আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আপসহীন সংগ্রামের এক প্রতিচ্ছবি-

বিভাগ-পূর্ব কলকাতায় একজন কলেজ শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে ঢুকেই শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে বললেন, 'শুনেছ হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার আন্দোলনে একজন মুসলিম ছাত্রও অংশ নিয়েছে। ' বেকার হোস্টেলের প্রেসিডেন্সি কলেজ পড়ুয়া সেই সুদর্শন ছাত্রটি হচ্ছেন পরবর্তী ইতিহাসে বাম রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ কমরেড আবদুল হক। ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশোর খড়কী পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী আবদুল হক ১৯৩৬ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সপ্তম স্থান অধিকারক্রমে অর্থনীতি সম্মান বিষয়ে ভর্তি হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ওই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে তিনি চলে যান যশোর এলাকায় হাটবাজারে ইজারাদারদের তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ঘুরিয়ে ওই যে চলি্লশ দশকে কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে একাত্দ হয়েছিলেন, আমৃত্যু সে পথেই তিনি ছিলেন আপসহীন, কোনো দিন ফিরে যাননি আত্দপ্রতিষ্ঠার ব্যক্তিজীবনে, কখনো পার্টি সিদ্ধান্তের ঊধের্্ব ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে স্থান দেননি এই মহান বিপ্লবী। ছাত্রজীবনেই আবদুল হক আকৃষ্ট হন সমাজতন্ত্রের আদর্শে। জড়িত হন স্টুডেন্টস ফেডারেশন রাজনীতির সঙ্গে। প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪৪ থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং পার্টির সিদ্ধান্তে নিজেকে পরিচালিত করতে থাকেন।

পার্টি নির্দেশনা অনুসরণ করে শিক্ষাজীবন পেছনে ফেলে যশোর এলাকায় হাটবাজারে তোলাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে একপর্যায়ে অভয়নগর থানার রাজঘাট নোয়াপাড়া হাটে মহাজনদের লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন কমরেড আবদুল হক ও কমরেড অধীর ঘোষ। মুহূর্তের মধ্যে খবর পেয়ে হাজার হাজার কৃষক লাঠিসোঁটা নিয়ে ছুটে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায় দুই কৃষক নেতাকে। এভাবে ক্রমশ বেড়ে চলে কমরেড আবদুল হকের রাজনৈতিক প্রভাব। ১৯৪১ সালে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বেনাপোলের অদূরে বর্তমান পশ্চিম বাংলার বনগাঁতে। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কমরেড আবদুল হক।

দিনাজপুরের কৃষক নেতা হাজী দানেশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বনগাঁ সম্মেলনে লাঙ্গল যার জমি তার এবং আধি নাই তেভাগা চাই- এই দাবি দুটি গৃহীত হয় এবং মূলত এখান থেকে জোরদার হতে থাকে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন। ওই বছর ১৯৪১ সালে কমরেড হক ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী সভ্যপদ লাভ করেন এবং ১৯৪৩-৪৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন এবং মহিলা আত্দরক্ষা সমিতি একযোগে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে তোলে। কমরেড আবদুল হক এ আন্দোলনে অগ্রদূত হিসেবে গ্রাম-শহরে ছুটে যান। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পাকিস্তানভিত্তিক পৃথক পার্টি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে কট্টর লাইন গৃহীত হলে ১৯৪৮ সালেই কমরেড আবদুল হককে পাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয় এবং বছরের পর বছর কারাগারে আটক রাখা হয়। তিনি হচ্ছেন পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম কয়েকজন রাজবন্দীর অন্যতম।

