আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেগম খালেদা জিয়া আবারো ইতিহাস নিয়ে প্রকাশ্যে মিথ্যাচার করলেন। খালেদা জিয়ার মিথ্যাচারকে বুঝতে হলে ইতিহাসের সেই ঘটনাগুলো একটু পড়তে হবে!!!

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আবারো গতকাল সাংবাদিক সম্মলনে মিথ্যাচার করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া মিথ্যাচার করেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালে সৃষ্ট যে সংকট, সেই সংকটের ইতিহাস নিয়েও। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ভারতের রাজধানী দিল্লীতে যে ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ একাত্তরে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের কখনোই সাধারণ ক্ষমা করেনি। এমন কি যে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা টপ মোস্ট মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ করেছিল, তাদের বিষয়ে ওই ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তিতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল যে, পাকিস্তান তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে জাতিসংঘের মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া শেষ করবে। যা পাকিস্তান ওই ১৯৫ জন মানবতা বিরোধী টপ মোস্ট যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে নিলেও বিচার কাজ আর শেষ করেনি।

এছাড়া বাংলাদেশে আটকে পরা প্রায় চার লাখ বিহারী অবাঙালীকে পাকিস্তান আর ফিরিয়ে নেয় নি। পাকিস্তান ওই ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি'র এই দুইটি প্রধান বিষয় পুরোপুরি লংঘন করেছিল। যা এখনো অমিমাংসীত। সুতরাং বেগম খালেদা জিয়া যিনি দুইবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর মুখে এই ইস্যুতে মিথ্যাচার করাটা শোভা পায় না। বেগম খালেদা জিয়া খুব ভালো করেই জানেন, পাকিস্তান ওই ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তির দুইটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে লংঘন করেছিল।

যা এখনো অমিমাংসীত রয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের ইস্যু ১৯৭৪ সালে শেষ হয়নি বরং এখনো তা অমিমাংসীত রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার অবগতির জন্য কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে ওই ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তিগুলো এবং ধারবাহিক বিষয়গুলো আবারো এখানে তুলে ধরছি। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ইতিহাসের মিথ্যাচার করে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে আর প্রপাগাণ্ডা চালানো যাবে না। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিম্তানের জাতীয় পরিষদে যে শোক প্রস্তাব পাশ হয়, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া বিএনপি জানায়নি।

বরং হতকাল বিএনপি নেত্রী সেই প্রেক্ষিতে আবারো ইতিহাসের মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলেন। যা কোনো বাংলাদেশের নাগরিকের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। এবার আসুন, ইতিহাসের সেই ঘটনাগুলো একটু খোলঅ মনে দেখে আসি। তাহলে বেগম জিয়ার মিথ্যাচারকে বুঝতে আপনাদের সুবিধা হবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত সিং অরোরা'র কাছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি (এএকে নিয়াজি) ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করেন।

জন্ম হল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলায় একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যা আসলে শিমলা চুক্তি নামে পরিচিত। (মূলত উভয় দেশের দুই নেতা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় স্থানীয় সময় ছিল রাত ১২টা ৪০ মিনিট, যা আসলে ৩ জুলাই ১৯৭২)। শিমলা চুক্তির প্রধান বিষয়গুলো ছিল নিম্নরূপ: ১. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান সকল দ্বিপাক্ষিক সমস্যা জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সমাধান করা হবে ২. উভয় দেশ নিজেদের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট হবে।

