আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুমানার সাথে আট টা বছর ও সারথির অতৃপ্ত আত্মা

যা দেখি,শুনি,অনুভব করি, আমি স্বপ্নি। তাই গল্পে রুপ দিতে চাই...............

মরলে আমি অবশ্যই ভূত হব। কারন আমার আত্মা অতৃপ্ত। আমি নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই, এই ভেবে যে একটা মানুষ এতটা অতৃপ্ততা নিয়ে কিভাবে বেচে থাকতে পারে। অতৃপ্ততা নিবারনের জন্য আমি কি না করেছি- নেশা করেছি, মরতে গিয়েছি, বিয়ে করেছি, কিন্তু অতৃপ্ততা আমার কাটে নি।

অবশ্য বিয়েটা আমার শুধু অতৃপ্ততা কাটানোর একটা কৌশল ছিলনা, এটা ছিল আমার এক ধরনের প্রতিশোধ। আমার সব থেকে প্রিয়, সব থেকে ভালবাসার মানুষটার উপর সাড়া জীবনের চরম একটা প্রতিশোধ। রুমানার সাথে আমার প্রথম পরিচয় আজ থেকে নয় বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র। রুমানা এসেছিল তার মামার সাথে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে।

তার মামা মতিউর আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। তার মামার মাধ্যমেই পরিচিত হলাম রুমানার সাথে। রুমানাকে পরীক্ষা দিতে যত ধরনের সহায়তা করা দরকার, করতাম। কেন জানি এই মেয়েটার প্রতি আমি ধীরে ধীরে দূর্বল হতে শুরু করলাম কিন্তু আমার তখন করার কিছু ছিলনা কারন আমি সুমীর সাথে এংগেইজড ছিলাম। দূর্বলতা যে শুধু আমার মধ্যে ছিল বিষয়টা তেমন নয়।

রুমানার মধ্যেও আমি, আমার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করি। এবং সেটা ছিল আমার থেকে হাজার গুন বেশি তীব্র। কিন্তু আমি তাকে কখনো বলতে পারতাম না যে আমি আরেক জনের সাথে এংগেইজড। রুমানা আমাকে প্রায় প্রতি দিন ই ফোন দিত আর নানা ভাবে তার ভালবাসা জাহির করত। আর আমি সমানে তাকে না করে যেতাম, কারন আমি সুমির কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার কোন পথ পাচ্ছিলাম না।

এভাবে রুমানা তার, ভালবাসা জাহির করে চলে ৪ মাস। একদিন যখন আমি আমার নিজ চোখে, সুমির সাথে তার দুলাভাইয়ের অবৈধ সম্পর্কের প্রমান পেলাম সেদিন আমি তাকে ত্যাগ করলাম। অবশ্য আমি চাচ্ছিলাম ই এমন কিছু একটা হোক যাতে আমি সুমীকে ছাড়তে পারি। এটা অবশ্য রুমানার জন্য নয়। সুমীর ব্যাপারে আজে বাজে কথা শুনতে শুনতে আমি রীতিমত বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

সুমির সাথে তার দুলাভাইয়ের অবৈধ সম্পর্কের কথা ও আমি নানা ভাবে শুনতাম অনেক আগে থেকেই, কিন্তু সেভাবে পাত্তা দিতাম না, কিন্তু যখন এর প্রমান আমি স্বচক্ষে পেলাম তখন আমি তাকে আর ধরে রাখি নাই। সুমী অনেক কান্নাকাটি করছিল, বার বার বলছিল সে এমনটা আর জীবনে করবেনা কিন্তু আর আমি তাকে ক্ষমা করি নাই। এবং তার দুই মাস পরে আমি রুমানার সাথে সম্পর্কে জড়াই রীতিমত তার জোরাজুরিতে। ভেবেছিলাম এই মেয়ে যখন এত কান্না কাটি করছে আপাতত তার সাথে জড়াই, পরে এক সময় তাকে ছেড়ে যাব। এবং এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের ভালবাসার কাহিনী।


কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রুমানার চান্স হয় নাই। সে গিয়ে ভর্তি হয় গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। ঢাকা শহরে সে ছিল আত্মীয়হীন। আর তাই আমি হয়ে উঠি তার পরমাত্মীয়। আমি কখনো তার প্রেমিক, কখনো বাবা, কখনো অভিভাবক কিংবা কখনো মা।

রুমানা ঢাকা শহরে কিছু চিনত না। আমি তাকে আঙ্গুল ধরে ধরে নিয়ে ঘুরতাম ঢাকা শহরের এই গলি, সেই গলি। এই রাস্তা সেই রাস্তা। প্রতিদিন জাহাঙ্গীরনগর থেকে এসে তার সাথে দেখা করতাম। প্রেম করতাম, বাজার করতাম ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরন করতাম তার।

আর সে আমার জন্য রান্না করত। সেই খাবার আমি কখনো তার ওয়েটিং রুমে, কখনো পার্কে আবার কখনো হলে নিয়ে এসে খেতাম। খুব বেশি দিন আমি হলে থাকতে পারি নাই। আমি হলে না থেকে, ঢাকায় মেস করে থাকতাম শুধু তার জন্য। সাড়াটা সময় আমি দুশ্চিন্তায় থাকতাম।

যদি আমি হলে থাকি আর তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কিভাবে দ্রুত গিয়ে হাজির হব। আর তাই রুমানার কাছেই থাকা আমার। রুমানা ও আমাকে প্রচন্ড রকম ভালবাসত। পৃথিবীতে সে ২য় কোন পুরুষ চিনত না আমি ছাড়া। যেমনটা আমি ২য় কোন নারী চিনতাম না।

খুব উপভোগ করতাম আমি তার ভালবাসাটা। ধীরে ধীরে আমি এত বেশি জড়ায়া গেছলাম রুমানার সাথে যে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস শুধু রুমানার কথা বলত। আমাদের প্রতি রাতের বিনোদন ছিল ঝগড়া। এমন একটা রাত নাই যে আমরা ঝগড়া করতাম না। ঝগড়া হলে অথবা সে অসুস্থ হলে আমি সারা রাত তার হলের/ হোস্টেলের সামনে গিয়ে বসে থাকতাম।

এই ভেবে বসে থাকতাম যে যদি আমাকে তার দরকার হয় তাহলে? এভাবে রাতে বসে থাকতে গিয়ে আমাকে যে কত বার পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে অথবা উঠিয়ে দিয়েছে তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই। রুমানার বান্ধবীদের কাছে আমি ছিলাম খুব প্রিয় একজন মানুষ। তাদের ভাষায় একটা মানুষ কিভাবে এত ভালবাসতে পারে? আমাদের দুই পরিবার ও আমাদের বিষয়টাকে মেনে নিয়েছিল। আমার মার কাছে রুমানা ছিল খুব প্রিয়। রুমানাও আমার মাকে খুব পছন্দ করত।

রুমানারা দুই বোন ছিল, তাদের কোন ভাই ছিল না তাই তার মা আমাকে নিজের সন্তানই মনে করত। আর রুমানার বোন, ভাইয়া বলতে বলতে অজ্ঞান ছিল। এভাবেই চলছিল আমাদের ছোট্ট একটা সংসার। তখন আমার সামনে শুধু একটাই লক্ষ্য, কোন রকম পাস করে একটা চাকুরী জুটিয়ে রুমানাকে ঘরে তুলে নেয়া। আমি কখনো কল্পনাও করি নাই যে মেয়েটা আমাকে এত এত ভালবাসে সে আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিয়ে একদিন চলে যাবে।

আমাদের সম্পর্কে ৫ বছরের মাথায় আমাদের জীবনে সুমন আসে। সুমন রুমানার আগের প্রেমিক। আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে সুমনের সাথে রুমানার এক বছর সম্পর্ক ছিল। কি একটা কারনে সুমন রুমানাকে ছেড়ে চলে যায়। এবং তারপর রুমানা আমার সাথে জড়ায়।