বন্দী অবস্থায় পার্টি কারাবিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিলে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে কমরেড আবদুল হক অনশন শুরু করেন। এংলো-ইন্ডিয়ান জেলার মি বিল অনশন ভাঙাতে ব্যর্থ হয়ে নিরস্ত্র রাজবন্দীদের ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিলে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সংঘটিত হয় ইতিহাসের প্রথম জেল হত্যা। নিহত হন ৭ কমিউনিস্ট বন্দী, আহত হন ৩০ জন। মি বিল খ্যাপা কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কমরেড আবদুল হকের ওপর। তার হাতে থাকা হান্টারের আঘাতে চৌচির হয়ে যায় কমরেড আবদুল হকের মাথা।

এমন সময় কমরেড হককে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে খুলনার ছাত্রনেতা আনোয়ার তার প্রিয় নেতাকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাইফেলের নলের সামনে, গুলিবিদ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই শহীদ হন আনোয়ার এবং নাটকীয়ভাবে গুরুতর আহতাবস্থায় নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান কমরেড আবদুল হক। এ ঘটনাটি রাজশাহী কারাবিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী কমরেড আবদুল হকের জীবনে গভীর ছাপ ফেলে এবং পরবর্তী জীবনে তিনি আত্দোৎসর্গকারী খুলনার তরুণ আনোয়ারের নামানুসারে তার একমাত্র সন্তানের নাম রাখেন মেহেদী আনোয়ার। ১৯৫২ এবং তৎপূর্ববর্তী ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন কমরেড হক। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং যৎসামান্য সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে তাকে পরাজিত দেখানো হয়। ১৯৫৮ সালে মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি এবং কমরেড আবদুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে প্রদেশব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদবিরোধী কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে আত্দনিয়োগ করেন।

১৯৬৫ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহাবিতর্কে অংশ নিয়ে শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে কমরেড আবদুল হক-সুখেন্দু দস্তিদার-মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)। এ পার্টির তাত্তি্বক দলিল রচনায় মূল ভূমিকা রাখেন কমরেড আবদুল হক। ১৯৬৯ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও কমরেড আবদুল হকের নেতৃত্বে লক্ষাধিক জনতা গভর্নর হাউস ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান এবং এর মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে সভা, সমাবেশ, ধর্মঘট, হরতাল, অনশন প্রভৃতির পাশাপাশি 'ঘেরাও আন্দোলন'-এর সংযোজন হয়। ১৯৭১ সালে পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) দু'লাইনের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার দলিল গ্রহণ করলে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। যশোরের পুলুমের অদূরে পার্টির অন্যতম সংগঠক কমরেড তুজোকে পাকিস্তানি বাহিনী বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বর্বর পন্থায় হত্যা করে।

ওই সময়ে একই সঙ্গে নিহত হন ১০০ জন পার্টি ক্যাডার। বাংলাদেশ আমলে এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) নাম পরিবর্তন ক্রমে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) করা হয়, কিন্তু প্রতিকূলতার কালো মেঘ কাটে না। কমরেড আবদুল হক গোপনেই থেকে যান। ১৯৭০ সালের ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকার পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর পাশে কমরেড আবদুল হককে সর্বশেষ প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল, এর পরে তিনি আর কখনো সাধারণ্যে না এসে আত্দগোপনে থেকে আমৃত্যু রাজনীতি করেছেন। তার লিখিত গ্রন্থপঞ্জির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র, ক্ষুধা হইতে মুক্তির পথ, যত রক্ত তত ডলার, পূর্ববাংলা আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী, মার্কসীয় দর্শন, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ, মাও সেতুং-এর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতি।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কাকাবাবু নামে খ্যাত কমরেড মুজাফফর আহমদের সানি্নধ্যে রাজনীতি শুরু করে দীর্ঘপথ পরিক্রম শেষে এই আত্দত্যাগী রাজনীতিবিদ যোসেফ স্ট্যালিনের ভাবাদর্শে অবিচল কমরেড আবদুল হক ১৯৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু আজও দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের শ্রেণী সংগ্রামে প্রেরণার ধ্রুবতারা হিসেবে জ্বেলে রেখেছেন তার আপসহীন আদর্শ।

লেখক : প্রাক্তন সভাপতি, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।