সে লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে বিরাজমান সকল সতল সমস্যা শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে ৩. উভয় দেশ শান্তিপূর্ণভাবে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশীসুলখভ সহ-অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য সীমান্তবর্তী সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে এবং উভয় দেশ কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না ৪. উভয় দেশ নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করবে, সীমান্তবর্তী সহ-অবস্থান শান্তিপূর্ণ রাখবে, উভয় দেশের সীমানাকে সম্মানের সঙ্গে দেখবে ৫. জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী উভয় দেশ শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থেকে অন্য দেশের উপর কোনো আক্রমণ বা দখল করার প্রচেষ্টা চালাবে না ৬. উভয় দেশ বন্ধুত্ব শক্তিশালী করতে নিজেদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে বিনিময় শুরু করব উভয় দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যে বিষয়ে একমত হয় সেগুলো হল- ক. উভয় দেশের মধ্যে যোগাযোগ চালু করবে, ডাক ও টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করবে, নৌপথে, স্থল পথে ও আকাশ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করবে খ. উভয় দেশ অপর দেশের পর্যটকদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করবে গ. উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে সম্ভাব্য ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে ঘ. উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপন ও বিনিময় করবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী সুলভ দেশ হিসেবে বসবাসের জন্য উভয় দেশ যে বিষয়ে একমত হয় সেগুলো হল: ১. উভয় দেশ আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে নিজ নিজ সৈন্য প্রত্যাহার করবে ২. জম্বু ও কাশ্মীর সীমান্তে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে উভয় দেশের মধ্যে গুলি বিনিময় হচ্ছে তা বন্ধ করা হবে। উভয় দেশ যার যার অবস্থানে যার যার সীমানায় ফিরে যাবে। উভয় দেশ এই চিজ ফায়ার বন্ধ রেখে নতুন করে আর সীমান্তে গুলি বিনিময় করবে না ৩. উভয় দেশ আগামী ৩০ দিনের মধ্যে জম্বু ও কাশ্মীর থেকে যার যার সেনা যার যার আগের অবস্থানে শান্তিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে নেবে শিমলা চুক্তি'র পর ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান আরো জোরদার করার জন্য ১৯৭৩ সালের ২৮ শে আগস্ট ভারতের রাজধানী দিল্লীতে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যা দিল্লী চুক্তি নামে পরিচিত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো দিল্লী চুক্তি সই করেন।

বাংলাদেশ দিল্লী চুক্তি'র কোনো পক্ষ না হলেও ওই চুক্তির সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত দিল্লী চুক্তিতে আসলে পাঁচটি প্রধান ইস্যু ছিল। সেগুলো হথ: ১. পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালীদের বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন করা ২. বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালীদের পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন করা ৩. ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী ও শরনার্থীদের প্রত্যাবাসন করা ৪. বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে তাদের বিচার প্রক্রিয়া ৫. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেওয়া ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ১৯৭২সালের ২ জুলাই'র শিমলা চুক্তি এবং ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্টের দিল্লী চুত্তির ধারাবাহিকতায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাবার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল ভারতের রাজধানী দিল্লীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেন, ভারতের বিদেশমন্ত্রী স্মরণ সিং ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ বেশ কয়েকবার বৈঠক করে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যা ত্রিপক্ষীয় চুক্তি বা বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান চুক্তি নামে পরিচিত। ৯ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

ওই ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল নিম্নরূপ: ১. ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীগণ ১৯৭২ সালের ২ জুলাই শিমলা চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে ঐক্যমত হয়েছেন। যা বাস্তবায়ন করার জন্য উভয় দেশ শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যে সমাধানে পৌঁছানোর জন্য এখনো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২. বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শিমলা চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে শান্তি ও আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ শিমলা চুক্তিকে সমর্থণ করে। ৩. ১৯৭১ সালে এই উপমহাদেশে যে দুঃখজনক মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সমস্যা যার রাজনৈতিক, মানবিক ও পনুর্বাসন করাটা শান্তিপূর্ণ ভাবেই করা উচিত। সকল পক্ষকে স্বাধীন ও সার্বভৌম সম অধিকারের ভিত্তিতে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সকল পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

৪. ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল ভারত ও বাংলাদেশ এই রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে একধাপ অগ্রসর হয়েছে যা মানবিক বিপর্যয়কে অনেকটা সমাধানে সহায়তা করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ ওই তারিখে ঐক্যমত হয়েছে যে, উপমহাদেশে রাজনৈতিক সমস্যা ও শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জন্য সকল পক্ষকে একসঙ্গে বসেশান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী এই সমস্যার সমাধানে ভূমিকা পালন করবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভারত ও বাংলাদেশ ঐক্যমত হয়েছে যে, উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতি রক্ষার জন্য এবং পরাস্পরিক বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এবং উক্তজনা প্রশোমনের জন্য আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিকভাবেই এই মানবিক সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে। বাংলাদেশ সরকার যেসব পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের মানবতা বিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্থ করেছে, তাদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাবার ইচ্ছে পোষণ করে উভয় দেশ। ৫. ওই ঘোষণা অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশ এবং ভারত ও পাকিস্তান কয়েকটি সিরিজ বৈঠকের পর ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট দিল্লীতে ভারত ও পাকিস্তান যে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং যাকে বাংলাদেশ সমর্থণ করেছে, সে অনুযায়ী সকল পক্ষ মানবিক সমস্যা সমাধানে একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাতে চায়।

