আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বন্ধু রাশেদ!

ক্লাসে ফার্স্ট হয়েও কখনো ফার্স্ট হবার মর্যাদা উপভোগ করতে পারিনি, নতুন বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসের রোলকলে নিজের নাম শুনার জন্য ক্লাসের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। বাবার সরকারী চাকুরীর সুবাদে বাংলাদেশের অনেক জায়গাতে থাকা হয়েছে, বছর বছর স্কুলও পাল্টে যেতো। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি, উত্তরবঙ্গের কোন এক জেলায় থাকি। প্রতিদিন নিয়ম করে স্কুলে যেতাম, স্কুলের পাঠ শেষে ছয় বা আট ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ খেলে বাসায় ফিরতাম। তখন ক্লাস ফোরের মাঝামাঝি সময়, একদিন একটা বিষয় মাথায় আসলো।

ভেবে দেখলাম, গত পাঁচ-ছয়মাসে সকল সহপাঠীকেই খেলায় পেয়েছি শুধু একজন ছাড়া। গল্পের খাতিরে ধরে নিলাম বন্ধুটির নাম রাশেদ, আমার বন্ধু রাশেদ।
এরপর একদিন টিফিনের সময়ে রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম, ''তুই ক্লাস শেষে একদিনও ক্রিকেট খেলায় থাকিস না কেনো?''-রাশেদ কোন উত্তর না দিয়ে গোমড়া মুখ করে উঠে গেলো। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, প্রতিদিনের মতো সেদিনও ক্রিকেট খেলে বাসায় ফিরবো এমন সময় আরেক বন্ধু শাহীন বললো, ''রাশেদ খেলতে পারেনা কারণ ক্লাস শেষ হবার আধা ঘন্টা পর থেকেই ওর কাজ শুরু হয়''-আমি অবাক হলাম। আমারই সহপাঠী যার বয়স কিনা নয়-দশ হবে, সে স্কুলের ক্লাস শেষে কাজ করতে যায়।

যা শুনলাম তার সারমর্ম হলো, রাশেদ খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, অনেকগুলো ভাই-বোন, তার বাবা-মায়ের পক্ষে সকলের খরচ চালানো অসম্ভব। আর রাশেদ কিছুতেই পড়াশুনা ছাড়তে চায় না, তাই সে প্রতিদিন ক্লাস শেষে ইটের ভাটায় কাজ করতে যায়। ইটের ভাটা থেকে মাথায় করে ট্রাকে ইট তুলে দেয়া তার কাজ, ১০০ ইট তুলে দিলে ৩ বা ৪ টাকা পায় সে। আমার কচি মনটা সেদিন ব্যাথায় জর্জরিত হয়েছিল, মনে আছে সেদিন আমার চোখের কোণে জল এসেছিল।
এরপর যথারীতি বাবার বদলিসূত্রে নতুন শহরে চলে আসি।

দিন যায়, বছর যায়, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করলাম। বুয়েটে পড়ি তখন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বন্ধু ছিল, তাদের সাথে আড্ডা দিতে যেতাম কার্জন হলে। সেখানেই কাকতালীয়ভাবে ১১ বছর পর আবার দেখা রাশেদের সাথে, ততোদিনে রাশেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত ছাত্র। যেকোন রকম ভাল কাজে ডাকলেই রাশেদকে পেতাম, রক্ত দেয়ার জন্য ডাকলে সে টিউশনি রেখে পর্যন্ত ছুটে আসতো। রাশেদের মতো বন্ধু পাওয়াকে আমি নিজের জীবনের অন্যতম একটা বড় অর্জন বলেই মনে করি।

ব্যাচেলর শেষ করার পর আমি দেশের বাইরে চলে আসি, রাশেদও ঢাবিতে সাফল্যের সাথে মাস্টার্স শেষ করে দেশের বাইরে আসে পিএইচডি করতে।
দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, এমনি সময় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল কাদের মোল্লার (কসাই কাদের) বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষিত হয়, কসাই কাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। অভিযোগ প্রমানিত হবার পরেও ফাঁসির রায় কেনো দেয়া হলোনা এর প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তরুণ প্রজন্ম, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজন্ম চত্ত্বর। শাহবাগের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা দেশপ্রেমিক ছাত্র-ছাত্রীরা আয়োজন করে প্রতিবাদ সমাবেশের, ব্যানার-ফেস্টুন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, আয়োজন করা হয় আলোকচিত্র প্রদর্শনীর।
রাশেদ যে ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করে, তাতে আরো তিনজন বাংলাদেশী পিএইচডি স্টুডেন্ট আছে যার একজন রাশেদের সরাসরি শিক্ষক ছিলো।

বাংলাদেশী বেশ কয়েকজন আন্ডারগ্রেড স্টুডেন্ট আছে ওই ইউনিভার্সিটিতে। পিএইচডি স্টুডেন্ট তিনজনই শিবির এবং শিবির সহনশীল হার্ডকোর বিএনপি হওয়ায় রাশেদের ইউনিভার্সিটিতে শাহবাগ প্রজন্ম চত্ত্বরের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে কোন প্রোগ্রাম আয়োজনের পরিকল্পনা হচ্ছিল না, এ অবস্থায় আন্ডারগ্রেড স্টুডেন্টদের নিয়ে রাশেদই আয়োজন করে ফেললো মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। আরো ছিলো ব্যানার-ফেস্টুন প্রদর্শন এবং বিদেশী স্টুডেন্টদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানানো। এ প্রোগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার সময় দুই দফা রাশেদকে হুমকি-ধামকি শুনতে হয়েছে অন্য তিনজন পিএইচডি স্টুডেন্ট এর কাছ থেকে। তারপরও রাশেদ থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি আন্ডারগ্রেড স্টুডেন্টরা।

সফলভাবে প্রোগ্রাম শেষ করার পর জুম্মাবারে জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিল রাশেদ। জুম্মার নামাজ শেষে স্থানীয় মুসলমান কমিউনিটির সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগে রাশেদকে কটুকথা শুনানো হয়। তারপর বাড়ি ফিরে রাশেদ ফোন দেয় আমাকে, আমি বললাম পুলিশের কাছে অভিযোগ করা যায় কিনা। কিন্তু রাশেদ তা করতে চায়নি কারণ এতে বাংলাদেশী পিএইচডি স্টুডেন্টদের ক্ষতি হবে যাদের একজন কিনা রাশেদের সরাসরি শিক্ষক। দু:খে সেদিন রাশেদের গলা ভারী ছিল, কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট।


কসাই কাদেরের ফাঁসি হয়ে যাবার ঠিক পরপরই আমি রাশেদকে ফোন দেই, রাশেদের কথা শুনে তাকে বেশ খুশি খুশি মনে হলো। কথায় কথায় এদিনও রাশেদ কেঁদে দিল, ছেলেটা বড্ড ইমোশনাল। তবে এবারের কান্নায় কোন দু:খ ছিলোনা, সফল হবার অভিব্যক্তি ছিল, ছিল বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা, অনেক ভালবাসা।
------------------------- শব্দ পথিক ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.