আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাধারণ



অসাধারণ, অন্যরকম বা অন্যধারার একজন হয়ে উঠার লোভ আমার সবসময়। ৫ ভাইবোনের মধ্যে আমি হলাম সর্বকনিষ্ঠ। আর সবার বড় যে জন, আমার দিদি; তাকে দেখেই আমার এই লোভের জন্ম। সর্বকনিষ্ঠ আর বয়োঃজ্যেষ্ঠ এই দুই সদস্যের বয়সের পার্থক্য একডজন বছর। ক্লাস থ্রি ফোর পড়ার বয়সে যখন অল্প অল্প বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই মনে হতো দিদি যেন সবার চাইতে আলাদা।

ওর আত্মবিশ্বাস, আত্মসংযম, সহ্যশক্তি আমাকে সেই বয়সেই আকর্ষণ করতো। ওই বয়সেই মনে হতো দিদি যেন অসাধারণ কোন নারী। আমি কখনো ঠোঁটে রং লাগাইনি, গালে রঙ ফর্সাকারী ক্রীম মাখিনি, কানের দুল পড়েছি কালেভদ্রে। নারীকূলের অসাধারণ সাজের ভীড়েআমার সাধারণ সাজের কারণ অসাধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলবো বলে। আমার ফাগুণ বয়সে ভেবেছি কোন একদিন এক উপন্যাসের নায়ক এসে আমার হাতযুগল ধরে বলবে, তুমিই তো আমার অনন্যা।

আমার চুলের বিণুণি দুলবে পিঠে, আর হাজার হৃদয় দোলার কারণ হবো আমি। আমি হবো কারোর স্বপ্ন কন্যা, কারোর দীর্ঘশ্বাস, কারোর পথ দ্রষ্টা, আর পৃথিবীটার জন্য এক দৃষ্টান্ত। সময়ের স্রোতে স্কুলবালিকা আমি কলেজ আংগিনায় পদার্পণ করলাম। তবে, বালিকাসুলভ আচরণ আমাকে ছাড়তে পারলোনা। সহপাঠীদের মধ্যে কারো কারোকে দেখতাম তাদের জোড়া হাত ধরার জন্য আরেকজোড়া হাত খুঁজে চলেছে।

যারা খুঁজে পেয়েছে তারা তাদের ভবিষ্যত সঙ্গীর হস্তযুগল ধরে প্রেমের হাওয়ায় ভাসছে। যারা পায়নি তারাও মনের হাওয়ায় পাল তুলে নৌকা ভাসিয়েছে কোন একদিন সেই নৌকার মাঝি খুঁজে পাবার আশায়। আর যারা এই দুই দলের কোন দলেই নেই তাদের চশমাবিহীন অথবা চশমা চোখে দেখতাম ক্লাসে ভালো রেজাল্টধারী হওয়ার স্বপ্ন। “ইস্ কেমিষ্ট্রি তে যদি আরো দুই মার্কস বেশি পেতাম? ইস্ ক্লাসটা যদি না হতো? ইস্ পরীক্ষাটা কেন যে পিছালো? ইস্ পরীক্ষা যদি পিছাতো? ইস্ ছেলেটা এতো বিরক্তিকর! ইস্ মেয়েটা কি কিউট!” এসব হচ্ছে কলেজে আমার সহপাঠীদের যৎসামান্য ইসে্র নমুনা। কারোর মুখে বলতে শুনিনি – “ইস্ যদি অসাধারণ কেও একজন হতে পারতাম?” হয়তোবা মুখে না বললেও আমার মতো কেউ কেউ এই ইস্-টাকে বুকে বয়ে বেড়াতো।

অন্যধারার স্বপ্ন বুকে বয়ে বেড়ানো আমি ভাবতাম নিজেকে দেশ সেবামূলক কাজে নিয়োজিত করবো, কিন্তু ভাবনা ভাবনাই থেকে যেতো। বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠতোনা। ভাবতাম আরেকটু বড় হয়ে নিই, আমিই হবো এই দেশের মাদার তেরেসা। আরেকটু বড় হয়ে গেলাম। এবার কলেজের গণ্ডী পেরোবার পালা।

