আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মান্নান খানের সময় মন্ত্রণালয়ে ছিল লুটপাট-উৎসব

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতরগুলোতে পুরো সময়ই লুটপাটের মহোৎসব ছিল। প্লট বরাদ্দ, নানা অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্য আর দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও কতিপয় সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয় ছাড়াও রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদফতর সর্বত্র চলেছে একই পরিস্থিতি। সর্বশেষ জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পের সঙ্গে মন্ত্রীর স্ত্রীকে সফরে নিতে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছিল। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের অর্ধশত কোটি ও মিরপুরে শত কোটি টাকা মূল্যের প্লট হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সঙ্গেও ছিল মান্নান খানের ঘনিষ্ঠ যোগসাজশ।

দায়িত্ব ছাড়ার শেষ মুহূর্তে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে বিভিন্ন জটিল প্লটের ফাইলগুলো ছাড়ানোর বাণিজ্য হাতে নেন তিনি। মিরপুরে একটি সমিতিকে জমি দেওয়ার কথা বলে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজন। কিন্তু জমি বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি বৈধ ছিল না বলে শেষ মুহূর্তে অবৈধ কাজটিকেই পার করিয়ে দেওয়া হয়। আর পুরো সময়ে মন্ত্রীর হয়ে তার ভাই এবং আস্থাভাজন লোকজন মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ দফতরগুলোতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ এবং নানা তদবিরের কাজ করেছেন। তাদের অত্যাচারে অনেকটা অসহায় ছিল সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

আর মান্নান খান দায়িত্ব ছাড়ার পরপরই তার পিএস হাসান সারওয়ার, ইকবাল পারভেজ ও চারজন সিনিয়র সহকারী সচিব তদবির করে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এর মধ্যে হাসান সারওয়ার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ও ইকবাল পারভেজকে রাজউকে বদলি করা হয়েছে।

চাঁদার টাকায় স্ত্রীর ভ্রমণ : সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মিরপুরে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের 'জয়নগর আবাসন ফ্ল্যাট নির্মাণ' শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ২১ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ১০ দিনের বিদেশ সফরে যান সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান। এ সময় তার সফরসঙ্গী হিসেবে স্ত্রীকেও নিয়ে যান।

কিন্তু প্রকল্পের অর্থে স্ত্রীর সফরের সুযোগ না থাকায় তার মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। মন্ত্রীর এপিএস আসাদুজ্জামান দীপু রাজউকে ১৫ লাখ, পূর্ত ভবনে ১৫ লাখ ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ভবন থেকে ১০ লাখ টাকা করে আদায় করেন। এ বিষয়টি নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও মন্ত্রীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এ ১০ দিনের সফরে কানাডা ও আমেরিকা যাওয়ার অনুমতিপ্রাপ্ত হন মন্ত্রীর নেতৃত্বে পিএস হাসান সারওয়ার, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান শহীদউল্লাহ খন্দকার ও সদস্য (প্রশাসন) আকলিমা জহির রীতা। তবে শহীদউল্লাহ খন্দকার দুবাই থেকে ব্যক্তিগত সমস্যা দেখিয়ে সফর বাতিল করে দেশে চলে আসেন এবং আকলিমা জহির রীতা না যাওয়ায় মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা তার স্থলাভিষিক্ত হন।

এদিকে সফর শেষ করে প্রকল্পের জন্য নিজেদের অভিজ্ঞতা বা অর্জন সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও মন্ত্রী মান্নান খান ও তার পিএস তা দেননি। আবার সফরের ব্যয়-সংক্রান্ত ভাউচার আট মাস পেরিয়ে গেলেও তা জমা দেননি। জাতীয় গৃহায়ন মিরপুর ডিভিশন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের ব্যয়-সংক্রান্ত তালিকা জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু না দেওয়ায় এ পর্যন্ত তিনবার অফিসিয়াল চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনো তা জমা দেওয়া হয়নি।

এ সফরে শুধু মান্নান খান প্রকল্পের খাত থেকে ১১ লাখ ৪৩ হাজার ১৬ টাকা নিয়েছেন।

পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের প্লটে মন্ত্রীর থাবা : ১/৬ গজনবী মোহাম্মদপুর (সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উল্টো পাশে) জাতীয় গৃহায়নের প্রায় ১৫ কাঠা জমির ওপর ঘর তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ প্লটটি খালি থাকায় এখানে তারা বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ভুয়া আমমোক্তারনামা দিয়ে এ প্লটটি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে। এর অংশ বিক্রয় অনুমতির জন্য জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে তারা জমির প্রকৃত মালিককে নিয়ে আসতে বলেন।

এ অবস্থায় জনৈক জাফর নামের এক ব্যক্তি মান্নান খানকে দিয়ে অবৈধ হস্তক্ষেপ শুরু করেন। পরে বিষয়টি নিয়ে গৃহায়ন চেয়ারম্যান ও মন্ত্রীর মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হস্তক্ষেপ হলে এ তৎপরতা বন্ধ করতে বাধ্য হন মান্নান খান।

