আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি চিঠি....(“গানে গানে ভালবাসা” এ্যালবাম থেকে)

যখন জ্বলে উঠি কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। প্রিয় জয়িতা, গতকাল সকালে তোমার চিঠি পেয়েছি। দু’দিন অফিসে যাইনি সারাদিন ধরে ভেবেছি। একবার ভেবেছিলাম তোমার চিঠির উত্তর দেব না। কিন্তু তারপর মনে হলো একদিন সময় মতো প্রপোজ করতে পারিনি আজ অন্তত ঠিক সময়ে সত্য কথাটা বলে ফেলাটা উচিৎ।

না জয়িতা… আমি কোলকাতা ছেড়ে গিয়ে দিল্লীতে থাকতে পারব না। এবং সেই কারণেই তোমার কাকুর দেয়া হিন্দুস্থান টমসনের চাকরীটা আমি নিতে পারলাম না। জানি তুমি রাগ করবে। রাগের মাথায হয়ত একটু বেশী গাঁজা, সিগারেট, মদ খেয়ে ফেলবে। কিন্তু এও জানি সে নেশা কেটে যাবে তখন বুঝতে পারবে কেন আজ আমি পিছিয়ে পড়ছি।

আসলে আমি বেসিকেলি ছা-পোষা ভিষনভাবে মধ্যবিত্ত, জানো! তাই আমার এই ছা-পোষা মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টটা আমি ছাড়তে পারলাম না। আমার যা কিছু পাওয়া সবই তো এই ছা-পোষা পরিবেশ থেকে পাওয়া। আমার মানিকতলার নোনা ধরা বাড়ির দেয়াল, স্যাঁতস্যাঁতে কলতলা, আমার মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচলের হলুদের গন্ধ এসব আমি ছাড়তে পারব না। আমার রাস্তা, আমার বাড়ি, আমার ফাটা দেয়াল, আমার পোড়া মনের অজস্র জঞ্জাল ভাঙছে কেবল ভাঙছে শুধু যাচ্ছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আমার রাত্রি আমারই সকাল একই ভাবে ঘামতে ঘামতে মনের ভেতর নামতে নামতে কোনমতে করছি দিনটা পার চলছে চলবে… চলছে চলবে… এই ভঙাচুরা গল্পটা আমার নাকে আমার পোড়া পিচের গন্ধ বুকে ধোঁয়া হাত পায়ে শুধুই অবক্ষয় তবু কাশতে কাশতে এখনো যে হাসতে পারি ভালবাসতে নিজের কাছে নিজেরই বিষ্ময় করব যে আর কত ঘিন্না নিজেই নিজের ছায়াটাকে করব যে আর কত অপমান আবার তো সেই আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিজের নাকটাকে গাইব আমি ভালবাসার গান এসো আমার ঘরে একবার, তুমি এসো আমার ঘরে একবার পারো যদি দেখে যেও বেঁচে থাকা কারে বলে এসো আমার শহরে একবার……………….. আমি এও জানি যে, আমার এই ভিষন ভাবে চেনা জানা আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা পরিবেশের সঙ্গে তুমি পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে না। আমাদের ধর্মটা আলাদা বলে নয়।

বিশ্বাস কর… না! আমাদের বড় হয়ে ওঠার মাঝে একটা বিশাল বড় ফাঁক আছে। তোমার স্বাধীন থাকার জেহাদ, তোমার উন্মাদনা, উচ্ছলতা, তোমার এক কথায় সবকিছুকে নস্যাৎ করে দেবার ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি, জয়িতা। আর করি বলেই তোমার মত একটা ভিষন ভাবে জ্যান্ত মানুষকে আমার এই ছা-পোষা মধ্যবিত্ত গন্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলতে চাই না। তোমায় এতদিন বলা হয়নি, বলার প্রয়োজন পড়েনি আজ বলছি- আমার একটা দাদা ছিল, জানো! পিসতুতো দাদা। ৭১’সালে পুলিশ এসে তাকে তালতলার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

ওর কলেজের বন্ধুরা ওকে নাকি কিছু রাজনৈতিক লিফলেট ওর বাড়িতে রাখতে দিয়েছিল। আমার নিরীহ, নিপাট, ভালমানুষ দাদাটা কিচ্ছু না জেনে সেই লিফলেটগুলো বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ ওকে প্রচন্ড মারে। সপ্তাহখানেক আটকে রেখে তারপর ভুল বুঝলে ছেড়ে দেয়। বাড়ি ফিরে আমার দাদা সোজা হয়ে হাঁটতে পারেনি।

একমাস কোনমতে কুঁজো হয়ে বেঁচে ছিল তারপর কিডনী ফেইলর হয়ে মারা যায়। যাই হোক… মানে মোদ্দা কথাটা হলো, যেটার জন্য এতসব বলছি সেটা হচ্ছে যে, আমার ঐ নিপাট, নিরীহ, ভালমানুষ দাদাটা সেদিন তালতলা থানায় তাঁর বন্ধুদের নামগুলো কিন্তু বলে দেয়নি। আমার সেই দাদাটার কথা আজ খুব মনে হচ্ছে, জানো! আমার ভাবতে ভাল লাগছে সে মানুষটা আমার দাদা। এবং তার সঙ্গে এটাও ভাবতে ভাল লাগছে যে, আমার মতন একটা কেবলা একটা ছা-পোষা ছেলে দিল্লীর অতবড় চাকুরী, ভবিষ্যৎ, সাউথ ইষ্টের সঙ্গে ফ্ল্যাট সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার সাহস এখনো রাখে। এবং তার জন্য আমি গর্বিত, জয়িতা।

তুমি আমার বন্ধু, তাই একদিন তুমি বুঝতে পারবে। (যারা আগেই শুনেছেন তাদের জন্য স্মৃতিচারণমূলক পোস্ট। আর যারা শোনেননি তাদের শোনার আহ্বান রইল। ) ………………………………………………………………… এ্যালবামঃ গানে গানে ভালবাসা (অঞ্জন দত্ত/নিমা রহমান) পত্র পাঠকঃ অঞ্জন দত্ত ডাউনলোড লিংক (পুরো এ্যালবাম): প্রথম অংশ, দ্বিতীয় অংশ, তৃতীয় অংশ, চতুর্থ অংশ, পঞ্চম অংশ, ষষ্ঠ অংশ, শেষ অংশ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.