অসাধারণ নই আর সব সাধারণ মানুষের মতোই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মোটা মোটা ভর্তিপরীক্ষার গাইড গলধঃকরণ করতে লাগলাম। হজম যে হলোনা সেটা বুঝতে পারলাম, কোন মেডিক্যালেই চান্স না পাওয়ার পর। আমার তিন মাসের পড়াশোনা সমস্তটারই সলিল সমাধির সাথে সাথে আমার দু’চোখ সলিল ধারায় সকাল বিকাল প্লাবিত হতে লাগলো। ভুলে গেলাম অসাধারণ মানুষরা পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে এতো উদ্বিগ্ন কখনোই ছিলনা। ভুলে গেলাম নিজের ক্যারিয়ার গড়া নয়, দেশ গড়ায় আমার ব্রত ছিল।

ভুলে গেলাম আর পাঁচজনের মতো কান্না করা আমায় মানায়না। টিভিতে যে বিশ্ববিদ্যালটির ছবি সব চাইতে বেশি দেখেছি, কোন প্রিপারেশন ছাড়াই সেখানে পরীক্ষা দিলাম। আর বুঝতে পারলাম গত তিনমাসের পড়াশোনা হজম করতে না পারলেও এইচ,এস,সির পড়াশোনা আমি ভালোই হজম করতে পেরেছি। ফার্মেসী বিভাগে চান্স পেয়ে গেলাম আমি। ক্লাস শুরুর প্রথম কয়দিন গেলো নতুন-সহপাঠী, নতুন-স্যার, নতুন-ম্যাডাম, নতুন ক্লাস, নতুন ল্যাব এমনি অনেক নতুনের সাথে পরিচয় হতে হতে।

দিন যেতে না যেতে বুঝতে পারলাম, টিভিতে দেখা বিশ্ববিদ্যালয় আর বাস্তব এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পার্থক্য নিয়ে কোন প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন আসলে তার প্রশ্নমান হবে কমপক্ষে ১৫। এখানে মেয়েরা কেউই ফাঁকা ব্যাগ আর হাতে একটা বই আর একটা খাতার যুগল নিয়ে ঘুরেনা। বরঞ্চ কখনো কখনো ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে ব্যাগের কারণে কখনো কখনো হাতটাই বইয়ের বোঝাই হয়ে উঠে। ছেলেরা কেউ কেউ আসে বিশাল বইয়ের ব্যাগ নিয়ে, আবার কেউ শুধুমাত্র মানিব্যাগ নিয়ে। ক্লাসে আমরা ৬০ জন, রোল সংখ্যা ৬০।

এর মধ্যে প্রতি ক্লাসে ৩৩ নম্বরটিতে হাত তুলে আমাকে আমার উপস্থিতির জানান দিতে হয়। ৩ আর ৩। রোলটি আমার বেশ পছন্দ হলো কেন জানি। পাশাপাশি দু’টি যমজ সংখ্যা, মন্দ না। আমার পরে এমন দু’টো যমজ সংখ্যার রোলধারী যে জন তার নাম শুভ।

একদম চুপচাপ আর শান্ত ঘরানার ছেলে শুভ। চোখে চশমা, মোটামুটি হাইটের বৈশিষ্টবিহীন চেহাড়ার শ্যামলা ছেলে। ‘ক্লাসে তাকে আমি দেখেনি, দেখেছি তবে খেয়াল করিনি’ এর মতো শুভকেও আমি খেয়ালই করিনি তেমন করে। খেয়াল করলাম সেদিন যেদিন আমাদের নবীন বরণে এই শান্ত ছেলেটি লালনগীতি গেয়ে স্টেজ জমিয়ে দিয়েছিলো। কি ভরাট গলা শুভর!! আমি মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনেছিলাম সেদিন!! ভার্সিটিতে রক্তদান কর্মসূচীর একটা ক্যাম্প স্বেচ্ছা-সেবক জোগাড় করছিলো।

