আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাঠশালা

গাধার মা-ও কম যায় না। তারস্বরে চেঁচিয়ে বললেন, “তুমি মনে হয় খুব কথা শুনতে! তুমিও তো ছোটবেলায় বামে যেতে বললে ডানে যেতে। যেতে না?”
বাবার গাধা বললেন, “কে বলেছে তোমাকে?”
“আমি জানি। ”
“কেমন করে জানো?”
“আমাদের গাধুটাকে দেখলেই বোঝা যায়। ও ঠিক তোমার মতো হয়েছে।


বাবা-গাধা একটা কাশি দিয়ে বললেন, “সে যাক। নিজেদের ছোটবেলা নিয়ে এই বয়সে এসে ঝগড়াঝাটি করে লাভ নেই। তারচেয়ে আমাদের গাধুটাকে কীভাবে ঠিকঠাক মতো চালানো যায়, সেটাই ভাবি। ”
“রক্তের ডাক এড়ানো যায় না। ওর রক্তের মধ্যেই মিশে আছে গাধামি।

ও গাধাই হবে। ”
“তোমার কথা ঠিক নয়। শুনেছি ঠিক মতো লেখাপড়া করলে নাকি গাধাও ঠিক হয়ে যায়। ”
মা গাধা অবাক হয়ে বললেন, “সত্যি!”
“তবে আর বলছি কী! একেবারেই ঠিক কথা। ”
“কিন্তু গাধাদের লেখাপড়া করার জায়গা কোথায়? গাধাদের জন্য তো আর স্কুল নেই।

আছে?”
“নেই কে বলল। আছে। মানুষের স্কুলেই গাধাদের জন্য আলাদা বসার জায়গা আছে। ”
“কী যা-তা বলছ। মানুষের স্কুলে গাধাদের কি ঢুকতে দেয়?”
“দেয়।

একদিন আমি নিজের কানেই শুনেছি। এক টিচার তার এক ছাত্রকে চেঁচিয়ে বলছেন-- গাধা কোথাকার! কাকে গাধা বলেছে টিচার জানো?”
“কাকে?”
“কাকে বলেছে তা-ও বুঝতে পারনি? আসলেই তুমি একটা গাধি। ”




ব্যস। ওতেই রেগে গেলেন মা-গাধা। আবারও তারস্বরে চেঁচিয়ে বললেন, “শোনো গাধি হয়ে জন্মেছি বলে বারবার মনে করিয়ে দিও না।

তুমি যে কারণে গাধা হয়ে জন্মেছ, আমিও সে কারণেই গাধি হয়ে জন্মেছি। তুমি আর আমি সমান। বুঝেছ? তুমি নিজেই তো একটা গাধা। আমাদের গাধু তো এজন্যই এখনও গাধা রয়ে গেল। ”
“তুমিও তো বারবার নিজের দোষ ঢাকার জন্য আমার ছোটবেলা টেনে আনছ।

ছোটবেলায় আমরা কে কী ছিলাম, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে আমরা বড় হয়ে কে কী করছি। ”
“খুব বড় বড় কথা হচ্ছে। ছোটবেলায় যেমন পিঠের উপর বোঝা বয়ে বেড়াতে, এখনও তো তা-ই করতে হচ্ছে তোমায়। ”
“তুমিও তো বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছ।


“গাধা হয়ে জন্মালে এমন বোঝা বয়েই বেড়াতে হবে। ওটাই গাধাদের কাজ। ”
“কিন্তু আমি চাই না আমাদের গাধুও বোঝা বয়ে বেড়াক। তুমি চাও?”
“আমিও চাই না। ”
“এ জন্যই তো আমাদের গাধুকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে চাই।

মানুষের স্কুলে। ”
“মানুষের স্কুলে কি আমাদের গাধুকে নেবে?”
“কেন নেবে না? অবশ্যই নেবে। ওই যে বললাম, একদিন আমি এক টিচারকে বলতে শুনেছিলাম-- গাধা কোথাকার! ওটা কাকে বলেছে জানো?”
“কাকে বলেছে?”
“অবশ্যই একটা গাধাকে বলেছে। কেন বলেছে জানো?”
“কেন বলেছে?”
“ওর ঠিকানা জানার জন্য বলেছে। টিচার আসলে জানতে চেয়েছিলেন ও কোন জঙ্গলের গাধা।

