আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমানা ছাড়িয়ে সাফল্যের আলো

চট্টগ্রামের চার তরুণ-তরুণী। বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত রয়েছেন তাঁরা। বিদেশের মাটিতে কাজ করলেও বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁদের অনেক স্বপ্ন। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছানো তরুণ মেধাবীদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন নিজাম সিদ্দিকী

ইনসুলিনের বিকল্পের সন্ধানে আদনান
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আদনান মান্নান ইনসুলিনের বিকল্প ওষুধ আবিষ্কারের জন্য কাজ করছেন। চট্টগ্রামের এই তরুণ সফল হলে বিশ্বের কোটি ডায়াবেটিস রোগী আশার আলো দেখবে।


আদনান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ভীষণ খারাপ লাগত যখন দেখতাম আমার নানু ডায়াবেটিসে কাতর হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। দুঃখ হতো পরিবারের অনেককেই সারা বছর ডায়াবেটিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগতে দেখে। তখন থেকেই ভাবতাম, একদিন ডায়াবেটিস নিয়ে কিছু করব। এখন সে কাজটাই করছি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম এবং ইনসুলিনের বিকল্প হতে পারে এমন একটি যৌগ নিয়ে কাজ করছি এবং শরীরের বিভিন্ন কোষে তার প্রতিক্রিয়া দেখছি।

আমরা সফল হলে পরবর্তী সময়ে এটি থেকে ডায়াবেটিসের নতুন ওষুধের নকশা করা যাবে। ’
বিজ্ঞানের প্রতি আদনানের ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে কিশোর বয়সে চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময়। আদনানের সবচেয়ে বড় প্রেরণা চিকিৎসক বাবা এম এ মান্নান। আর নতুন নতুন আইডিয়া খোঁজার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আবসার, অধ্যাপক মুহাম্মদ আরিফুজ্জামান, এলিস্টার এন্ডারসন ও ফ্রাঙ্ক ভনকেন।
আদনান বললেন, ‘জানি না কখনো সম্ভব হবে কি না, তবে আমার প্রিয় মানুষদের মতো বিশ্বের কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য একটা কার্যকর ওষুধের চূড়ান্ত নকশা করতে চাই, যা পাওয়া যাবে স্বল্প মূল্যে।

গবেষণাগারে যখন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করি তখন কষ্ট হয় না। কারণ ভাবি, আমি বাংলাদেশের ৩০ লাখ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য কাজ করছি। ’
আদনান মান্নান তাঁর স্বপ্নের চট্টগ্রাম সম্পর্কে বললেন, ‘২০৩০ সালে চট্টগ্রামের প্রতিটি ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে এটা দেখতে চাই, গ্রামের অবহেলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কাজ করতে চাই। ’
নাসরিন ও তাঁর ওষুধের রাজ্য
যুক্তরাষ্ট্রে লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স বিভাগে পড়ছেন চট্টগ্রামের নাসরিন জাহান। গবেষণা করছেন মানুষের শরীরে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ফার্মাকোকাইনেটিকস নিয়ে।


নাসরিন বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে ভেষজ ওষুধের মতো অনেক ওষুধকে নিরাপদ মনে হলেও সেগুলো আমাদের কিডনি ও লিভারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আমি এই বিষয় নিয়েই কাজ করছি। ’
গবেষণাকাজ শেষ করে দেশে একটি বায়ো-ইকুভ্যালেন্স গবেষণাগার (ল্যাব) গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন নাসরিন। এই গবেষণাগারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ওষুধ মানুষের শরীরে প্রয়োগের আগে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে প্রয়োগের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এ ধরনের ল্যাবে। দেশে এই ধরনের ল্যাব গড়ে উঠলে গবেষণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে।


নাসরিন ইতিমধ্যেই হায়ার স্টাডিস অ্যাব্রড নামের একটি অলাভজনক সংস্থার মাধ্যমে দেশের বাইরে অবস্থানরত বাঙালি গবেষক এবং শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছেন। তাঁর লক্ষ্য দেশের বাইরে অবস্থানরত বাঙালি গবেষকদের সঙ্গে দেশের শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের সমন্বয় ঘটিয়ে দেশে গবেষণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা। নাসরিনের সব কাজের অনুপ্রেরণা তাঁর মা। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পরে মা-ই তাঁর পড়ালেখা এবং জীবনে প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছেন। পড়াশোনা করেছেন দুটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে।

এ জন্য তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন।
প্রোগ্রামিংয়ের নতুন ভাষার খোঁজে শুভাশীষ
‘আমি বর্তমানে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা (ল্যাঙ্গুয়েজ) তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছি। আমার কাজের ভিত্তি ও উৎসাহ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময়। কথাগুলো বলছিলেন কানাডার ক্যালগোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী শুভাশীষ চক্রবর্তী।
গবেষক হওয়ার ক্ষেত্রে শুভাশীষের অনুপ্রেরণা ড. জামাল নজরুল ইসলাম, ড. জাফর ইকবাল ও বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক রবিন ককেট।

পাশাপাশি বাবা, মা ও বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণা তো আছেই।
শুভাশীষ মনে করেন, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বাংলাদেশিরা তাঁদের দক্ষতার ছাপ রাখছেন। কিন্তু সেই অর্থে প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না।
এটা নিয়ে অধিকতর গবেষণার জন্য বাংলাদেশে একটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ গবেষণাগার করতে চান, যেখানে নতুন ভাষার জন্ম হবে।
সৌরবিদ্যুতের কারিগর দেবযানী
জার্মানির আরডব্লিউটিএইচ আখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রী দেবযানীর স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বল্প খরচে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছানো।


সৌরবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তিকে আরও কত কম খরচে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, সেটাই তাঁর কাজের মূল লক্ষ্য। দেবযানী জানান, বর্তমানে তিনি বিশ্বের অন্যতম বড় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি জার্মানির ইনফিনিয়ন টেকনোলজিতে সৌরবিদ্যুৎ কোষের (সোলার সেল) ইনভার্টার নিয়ে কাজ করছেন।
দেবযানীর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর মা ও বাবা। তাঁরা দুজনে সব সময় বলতেন, পরীক্ষার ফলাফল নয়, জ্ঞান অর্জনই আসল কথা।
দেবযানীর স্বপ্ন হলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছানো।

দেশে সৌরশক্তি ব্যবহারের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত বেশি দামের কারণে সেভাবে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র (সোলার প্লান্ট) গড়ে ওঠেনি। যদি খরচ কমিয়ে আনা যায় তবে সহজেই এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এতে পরিবেশদূষণও কমবে।
প্রিয় শহর চট্টগ্রামকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেবযানীর। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম আমার জন্মস্থান, এখানেই আমার বেড়ে ওঠা।

তাই চট্টগ্রামকে নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস-আগ্রহ সব সময়ই একটু বেশি। আমার স্বপ্ন চট্টগ্রামে সৌরশক্তিবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার তৈরি হোক, যেখানে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা এসে দেশের মাটিতেই বিশ্বমানের গবেষণার সুযোগ পাবেন। ’

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।