আমি নাম লেখাতে গেলাম সেখানে। দেখি শুভ বসে আছে। আমাকে দেখেই বললো- “এই মেয়ে তুমিতো আন্ডার ওয়েট। তুমি রক্ত দিলেতো নিজেই কিছু থাকবানা”। আমি মন খারাপ করে চলে আসতে নিচ্ছিলাম, শুভ তখনই মুচকি হেসে বললো- “আচ্ছা থাক সদস্য হয়েই যাও, কখন কি কাজে লাগো বলা যায়না”।

সেই প্রথম কারো জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়ে গেলাম আমি। শুভকে আমার ভালোই লাগতো। ওকে দেখতাম নানা দেশসেবামূলক কর্মসূচীর সাথে জড়িত। আমারো ইচ্ছা করতো ওর মতো হয়ে উঠতে। কিন্তু কিছু করতে না পারার অজুহাতের অভাব ছিলনা।

ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষা, পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা এইসবই ছিলো আমার অজুহাত। ‘ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়’ এই ভাবসম্প্রসারণটি ছোটবেলায় অনেকবার পড়লেও আমার অন্যধারার হয়ে উঠার কোন উপায়ই হচ্ছিলনা বা করে উঠতে পারছিলামনা। একদিন শুভ’র সাথে কথায় কথায় আমার দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছার কথাটা উঠে এলো। শুভ শুনে বললো, ‘তুমি চাইলেই তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে পারো’। ওর মুখে যা শুনলাম তা হচ্ছে, ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছে পথশিশুদের জন্য একটা ছোট্ট স্কুল শুরু করবে।

আমি চাইলেই ওদের সাথে যোগ দিতে পারি। আমি সানন্দেই রাজী হয়ে গেলাম ওদের প্রস্তাবে। আমি, শুভ, সাজ্জাদ, নিলয় আর অপর্ণার এই পাঁচ শিক্ষকের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সবমিলিয়ে ত্রিশজনের মতো। স্কুলের আসবাব বলতে একটা আমগাছ, একটা কালো-বোর্ড। ছোট স্কুলের নগন্য শিক্ষার্থীদেরও যোগাড় করা হয়েছে বিকালে হাল্কা টিফিন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে।

আমাদের পাঁচজন যে যার সুবিধামতো দিনের দুই শিফটে সময় ভাগ করে নিলাম। প্রথমদিন আমার কেমন জানি সংকোচ হচ্ছিল, জড়তা কাজ করছিল। বুঝতে পারছিলামনা কিভাবে কি বলতে হবে আগত পড়ুয়াদের সাথে? আমার কাজ ওদের কে বাংলা অক্ষরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। শুভ’র মধ্যে এধরনের কোন জড়তা ছিলোনা। এসে বললো- “বাচ্চারা, ইনি হচ্ছে তোমাদের আপা।

তোমাদের লিখতে পড়তে শিখিয়ে দিবে”। শুভর এই ছোট্ট পরিচয় পর্বের পর আমার জড়তা কেটে গেলো অনেকটাই। একে একে ওদের সবার সাথে পরিচিত হলাম আমি”। শুভর সাথে রোজ’ই দেখা হতো আমার। ছুটির দিনে ক্লাসে যেখানে আমরা শিক্ষক আর অন্যদিনগুলোতেও ক্লাসে যেখানে আমরা শিক্ষার্থী।