মনে হয় ওর স্কুলের বেতন বাকি পড়ে গিয়েছিল। স্কুলের বেতন বাকি পড়ে গেলে টিচারদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। ঘন ঘন নোটিশ পাঠায় ছাত্রদের বাবা-মার কাছে। অনেক সময় পরীক্ষাও দিতে দেয় না। ”
“উঁহু! তুমি ঠিক কথা বলছ না।

টিচাররা এমন হতেই পারেন না। টিচাররা তো আর তোমার আমার মতো গাধা নন। ”
“তুমি আসলেই একটা গাধি। টিচারদের সম্পর্কে তুমি কী জানো শুনি? কিছুই জানো না। ”
“তুমি মনে হয় খুব জানো!”
“জানিই তো।


“কী কী জানো শুনি?”
“টিচারদের হাতে একটা লাঠি থাকবে। ইয়া বড়। ”




“লাঠি আবার কেন? লাঠি তো শুনেছি পুলিশের হাতে থাকে। চোর-ডাকাত পেটানোর জন্য। ছাত্ররা কি চোর না ডাকাত যে ওদের শায়েস্তা করতে লাঠি লাগবে?”
“কী জানি! সেটা জানি না।

টিচারদের রকম-সকম বুঝি না। ”
“টিচারদের মাথা বুঝি সব সময় গরম থাকে?”
“থাকতেই পারে। গাধা, গরু, ছাগল, মানুষ-- সবাইকে এক সঙ্গে পড়াতে গেলে মাথা তো গরম হতেই পারে। ”
“সবাইকে এক সঙ্গে পড়ান নাকি টিচাররা?”
“পড়ানই তো। আমি নিজের কানেই শুনেছি, এক টিচার বলছেন-- এই গাধা এদিকে আয়।

আবার আরেকজনকে বলছেন-- এই গরু তুই পড়া শিখে আসিসনি কেন? অন্য এক ছাত্রকে বলছেন-- এই ছাগল, এটা কী লিখেছিস?”
মা গাধা চমকে উঠলেন, “বল কী! গাধা, গরু, ছাগল, মানুষ-- সবাইকে এক সাথে পড়ান? সবার ভাষা তিনি বুঝতে পারেন?”
“মনে হয় পারেন। না পারলে সবার সাথে কথা বলেন কী করে?”
“আর কেউ পড়ে না? মানে বাঘ, সিংহ, শেয়াল, সাপ-- এরা কেউ পড়তে যায় না?”
“মনে হয় ওদের লেখাপড়া করার ইচ্ছে নেই। কিংবা টিচাররা ওদের স্কুলে ভর্তি করেন না। ”
“তাহলে তো ভালোই। তুমি ভাব একবার, আমাদের গাধু একটা সিংহের পাশে বসে লেখাপড়া করছে!”
“সিংহের পাশে বসে লেখাপড়া করলে কী হবে?”
“কী হবে মানে? লেখাপড়া করতে করতে যদি সিংহটার খিদে পেয়ে যায়, তখন তো আমাদের গাধুকেই খাবার বানিয়ে খেয়ে ফেলবে।


“তুমি আসলেই একটা গাধি। খিদে পেলে এক ছাত্র কি অন্য ছাত্রকে খেয়ে ফেলে নাকি?”
“সিংহের বেলায় বলা যায় না। দেখা গেল, টিচারকেই গিলে খেয়ে ফেলল। তখন? তখন কে ওদের লেখাপড়া শেখাবে? খিদে পেলে সিংহদের কি হুঁশ থাকে?”
বাবা গাধা এবার কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “তাহলে তো মানুষের স্কুলে আমাদের গাধুকে ভর্তি করানোয় বেশ বিপদ আছে দেখছি।


“মানুষের স্কুল ছাড়া আর কোনো স্কুল নেই?”
বাবা গাধার তখনই মনে পড়ল একটা স্কুলের কথা। আর মনে পড়তেই চার পায়ে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বললেন, “পেয়েছি!”
“কী পেয়েছ?”
“খড় পেয়েছি। ”
মা গাধা কিছুই বুঝতে পারলেন না। হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন বাবা গাধার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ।

তারপর এক সময় হাঁ বন্ধ করে বললেন, “খড় দিয়ে কী হবে?”
বাবা গাধা বললেন, “ওটা তুমি বুঝবে না। আমি এখনই আমাদের গাধুকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করছি। ”
বলেই আর দেরি করলেন না বাবা-গাধা। চারপায়ে ছুটতে লাগলেন। বনের ঠিক মাঝামাঝি শেয়ালপণ্ডিতের একটা পাঠশালা আছে।