মিরপুরের শত কোটি টাকার প্লট হাতিয়ে নিতে মরিয়া মান্নান খান : মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের চিড়িয়াখানা রোডের ১জি, প্লট নম্বর ১/১ এর ৯টি প্লটে প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। আর এ কাজে মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই সহায়তা করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান।

চিড়িয়াখানা রোডের প্রধান সড়ক-সংলগ্ন হওয়ায় এ প্লটগুলোর বাজার মূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। প্রথমে সৈনিক মৈত্রী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নীতিমালা অনুযায়ী বরাদ্দের কোনো সুযোগ না থাকায় পরে এ নাম পরিবর্তন করে ডালার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে বরাদ্দ চাওয়া হয়। আর এ সমিতির সদস্য হিসেবে ৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্লটগুলো হাতিয়ে নিতে জনৈক সামসুল হক গংরা মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তৎপরতা শুরু করেন।

কিন্তু অনেক চেষ্টা-তদবির করেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনড় অবস্থানের জন্য প্লট বরাদ্দ পাননি তারা। পরে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সদ্য বিদায়ী প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের কাছ থেকে বরাদ্দের পক্ষে একটি পত্র নিয়ে এসে আবার প্রক্রিয়া শুরু করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, উলি্লখিত প্লটগুলোর মালিকানা দাবি করে জাহাঙ্গীর নামের আরেক ব্যক্তি আবেদন করেন। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি দিকনির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীর সুপারিশ আর তদবিরের জন্য বাধ্য হয়ে অবশেষে কর্তৃপক্ষের বোর্ডসভায় বরাদ্দের সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।

এক্ষেত্রে মন্ত্রীর সঙ্গে আবেদনকারীদের কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, এ প্লটগুলো বরাদ্দ না দেওয়ায় আগের চেয়ারম্যান জিএম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়াকে চার মহিলা সংসদ সদস্য তার কক্ষে লাঞ্ছিত করেন।

মন্ত্রীর হয়ে দাপুটে ছিলেন যারা : বর্তমান সরকারের পুরো সময়েই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের কাজ করেছে ইকবাল পারভেজ নামের প্রতিমন্ত্রীর এক আস্থাভাজন ব্যক্তি। তিনিই মূলত গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতরগুলোর স্বঘোষিত নিয়ন্ত্রক ছিলেন। আর সঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর ছোট ভাই বোরহান উদ্দিন ও গনি মিয়া নামের দুই ব্যক্তি রয়েছেন।

মান্নান খানের ভাই বোরহান উদ্দিন গণপূর্ত ভবন ও রাজউকের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর গনি মিয়া জাতীয় গৃহায়ন ভবনে তদবির করে বেড়ান। কয়েক বছরের ব্যবধানে একাধিক প্লটের মালিক হয়েছেন এ গনি মিয়া এমন তথ্য দিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। জানা যায়, ইকবাল পারভেজের পদ না থাকার পরও তিনি মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক (আইনি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরপর তাকে পূর্বের স্থানে অর্থাৎ রাজউকে বদলি করা হয়েছে।

সে মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতরগুলোতে নানা বেআইনি কাজ করে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ ও ঘুষ লেনদেনে মুখ্য ভূমিকা পালন করাই ছিল তার কাজ। ইকবাল পারভেজ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ে এ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর পিএস হাসান সারওয়ার, এপিএস আসাদুজ্জামান দীপু, সচিবের পিএস রতন চন্দ্র, পিও ইলিয়াস উদ্দিন সবুজ। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রীর দাপুটে কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত সিনিয়র সহকারী সচিব আকরামুজ্জামান, রেজাউল, নাজিয়া ইসলাম ও সুমন রেজাও তদবির করে অন্যত্র বদলি হয়েছেন।

অবৈধ তদবির না শোনায় এক যুগ্ম-সচিবকে শাস্তিমূলক বদলি : ধানমন্ডির একটি পরিত্যক্ত বাড়ি অবৈধভাবে অবমুক্ত করার জন্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় যুগ্ম-সচিব (মনিটরিং সেল) কামাল উদ্দিন তালুকদারকে নির্দেশ দেন।

কিন্তু এ অবৈধ কাজ করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি। এ অবস্থায় মান্নান খান ক্ষিপ্ত হয়ে কামাল উদ্দিন তালুকদারকে ক্লোজড করার জন্য জনপ্রশাসন সচিবকে চিঠি দেন। কিন্তু জনপ্রশাসন সচিব উলি্লখিত কর্মকর্তার কাছ থেকে ঘটনা জেনে তার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, প্রতিমন্ত্রীর পছন্দের বাইরের কোনো কর্মকর্তাকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ফলে মান্নান খানের আশীর্বাদপুষ্টরাই পুরো মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দফতর নিয়ন্ত্রণ করত।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।