৬. এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের সুপারিশ অনুযায়ী, অন্তত তিন লাখ মানুষকে এখন জরুরী ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন করতে হবে। আর উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিকভাবেই এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। ৭. ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বীকৃতি বিবেচনায় সম্পৃক্ত করা হয়। যাতে বাংলাদেশ দিল্লী চুক্তিকে সমর্থণ দিয়ে বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেন, ভারতের বিদেশমন্ত্রী স্মরণ সিং ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ দিল্লীতে ১৯৭৪ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল দিল্লী চুক্তি'র খুটিনাটি বিষয় ও সমাধানের উপায় নিয়েবৈঠক করেন।

বিশেষ করে বাংলাদেশের মানবতা বিরোধী যুদ্দাপরাধী ট্রাইব্যুনালে যে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিচার প্রকিয়া কিভাবে শেষ হবে এবং ভারতের জেলে পাকিস্তানের যেসব সেনা আটক আছে তাদের কিভাবে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে, সে বিষয়ে একটি সমাধানের উপায় খোঁজা হয়। ৮. ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্টের দিল্লী চুক্তি রিভিউ করে তারা এই তিন দেশের বিশাল মানবিক সমস্যার একটি প্রত্যাবাসনের উপায় বের করেন। ৯. এই তিন মন্ত্রী তিন দেশের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারগুলো কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে ধাপে ধাপে সমাধান করা যাবে সে বিষয়ে একমত হন। ১০. ভারত ব্যখ্যা করে যে, সেই সমাধানে উপায় হিসেবে ভারত থেকে ট্রেনে ৬,৫০০ জন করে যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে। তবে কুম্ভ মেলার কারণে ভারত থেকে এই যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন ১০ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত বিরত থাকবে।

১৯ শে এপ্রিলের পর তা আবার শুরু হবে। আর আশা করা যায় যে, এপ্রিলের মধ্যেই ভারতের জেলে থাকা পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে। ১১. পাকিস্তান ব্যাখ্যা করে যে, পাকিস্তানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন প্রায় শেষের দিকে। আশা করা যায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশিষ্ট বাঙালিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে। আর তা কোনো ধরনের অন্তরায় বাধা বা প্রতিরোধ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবেই করা যাবে।

১২. বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালিদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে পাকিস্তান দাবী করে যে, ইতোমধ্যে পাকিস্তান সরকার একটি ছাড়পত্র তৈরি করেছে, যারা পাকিস্তানের নাগরিক কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আটকা পড়েছে, কিংম্বা যারা পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরির কারণে যারা সেখানেআটকা পেড়েছে তারা এবং তাদের পরিবাবর্গ, আর যারা দেশ ভাগের কারণে আত্মীয় হিসেবে সেখানে আটকা পড়েছে,তাদের একটা তালিকা পাকিস্তান সরকার চূড়ান্ত বরেছে। কিন্তু যারা নির্বাসিত অবাঙালি কিন্তু পাকিস্তানে আটকা পড়েছে তাদের ব্যাপরে পাকিস্তান সরকার একটি মানবিক বিবেচনা নিয়ে তাদেরও পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন করার জন্য আগ্রহী। আর এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ হাজারের একটি তালিকা পূড়ান্ত হয়েছে যারা সবাই পাকিস্তানের নাগরিত কিন্তু বাংলাদেশে আটকা পড়েছে। পাকিস্তান আরো ব্যাখ্যা করে যে, প্রথম তিন ক্যাটাগরিতে যেসব অবাঙালি পড়বে পাকিস্তান বিনা শর্তেই তাদের ফিরিয়ে নেবে, আর সেই সংখ্যা যতোই হোক না কেন। কিন্তু যাদের আবেদনপত্র বাতিল হয়েছে পাকিস্তান তাদের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে যে, কোন কারণে কিসের ভিত্তিতে পাকিস্তান সরকার তাদের আবেদন বাতিল করল।

