আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাচন আইনগত বৈধতা পেলেও গ্রহণযোগ্য হবে না

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধতা পেলেও নৈতিক ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের নগর সম্পাদক শিমুল মাহমুদ

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগামীকাল দশম জাতীয় সংসদের বহুল আলোচিত নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এম সাখাওয়াত হোসেন : সরকারই বলছে এটি হচ্ছে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। এ নির্বাচনে এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেছেন।

প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে নেই। ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকায় যাচ্ছে। নির্বাচনের মাঠে কোনো উত্তাপ দেখছি না। ১৪৭ আসনে যে নির্বাচন হচ্ছে তাতেও তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই। উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই।

নির্বাচনী প্রতিপক্ষ না থাকায় এ নির্বাচন সর্বজনীন নয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই। এসব প্রেক্ষাপটে আগামীকালের নির্বাচনে জনমতের কোনো প্রতিফলন ঘটবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারি দল বলছে এটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন। আপনি কীভাবে দেখছেন?

এম সাখাওয়াত হোসেন : যদিও সরকার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে নির্বাচন করছে, এটা যে খুব একটা অর্থবহ নির্বাচন হবে তা বলা যাচ্ছে না।

আইনগতভাবে এ নির্বাচন বৈধতা পেলেও এটি সাধারণ মানুষের কাছে ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এর পাশাপাশি দেশ-বিদেশেও এর গ্রহণযোগ্যতা থাকছে না। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এরই মধ্যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলেছে। সরকার যে বলছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন, এখন এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে কত জন ভোট কেন্দ্রে যাবে সেটাই দেখার বিষয়। এক হাজার ভোটার ভোট দিলেও নির্বাচন হয়ে যাবে।

এক শতাংশ ভোট পড়লেও ভোটের আইনগত বৈধতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের নির্বাচনী আইনে কোথাও নেই যে কত শতাংশ ভোট পেলে নির্বাচনটি বৈধ হবে। তবে জনমতের ব্যাপারটি তো রয়েছেই। আমি মনে করি, সরকারের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা আসলে রাজনৈতিক স্টান্ট। নির্বাচনে ভোটার না থাকলে তো গণতন্ত্রের চর্চা হয় না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অর্থমন্ত্রী সিলেটে নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে বলেছেন নির্বাচিত হলে তারা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন না।

এম সাখাওয়াত হোসেন : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে কি না তা নির্ভর করছে তখন সার্বিক পরিস্থিতি কী হয় তার ওপর। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য তো এ নির্বাচন নয়। তারা তো তাদের সরকারের নেপথ্যে ব্যাপক জনসমর্থন দাবি করতে পারবে না। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ।

এখন তো সেই সমর্থনের কথা আর বলতে পারবে না। এ জন্য দশম সংসদের নির্বাচিতরা কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন তা রাজনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। আমি মনে করি, ক্ষমতায় অনেকভাবে থাকা যায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। দেশের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকবে বলে মনে হয় না।

এ ধরনের নির্বাচন কোনো দেশে হয়নি। জনগণের চোখে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ছবিটি এখনো ভাসছে। তা ছিল একটা ভালো নির্বাচন। আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন। সেটা এখন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগামীকালের নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কীভাবে দেখছেন। তারা কি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে?

এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব পদক্ষেপ নেওয়া। এ কমিশন সে দায়িত্বটি পালন করতে পারেনি। নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। ৯০ দিনের নির্বাচনী সময়ের মধ্যে পরিবেশ তৈরি করা তার একটি অন্যতম।

আমাদের দেশে নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এখানে একটি সরকার রয়েছে। সরকারপ্রধানও নির্বাচন করছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ নিশ্চিত করতে পারছে না কমিশন।

বর্তমান কমিশন ৯০ দিন বাদ দিয়ে ৪৫ দিন থেকে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছে। তারা পরিবেশ তৈরির সুযোগ পায়নি। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই ছিল বিচারপতি খায়রুল হকের অবজারভেশন। তার অবজারভেশনে ছিল, নির্বাচনের নূ্যনতম ৪২ দিন আগে সংসদটা ভেঙে দিতে হবে। তা হয়নি।

যে সরকারটি নির্বাচনকালীন হওয়ার কথা ছিল, সে সরকারটি নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে থাকেনি। যে কারণে পরিবেশটা ঘোলাটে হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনও নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করছে। তারা কখনো বলেনি যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে আমরা নির্বাচন করব না। তারাও গতানুগতিক পথেই হাঁটছে।

সবাইকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়নি কমিশন। তারা বলেছে উদ্যোগ নেওয়া আমাদের কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ১২টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ ১২টির মধ্যেও ৬টি দল নেই বললেই চলে।

