আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাত্রলীগের ৮ জনের ফাঁসি ১৩ জনের যাবজ্জীবন

পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাশকে হত্যার দায়ে আট আসামির মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১৩ আসামিকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম নিজামুল হক এ রায় ঘোষণা করেন। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রায় ঘোষণার আগে গতকাল দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কারাগারে থাকা আট আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়।

রায় ঘোষণার পর আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আট আসামি হলেন পটুয়াখালী সদর উপজেলার টাউন কালিকাপুরের ফায়ার সার্ভিস রোডের মৃত আনসার আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম শাকিল ওরফে চাপাতি শাকিল, ভোলার দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম জয়নগরের আবদুর রহমানের ছেলে মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার নাসিরপুর কলেজ রোড এলাকার জি এম লুৎফর রহমানের ছেলে জি এম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাড়িয়াচারার মিজানুর রহমানের ছেলে কাইয়ুম মিয়া, যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচকাইবা পূর্বপাড়ার মৃত আকরাম আলীর ছেলে ইমদাদুল হক ওরফে এমদাদ, নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ী কোনাপাড়ার আবদুল হাইয়ের ছেলে সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল, নেত্রকোনার কলমাকান্দা বর্তমানে মনতলা উপজেলার কেশবপুরের সুষেন চন্দ্র তালুকদারের ছেলে রাজন তালুকদার ও রংপুরের পীরগাছা উপজেলার সুলি্লপাড়ার মীর মো. নুরুল ইসলামের ছেলে নূরে আলম ওরফে লিমন। এদের মধ্যে রাজন তালুকদার ও নূরে আলম পলাতক। বাকি ছয়জন কারাগারে আছেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ছাত্রলীগের বাকি ১৩ কর্মী হলেন এ এইচ এম কিবরিয়া, গোলাম মোস্তফা, খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন।

এদের মধ্যে এস এম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা কারাগারে আছেন। বাকি ১১ জন পলাতক রয়েছেন। আসামিদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ২৩ ডিসেম্বর রফিকুল ইসলাম শাকিল ওরফে চাপাতি শাকিল, শাওন, এমদাদ ও নাহিদ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এদিকে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালতপাড়ায় গতকাল সকাল থেকেই পুলিশ কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার করে। মোতায়েন করা হয় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাদা পোশাকের অতিরিক্ত পুলিশ।

এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোক আদালত চত্বর ঘিরে রাখেন। আদালত এলাকায় সাধারণ মানুয়ের চলাচলও সীমিত করা হয়। সন্দেহভাজনদের ব্যাগ ও শরীর তল্লাশি করা হয়। গতকাল রায় ঘোষণার সময় নিহত বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তমকুমার দাশ ও কাকাতো ভাই রবিন দাশ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর উত্তমকুমার দাশ সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা বিচার পেয়েছি।

এখন সাজা দ্রুত কার্যকরের জন্য সরকারের কাছে বিনীত আবেদন করছি। এ ছাড়া পাশাপাশি পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করার দাবি জানান তিনি। রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি এস এম রফিকুল ইসলাম রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আদালত সব কিছু বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন। প্রত্যাশিত রায়ই পেয়েছি। কিন্তু এ হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ১৩ আসামিকে এখনো খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।

তাই তাদের ঠিকানা খুঁজে বের করে দ্রুত গ্রেফতার করার দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করাতে আদালত থেকে পুলিশ বিভাগকে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পরে আসামিদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বহুল প্রচারিত জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এর পরও পলাতক ১৩ আসামি আদালতে হাজির হননি। দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ১৩ আসামি হলেন রাজন তালুকদার, ইউনুস আলী, ওবায়দুল কাদের তাহসিন, আজিজুর রহমান, আলাউদ্দিন, ইমরান হোসেন, মীর নূরে আলম লিমন, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, কামরুল হাসান, তারিক বিন জোহর তমাল, মনিরুল হক পাভেল ও মোশাররফ হোসেন।

অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায়ে তারা ন্যায়বিচার পাননি তাই এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

রায় ঘোষণার আগে বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডটি অন্য ১০টি হত্যাকাণ্ডের মতো নয়, এ হত্যাকাণ্ডটি বিভিন্ন দিক থেকে ব্যতিক্রম ও স্পর্শকাতর। কারণ এ হত্যাকাণ্ডটি রাতের অন্ধকারে বা গোপনে করা হয়নি। বরং প্রকাশ্য দিবালোকে এই আসামিরা ছুরি, চাপাতি, লোহার রড ও ধারাল অস্ত্র দ্বারা বিশ্বজিৎকে আঘাত করে হত্যা করেছেন- যা মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই পড়ে না। নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়।

বিচারক আরও বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, যা দেখে হতবাক ও আতঙ্কিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎকে নির্মমভাবে মারধর করে রক্তাক্ত করেন আসামিরা। এ হত্যাকাণ্ডে অপরাধ ও নিষ্ঠুরতা এমন পর্যায়ে ছিল, যা বহির্বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং অপরাধীদের এমন আচরণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বহির্বিশ্বসহ দেশের সব মানুষের কাছে ভুল বার্তা দেওয়ার প্রয়াস চলছিল। সামগ্রিকভাবে অপরাধের মাত্রা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করলে ন্যায়বিচার হবে বলে মনে করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। এ ছাড়া এ মামলার সাক্ষী বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত চন্দ্র দাশ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ছেলের শোকে কাতর হয়ে আহাজারি করেন।

তিনিও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করেছেন।

বিচারক বলেন, নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩ ধারায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কেননা ঘটনার দিন আসামিরা সবাই একত্রে অবরোধবিরোধী শোভাযাত্রা নিয়ে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন এবং আসামিদের ওই শোভাযাত্রার অধিকার মৌলিক ও আইনসম্মত ছিল। শোভাযাত্রায় মিলিত হওয়া আইনসম্মত হলেও পরবর্তীতে ওই শোভাযাত্রা বেআইনি হতে পারে। কেননা শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় কোনো সদস্য কর্তৃক যদি অন্য সদস্যকে আক্রমণ করা হয় এবং অন্যপক্ষের কোনো সদস্য যদি পালানোর সময় আক্রমণ করেন, তা বেআইনি বলে প্রমাণিত হবে।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এ মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে, রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/১৪৩ ধারায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। তাই এ হত্যাকাণ্ডটি নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত বিধায় কিছু আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আবশ্যক।

মামলার নথিসূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি সমর্থিত ১৮-দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০-২৫০ জন ছাত্র একটি অবরোধবিরোধী মিছিল বের করেন। পরে মিছিলটি ভিক্টোরিয়া পার্ক অতিক্রম করার সময় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা অবরোধবিরোধী মিছিলের পেছনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। এ সময় বিশ্বজিৎ দাশ দৌড় দিলে আসামিরা ধর ধর বলে কিরিচ দিয়ে পিঠে আঘাত করেন।

এরপর রক্তাক্ত বিশ্বজিৎকে চাপাতি, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন। গুরুতর আহত বিশ্বজিৎ আসামিদের হাত থেকে বাঁচতে শাঁখারীবাজারের দিকে দৌড় দেন। এ সময় রিপন নামে এক রিকশাচালক বিশ্বজিৎকে তার টেইলারিং দোকানে নিয়ে যান। সেখানে কাউকে না পেয়ে তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিশ্বজিৎ মারা গেলে এ ঘটনায় রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় মামলা করে পুলিশ।

পর দিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এরপর আট আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ৫ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক তাজুল ইসলাম। পরে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ১৯ মে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ বিশ্বজিতের বাবাসহ ৩৩ জনকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করে। উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপক্ষ ২৭ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.