ওখানে বনের পশুরা লেখাপড়া শিখতে যায়। ওখানেই গাধুকে ভর্তি করিয়ে দেবেন।

পণ্ডিত শেয়ালের পাঠশালা। বনের নানান পশুরা লেখাপড়া শিখতে এসেছে এখানে। সজারু, সাপ, গণ্ডার, জিরাফ, উল্লুক, বানর-- সবাই।

একটু পর গাধুও হাজির হল।
গাধুকে দেখে পণ্ডিত শেয়াল জানতে চাইলেন, “এসেছিস তাহলে? তোর ভর্তির দরখাস্ত পেয়েছি। ”
তারপর একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, “ওই ওখানে গিয়ে বস। ”




গাধু বসতে বসতে পাঠশালার দিকে নজর বোলাল। আটচালার একটা ঘরকেই পাঠশালা বানিয়েছেন শেয়ালপণ্ডিত।

ঘরটা খড়ের তৈরি। বনের মধ্যে ইট-বালু সিমেন্টের ঘর পাবে কোথায় ওরা? ঘরের মেঝেটাও খড়-বিছানো। খড়ের উপরই বসে পড়ল গাধু। মেঝেতে বিছানো খড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো চকচক করে উঠল গাধুর। আহ! কী সুন্দর খড়।

এমন খড় দেখলে কেবল চিবুতেই ইচ্ছে করে। আনমনে দুটো খড় তুলে মুখেও পুরে দিল ও।
গাধু ভেবেছিল পণ্ডিত মশাই হয়ত দেখেনি। কিন্তু পণ্ডিত বলে কথা! আর সে পণ্ডিত যদি শেয়াল হয়, তাহলে তো কথাই নেই! তার চোখ ফাঁকি দেয় কার সাধ্যি? গাধুকে খড় চিবুতে ঠিকই দেখে ফেলেছেন পণ্ডিত শেয়াল। আর দেখেই খেঁকিয়ে উঠলেন, “খড় খাস তো?”
গাধু বলল, “জ্বি স্যার খাই।


পণ্ডিত শেয়াল বললেন, “তাহলে তো বড় চিন্তার কথা। নাহ! তোকে তো এই স্কুলে রাখা যাবে না। ”
গাধুরও কিন্তু খুব ইচ্ছে লেখাপড়া শিখবে। বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করবে। এর মধ্যেই ওর বাবা-মা বনের সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে-- “আমাদের গাধু লেখাপড়া শিখতে স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

ও ঠিক প্রথম হবে। ”
কিন্তু টিচার শেয়াল যদি ওকে স্কুলে না রাখেন, তাহলে ও প্রথম হবে কেমন করে?
গাধু জানতে চাইল, “কেন স্যার?”
পণ্ডিত শেয়াল বললেন, “আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে তোরা গাধারা খড় খাস। তোর মুখে দুটো খড়ের টুকরো আটকে আছে। আমি তোকে বরখাস্ত করলাম। তোর আর স্কুলে আসার দরকার নেই।


“কেন স্যার?”
“কেন আবার? পড়তে এসে শেষে আমার পাঠশালাটাই গিলে খাবি। তারচেয়ে ঘরে ফিরে যা। যে দিন খড় খাওয়া ভুলতে পারবি, সেদিন থেকে স্কুলে আসবি। ”
গাধু আর কী করে! পাঠশালা থেকে বেরিয়ে এল।
তারপর?
তারপর কী হলো সেটা আর বলা যাবে না।

কারণ সুকুমার বড়ুয়া এ পর্যন্তই লিখেছেন--
“নেপাল খুড়োর আটচালায়
শেয়াল গুরুর পাঠশালায়
গাধায় দিল দরখাস্ত
 
খড় বিছানো মেঝের পরে
শেয়াল বসে তারস্বরে
প্রশ্ন করেন: খড় খাসত?
 
থাক রে বাবা পড়তে এসে
পাঠশালাটাই গিলবি শেষে
করছি তোকে বরখাস্ত। ”
 
কাজেই এরপর কী হল, সেটা যদি সুকুমার বড়ুয়ার ‘পাঠশালা’ নামের ছড়ায় না থাকে, এই ‘পাঠশালা’ নামের গল্পটায় কেমন করে থাকবে! কারণ এই গল্পটা তো সুকুমার বড়ুয়ার ‘পাঠশালা’ নামের এই ছড়া থেকেই লেখা হয়েছে।

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।