তাদের কয়েকজন মাত্র প্রার্থী।

আমি ২০০৮ সালের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তখন এ রকম সংকট না হলেও মোটামুটি সংকট ছিল। আমাদের টার্গেট ছিল সব দলকে নির্বাচনে না আনা গেলে আমাদের পক্ষে সে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে না। এমনকি কোনো কোনো দল আলোচনায় আসেওনি। তারা না এলেও আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতির ভেতরে থেকেই নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হবে। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত সব কিছুর দায়দায়িত্ব কমিশনের ওপরই বর্তায়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের প্রধান বিরোধী দল ও জোট নির্বাচনে নেই।

তবুও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিভিন্ন এলাকায় নাজেহাল হচ্ছেন। সরকারি দলের প্রার্থীরা হুমকি দিচ্ছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।

এম সাখাওয়াত হোসেন : প্রধান বিরোধী দল না থাকায় উত্তাপ ও উত্তেজনাহীন এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। সরকারি দলের অনেক নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।

ফলে বিরোধ ও সংঘাতের যে ছোটখাটো ঘটনা ঘটছে এটা স্বাভাবিক। নির্বাচনের কারণে অনেক এলাকায় নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসছে। সব দল অংশ নিলে নির্বাচন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারত।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নজিরবিহীনভাবে ১৫৩ জন প্রার্থী ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। একে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এম সাখাওয়াত হোসেন : কোনো ভোট ছাড়াই ১৫৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেছেন এটা গণতান্ত্রিক ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনেও এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারেননি। তখন ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৯ জন। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে ভোটারবিহীন নির্বাচনে কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা না থাকলে তা নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। দশম জাতীয় সংসদও সেদিকেই যাত্রা শুরু করবে।

এখানে ভোটারদের ভোট দেওয়ার আগেই সংসদ সদস্য হয়ে গেছেন ১৫৩ জন। বাকিগুলোয় ৮০ ভাগই সরকারি দলের প্রার্থী জিতবেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রার্থীরা অধিকাংশই তাদের হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। অনেকের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে অনেক গুণ হয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।

এম সাখাওয়াত হোসেন : জনপ্রতিনিধি কিংবা যে কারও সম্পদ বাড়তেই পারে। কিন্তু এ সম্পদ বাড়ার সঙ্গে তাদের 'সোর্স অব ইনকাম' বা আয়ের উৎসটা স্বচ্ছ কি না তা দেখতে হবে। তারা যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেছেন তা বৈধ কি না দেখতে হবে। তারা নিয়মমতো ট্যাঙ্ দিয়েছেন কি না তাও বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একজন এমপি সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়াতে পারেন না।

তাও করেছেন কেউ কেউ। সেসব বিষয় বিবেচনায় এনে তদন্ত করা প্রয়োজন। এসব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুর্নীতি দমন কমিশনের দেখার কথা। অনেকে নিজেদের প্রকৃত সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন হলফনামায়। এটাও প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন।

এ ছাড়া যাদের সম্পদ সন্দেহজনকভাবে বেড়েছে তাদের ব্যাপারে তদন্ত হতে পারে। তবে আমি ঢালাওভাবে সবার সম্পদ অবৈধ বলছি না। কিন্তু যাদের হলফনামা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাদের ব্যাপারে তদন্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রার্থীদের সম্পদের হলফনামা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রশ্ন ওঠার পর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে কিংবা সেসব তথ্য এখন আর কেউ দেখতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনের এ তৎপরতা কীভাবে দেখছেন?

এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পদের হলফনামার তথ্য গোপন রাখার কিছু নেই।

এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনও কিছু দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনার দৃষ্টিতে দশম জাতীয় সংসদের ভবিষ্যৎ কী? একাদশ নির্বাচন কি আগেভাগেই হয়ে যাবে?

এম সাখাওয়াত হোসেন : দশম জাতীয় সংসদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার তিনটি প্রক্রিয়া রয়েছে। একটি হচ্ছে, এটি আইনগতভাবে বৈধ কি না। দ্বিতীয়ত, নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কি না এবং তৃতীয়ত, নির্বাচনটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য কি না।

দশম জাতীয় সংসদ আইনগতভাবে বৈধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় একটি দায় থেকে মুক্ত থাকা যাবে। কিন্তু নৈতিকভাবে কোনো দিক থেকেই এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। অন্যদিকে সামাজিকভাবেও নির্বাচনটি অগ্রহণযোগ্য থেকে যাবে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত আরও একটি নির্বাচন করা ছাড়া সরকারি দলের পক্ষে আর কোনো বিকল্প থাকবে না।

 

 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.