আমার সাথে জড়ানো পাঁচ বছর পর, একদিন সুমনের সাথে রুমানার নিউ মার্কেটে দেখা হয়। তাদের কি কথা হয় আমি জানি না। কিন্তু রুমানা পাগল হয়ে যায়। আমাকে সে আর মেনে নিতে পারছিল না। ফোন অফ করে অন্য একটা নাম্বার দিয়ে সুমনের সাথে কথা বলত।

আমার সাথে দেখা করত না। আমি শুধু রুমানার পুরান নাম্বারে ফোন দিতাম, আর সেটা বন্ধ পেয়ে কান্নাকাটি করতাম। আমার কান্না দেখে রুমানার বান্ধবীরা পর্যন্ত হতবাক হয়ে যেত। আমি ছোট বাচ্চার মত হাউমাউ করে কাঁদতাম। এরপর আমি রুমানার সামনে গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে সেবারের মত আমাদের সম্পর্কটা রক্ষা করি।

আমি পড়াশুনা শেষ করলাম, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পেলাম। আমাদের সম্পর্ক সাড়ে সাত বছরে পৌছল। এই আড়াই বছরে আর একটা বারের জন্য ও সুমন আমাদের জীবনে ফেরে নি। এখন শুধু অপেক্ষা আমাদের বিয়ের। আমি একবার কাবিনের প্রস্তাব দিলেও রুমানা রাজী হয়নি।

তার কথা হল সে পড়াশুনা শেষ করবে। আমিও অপেক্ষা করতে লাগলাম। এবার আবারো আমাদের জীবনে সুমন চলে আসল। এবার ও রুমানা সুমনকে ছাড়া কিছু বোঝে না। আমাকে সে আবারো একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না।

সে আমার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছিল। আমি পূর্বের ন্যায় আবারো কান্নাকাটি, অসুস্থ হওয়া ইত্যাদি শুরু করলাম কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছিলনা। আমি তার মাকে পর্যন্ত ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করতাম আর আমার কান্না দেখে তার মা, বোন সকলেই কাদত। কিন্তু সে সুমনকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। বুঝলাম আমি আসলে এই ৮ টা বছরে রুমানাকে সেই পরিমান ভালবাসা দিতে পারি নাই, যেটা সুমন দিতে পেরেছে ৮ দিনে।

তাকে ছেড়ে দিলাম। তাকে ছেড়ে দিতে আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু উপায় নেই। জোড় করে এসব হয় না। আমার সারা জীবনের কষ্টের বিনিময়ে সে সুখী হোক না।

নতুন একটা জীবন শুরু করলাম। শুধু নেশা করে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে লাগলাম কারন আমি এটা মেনে নিতে পারছিলাম না যে আমার একটা দিন রুমানাকে ছাড়া কাটবে, এই ৮ টা বছরে এমন একটা ঘন্টা নেই যে আমি রুমানার সাথে কথা না বলে থেকেছি। আমার নেশা ছেড়ে গেলেই হু হু করে কাঁদতাম, একা লাগত, খুব ভয় লাগত। আমার অবস্থা দেখে আমার বাবা কাদত, আমার মা কাদত, কাদত ছোট ভাইটাও। অবস্থা দেখে আমার মা রুমানাকে ফোন দেয়, রুমানার বাড়িতে আমার বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় কিন্তু কাজ হয় না।

তাই আমার বাবা এবং মা সিদ্ধান্ত নেন আমাকে বিয়ে দেবেন। বিয়ে দিলে আমার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি রাজী হই না। আমার এক কথা রুমানাকে ছাড়া আমি বাচব না, তোমরা আমাকে কয়দিন বাচায়া রাখবা? এর মাঝে আমি একদিন মদ খেয়ে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। তিন দিন জ্ঞান নাই।

