের নামে এটা কি মেনে নেওয়া যায়?

অতি সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককেও একটি বিশাল আন্দোলন চলছে।

সেখানে কয়েক দিন ধরে দুই লক্ষাধিক বিরোধী নেতা-কর্মী রাস্তায় জমায়েত হয়ে থাই সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় (অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) পর্যন্ত তাদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এখন তারা প্রতিরক্ষা দফতরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। কিন্তু সেখানে কতজন মানুষ মরেছে? কতজন অগি্নদগ্ধ হয়েছে? আমাদের জানামতে একজনও নয়। অথচ গত কয়েক দিনে আমাদের এখানে সারা দেশসহ কী ঘটছে ঢাকার রাস্তায়? আন্দোলনের নামে এই সহিংসতা কতদিন প্রত্যক্ষ করতে হবে আমাদের?

দেশে নির্বাচন হবে কি-না, কোনো দল নির্বাচনে যাবে আর কোনো দল যাবে না এজন্য এত মানুষকে কেন জীবন দিয়ে হবে? বাংলাদেশে এখন যেন এক ধরনের ঘোষণা দিয়েই প্রকাশ্য দিবালোকে আন্দোলনের নামে একদল লোক মানুষের মৃত্যুখেলায় মেতে ওঠেছে। রেলে সাধারণ গরিব মানুষ যাতায়াত করেন বেশি।

রেল অবরোধ করতে চাইলে তারা রেল লাইনের ওপর বসে পড়তে পারেন_সেখানে অবস্থান নিয়ে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু রেলের লাইন উপড়ে ফেলে কিম্বা ফিস প্লেট খুলে হাজারো যাত্রীর জীবন নিয়ে খেলবে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বেবিট্যাঙ্ িকিংবা লেগুনা নিয়ে ড্রাইভার চলছে কিংবা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে তখন ইচ্ছে হলে তাকে পেট্রল বোমা মেরে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হবে এটা কি মানা যায়? এসব কর্মকাণ্ড ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্য মানুষ খুন এবং তাদের জ্বলন্ত দেহ ও রক্ত নিয়ে এক ধরনের উল্লাস বৈ কি! অবিলম্বে এসব খুনিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় সোপর্দ করা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এখন নির্বাচন নিয়েই কেবল ব্যস্ত, যেন জনগণের জানমাল নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।

নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে সময় মতো(!) যদি সেনাবাহিনী নামানোর কথা ভাবা যায় তাহলে মানুষের জান মাল বাঁচানোর জন্য এখনই নয় কেন?

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

E- mail: Skasalam@gmail.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.