ভীষণ ভালো লাগতো ছেলেটাকে। ওর সাহস, কথা-বার্তা, কিছু করার ইচ্ছা, ওর দুষ্টামি সব কিছুই আমাকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করতো। কিন্তু ওর কাছে আমি কোনদিক থেকেই আকর্ষণীয় নই বলে মনে হতো আমার। প্রয়োজন ছাড়া কখনো ফোন দিতনা, স্কুলের কাজ শেষে কখনো কখনো একসাথে ফিরলে বলতোনা চলো এককাপ চা খেয়ে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন উপলক্ষ্যে শাড়ি পড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেও সে কখনো বলেনি – “ মায়া তোমাকে তো আজকে সুন্দর লাগছে ভারী!” আস্তে আস্তে উপলদ্ধি করতে পারলাম, আমি কেন জানিনা আজকাল শুধুমাত্র একজনেরই স্বপ্নকন্যা হয়ে উঠার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছি।

আমাদের স্কুলের তিনমাস অতিবাহিত হলো। অক্ষরজ্ঞাণহীন বাচ্চাদের এরই মধ্যে অ আ দের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ভাবতেই ভালো লাগতো যখন ভাবতাম আমার’ই হাত ধরে ওদের মধ্যে এই সখ্যতা গড়ে উঠা। আমাদের স্কুল ভার্সিটি এলাকার আশেপাশে বেশ পরিচিতিও পেলো। মনে মনে তখন অনেক সুখানুভূতি কাজ করতো।

মনে হতো আমি ভালো আছি, বেশ ভালো আছি। আমার এতো ভালো লাগার মধ্যেও নিজেকে মাঝে মাঝে খুব সাধারণ মনে হতো। খুব সাধারণ মেয়ের মতোই শুভ’কে হুট করে একদিন বলে ফেলতে ইচ্ছে করতো, “আমি তোমায় ভালোবাসি শুভ”। কিন্তু ওর নির্বিকার ভাব আমায় আর কখনো সাধারণ হতে দেয়নি। সেদিন ছিল সোমবার।

ভার্সিটিতে গিয়েছি। শুভ বলেছে আজ যাতে অবশ্যই অবশ্যই ক্লাসে আসি। স্কুলের ব্যাপারে আলাপ আছে। ওর আসার কথা ছিল সকাল দশটায়। এগারোটা হতে চললো।

ওর কোন খোঁজ নেই। ফোন দিলাম। সুইচড অফ। ভীষণ অস্থির লাগছিলো। সময়গুলো যেন কাটছিল না কিছুতেই।

সাড়ে এগারোটায় শুভ এলো, সাথে অপর্ণা। হাসতে বললো, সরি! অপর্ণা হুট করে খেতে নিয়ে গেলো। তাই দেরি হলো। আমার কেন জানি ভীষণ কান্না পাচ্ছিল এই কথা শোনার পর! বললাম, “আমার শরীর ভালোনা, কাল কথা হবে। আজ যাই।

তোমার জন্য তো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তুমি দুপুরের খাবারটাও খেয়ে আসলে পারতে!” বলেই কোনদিক না তাকিয়ে হন হন করে হাটতে শুরু করলাম আমি। চোখের জল যেন বাঁধ মানতে চাইছিলনা? আমার কেন কান্না পাচ্ছে? কেন এতো কষ্ট লাগছে আমার? এই কেনর উত্তর খুঁজতে গিয়ে চোখের জল দিশেহারা হয়ে টপ টপ হয়ে ঝরছিলো। আমিতো এমন সাধারণ হতে চাইনি কখনো। পিছন থেকে শুভ ডাকলো- “মায়া! এই মায়া শোন!” আমি চোখ মুছে ফিরে বললাম বলো! মনে মনে বলতে লাগলাম – যদি বলতো “তোমায় ভালোবাসি?” -স্কুলে কাল একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবে? আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম, কেন? -কাজ আছে।

-আচ্ছা আসবো। আমি এখন যাই। তপ্ত সূর্য তখন মাথার উপর, আর তপ্ত পানি আমার গালে। শুভকে ফেলে আমি হেঁটে চলেছি সামনে। পাশ দিয়ে হঠাৎ কোন এক কণ্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে বললো- “মায়া তোমার সব চোখের পানি আমায় দিবে? ” আবারও ছাতামাথা লেখা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.