যখন আমার জ্ঞান ফেরে, দেখি আমি হসপিটালে, বোনটা চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে আমার ভাইকে আমি ফেরত চাই। আপাকে কথা দেই, তোর ভাইকে ফেরত পাবি, দেখিস আপু আমি কখনোই আর তাকে নিয়ে ভাববো না। সুস্থ হয়ে নেশা করা ছেড়ে দিলাম। রুমানার বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনতাম রুমানা এবং সুমনের প্রেমের কথা, ডেটিং এর কথা। কলিজাটা আমার ছিড়ে যেত তখন।

ভাবতাম একটা মানুষ কিভাবে এত্ত বেইমান হতে পারে। ভাবতাম আচ্ছা সে যে আমাকে এত্ত এত্ত ভালবাসত, তার কি একটা বার ও মনে হয় না, আমি কিভাবে বেচে আছি? কিভাবে একটা মানুষ আরেক জনকে এত্ত কষ্ট দিয়ে নিজে এত সুখ ভোগ করতে পারে। এরপর ও কেন জানি আমার মনে হত রুমানা একদিন আমার কাছে ফিরবে, আর তাই আমি ৬ মাস তার জন্য অপেক্ষা করি। নানা ভাবে তার বান্ধবীদের দ্বারা তাকে আমার দিকে ফেরানোর চেষ্টা করি কিন্তু কোন লাভ হয় না। আমি ফোন দিয়ে সুমনের পায়ে ধরি, ধরে বলি সুমন ভাই, আপনার রুমানাকে না পেলে কিছু যায় আসবে না কিন্তু আমাদের ৮ বছরের একটা সম্পর্ক নষ্ট হলে, দুটো জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।

সুমনের এক কথা, আমাকে বলে লাভ নেই, রুমানাকে বলেন। সে আপনার কাছে যেতে চাইলে আমার কোন আপত্তি নাই। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগত, যার জন্য সারাটা জীবন এত কিছু করলাম, এত্ত ভালবাসলাম তাকে ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে আরেক জনের কাছ থেকে। একবার মনে হয়েছিল সুমন নামের এই কীটটাকে খুন করে ফেলি, কিন্তু তাকে আমি ক্ষমা করে দেই কারন আমার ঘরের লোক ই ঠিক ছিলনা, পরকে কি বলব? রীতিমত তাড়াহুড়া করে আমি বিয়ে করলাম, না দেখেই। কারন আমি ততদিনে শোক ভূলে, প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠেছি।

আমি চেয়েছি রুমানা আমার জীবনে ফিরতে চাইলে আমি না করতে পারব না। আর তাই বিয়ে করে ফেললে, আমি চাইলেও কিছু করতে পারব না। তার প্রতি আমার সারা জীবনের প্রতিশোধ। তারাহুরা করে বিয়েতে বসলাম। আমার বউ ও আমাকে দেখে নাই, আমিও তাকে দেখি না।

না দেখেই কবুল। আমার বিয়ে ৬ মাস পর রুমানার ফোন- আমাকে ক্ষমা কর। আমি আসলে বুঝি নাই। সুমন আমার মোহ ছিল, কিন্তু আমি তোমাকেই ভালবাসি। তুমি তোমার বউকে ডিভোর্স দাও।

চল আমরা পালিয়ে যাই। আমি তাকে উত্তর দেই- অসম্ভব। তুমি আটটা বছর আমার কাছে থেকে, এই সিদ্ধান্ত নিতে পারনি যে আমার সাথে বাকী জীবন থাকবা কিনা আর যে মেয়েটা আমাকে না দেখে, না জেনে, না শুনে আট মিনিটে আমার সাথে সারাটা জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে আমি ছাড়বো কিভাবে???
বিয়ে করেছি ঠিকই কিন্তু রুমানাকে ভূলতে পারিনাই। ভুলতে আমি তাকে কখনোই পারবনা। তাকে মৃত ঘোষনা করেছি আমার কাছে।

তার কথা মনে হলেই নিজেকে বলে উঠি, মৃত মানুষ ফিরবে কি করে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.