যদি তারা কোনো কারণে ওই তিন ক্যাটাগরিতে না পড়ে তাহলে তাদের বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের কোনো দায় নেই। তবু তাদের আবেদন পাকিস্তান পুনঃবিবেচনা করে দেখবে কেন তারা বাদ পড়ছে। আর এজন্য কোনো সসময় সীমার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এমনকি তারা কোন ক্যাটাগরিতে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন চায় সেই আবেদন নতুন করেও করতে পারবে। তাছাড়া পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার একটি সম্মানজনক সমাধানেরও চেষ্টা করবে।

১৩. ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধবন্দীর ব্যাপারে তিনমন্ত্রী একটি গঠনমূলক, শান্তিপূর্ণ ও সহজ উপায় বের করার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেন যে, এই ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ করেছে, জোনোসাইডের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল, যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের আইন করেছে, তার আওতায় তারা পড়ে। যে কারণে তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই বিচার করতে হবে। জবাবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, পাকিস্তান সরকার মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধের মত কোনো সন্ত্রাসীকে একদম সমর্থণ করে না। যদি তারা এর আওতায় পড়ে তাহলে পাকিস্তান সরকার তাদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতের নিয়ম কানুন অনুসরণ করেই তাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করবে।

১৪. তিনমন্ত্রী ঐক্যমত হন যে, তিন দেশে বিরাজমান মানবিক এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হবে। তিনমন্ত্রী আরো জানান যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে আমন্ত্রণ দিয়েছেন তাতে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাবেন। আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতীতের ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবেন। আর এই তিন দেশের মানবিক প্রত্যাবাসন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয় সে জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরে সহযোগিতা চাইবেন। আর অতীতের ভুলকে ক্ষমা করে নতুন করে দুই দেশের বন্ধুত্ব শুরু করার জন্য আহবান জানাবেন।

আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের কৃতকর্মের জন্য ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থণাকে সম্মান দেখিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুনভাবে একটি দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের উপর জোড় দেবেন। আর বলবেন যে, বাঙালি জাতি জানে কি করে ক্ষমা করে দিতে হয়। ১৫. পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থণা ও অতীতের ভুলকে ভুলে যাবার যে আবেদন করা হবে, তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেন যে, পাকিস্তানের অতীতের ভুল স্বীকার ও ক্ষমাপ্রার্থণাকে বাংলাদেশ অবশ্যই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করবে। আর পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, ক্ষমাপ্রার্থনা, আর ভুল স্বীকারের কারণে বাংলাদেশ অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে আলোচিত ১৯৫ জন মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাকে পাকিস্তানের ফেরত পাঠাতে রাজী আছে। তবে এই ১৯৫ জন মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরী সেনার বিচার পাকিস্তান যথাযথভাবেই করবে এমন প্রতিশ্রুতি পাবার পরেই সেটা কার্যকর হবে যা দিল্লী চুক্তিকে কার্যকর করতে সহায়তা করবে।

১৬. তিন মন্ত্রী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, উপরের বিষয়গুলো বিবেচিত হলে তিন দেশে ১৯৭১ এ সংঘটিত মানবিক বিপর্যয়কে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শান্তিপূর্ণ সমাধান করা সম্ভব হবে। তিন দেশে অন্তত ৭০০ মিলিয়ন মানুষের জীবনে যে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে তার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পাশাপাশি এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি তিন দেশের ভবিষ্যতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলে তারা সম্মত হয়েছেন। আর এটা বাস্তবায়ন করা গেলে উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতি ফিরে আসার পাশাপাশি মানবিক সমস্যাটির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়াও তিন দেশের মধ্যে নতুন করে একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ভারতের রাজধানী দিল্লীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেন, ভারতের বিদেশমন্ত্রী স্মরণ সিং ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ এই ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তির পর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাসহ অন্তত ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৯ জনকে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন করা হয়।

জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, যার অন্তত ১ লাখ ২১ হাজার ৬৯৫ জন বাংলাদেশীকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন করা হয়। আর অন্তত ১ লাথ ৮ হাজার ৭৪৪ জন পাকিস্তানীকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন করা হয়। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হয়। আর জেনারেল এএকে নিয়াজি কে সর্বশেষ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী হিসেবে ভারত থেকে ওয়াগাহ সীমান্ত পথে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু পাকিস্তানী সর্বশেষ যুদ্ধবন্দী ও মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর পর ত্রিপক্ষীয় এই শান্তি চুক্তির পাঁচটি প্রধান ইস্যুর অন্তত চারটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও দুইটি অন্যতম বিষয় ভবিষ্যতের জন্য অমিমাংসীত থেকে যায়।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এই দুইটি সমস্য আজও সমাধান হয়নি। সেই দুইটি ইস্যু কি? একটি হল ১৯৫ জন যে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী পাক সেনা যারা ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করেছিল, পাকিস্তান তাদের ফিরিয়ে নিলেও তাদের বিচার করেনি। অপরটি হল, বাংলাদেশে আটকে পরা প্রায় চার লাখ বিহারী অবাঙালি পাকিস্তানীদের পাকিস্তান আর ফিরিয়ে নেয়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসের মিথ্যাচার করে আবারো প্রমাণ করলেন, তিনি আসলে পাকিস্তানের চর, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সারা দেশে জামায়াত শিবিরকে নিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে সহিংস আন্দোলন, যা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর গোটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় রূপ নেয়, নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর হামলা, খুন, আগুণ, জ্বালাও পোড়াও, রেল লাইন তুলে ফেলা, যাত্রীবাহী বাসে আগুন, ট্রেনে আগুন, অন্তত ১২০ জন মানুষে পুড়িয়ে হত্যার পরেও বেগম খালেদা জিয়া দাবী করেন যে তাদের এটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন!! বেগম জিয়া যে বিশ্বাস নিয়ে জামায়াত শিবির বিএনপি'র এই নাশকতাকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বলেন, ঠিক সেই বিশ্বাস নিয়েই তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের এই শোক প্রস্তাবে আমরা মর্মাহত।

তাদের নিন্দা জানানোর মত কোনো ভাষা উচ্চারণে বেগম জিয়ার হৃদয় সায় দেয় না। তেমনি একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। বরং একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য তাদেরকে নিয়ে মিটিং মিছিল সমাবেশ করে তাদের মুক্তি দাবী করেন। সারা দেশে নাশকতা করে তাদের বিচার প্রত্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে চান। মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, আর গলায় গলায় পাকিস্তান আর জামায়াত শিবিরের সঙ্গে এই যে পিড়িত, বেগম খালেদা জিয়া, মিথ্যাচার করে রাজনীতির এই মুখোশটি বেশিদিন আড়ালে রাখা যায় না।

দয়া করে আপনি মিথ্যাচার ছাড়ুন। আর বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুষ্ঠু রাজনীতি করতে চাইলে পাকিস্তান আর জামায়াত সঙ্গ ত্যাহ করুন। নইলে ভবিষ্যতে আপনার এই ভূমিকার জন্য বাংলার মাটিতে আপনারও একদিন বিচার হতে পারে। ইতিহাস কাউকে ছেড়ে দেয় না। আপনাকেও ইতিহাস নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না।

পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো মিমাংসা হয়নি। বাংলাদেশে আটকে পরা পাকিস্তানীদের বিষয়েও এখনো কোনো মিমাংসা হয়নি। অতএব খামাখা মিথ্যাচার করে ইতিহাসকে আর কলংকিত করবেন না। বেগম খালেদা জিয়া, আপনি কোন পক্ষের রাজনীতি করেন, কেন করেন, কার স্বার্থে করেন, তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশের কাছে ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা করারও সুযোগ নাই।

অতএব যা বলবেন, জেনে শুনে বলবেন। আপনার কোনো মিথ্যাচার বাংলাদেশের মানুষ আর এক মিনিটের জন্যও মেনে নেবে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।