আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষ বড়ই বৈচিত্রময়



ঢাকা মেডিকেল। আর্তনাদ, চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে গেলো। আমি বেডের বাইরে বসে আছি। খালা-খালু এ্যাকসিডেন্ট করেছে। তাদের দেখতে এসেছি, ঢাকা মেডিকেল মর্গে খালুর লাশ দেখে সবাই কান্নায় ফেটে পড়ল।

খালা তখনও বেডে শুয়ে আছে সুবোধ বালিকার মতো। স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি। কারণ, তিনিও এখন বেশ ইনজুরিতে ভুগছেন। মাথায় আঘাত পাওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর অজ্ঞান হচ্ছেন। তাকে বাতাস করা হচ্ছে।

আমি বেডের বাইরে এলাম। বারান্দায় এক ছেলেকে দেখলাম বুক ফাটা চিৎকার করছে, এগিয়ে গেলাম। তার কি হয়েছে জানতে চাইলে, ছেলেটির মা ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ব্রেন টিওমার। শুনা মাত্রই আমার পৃথিবীটা ঘোলাটে হয়ে গেল।

বয়স কতই আর হবে বারো, তেরো। আহ! এবয়সে তার এ পরিণতি। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। ছেলেটির বুকে হাত রেখে বললাম ভাই তোমার কি হয়েছে। ব্যাথা, ব্যাথা।

বাচঁবো না এরুপ কথা আওড়াচ্ছিলো। আমি বললাম, পাগল ছেলে তোমার কিছু হবে না। সে যেন আশার আলো ফিরে পেলো। হাউ মাউ করে কাঁদছিল, এখন কিছুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতে পারছিলো না, তাই বন্ধ রেখেই হাত বাড়িয়ে দিলো।

আমি ওর হাতটা ধরলাম, প্রচণ্ড গরম। মনে হয় জ্বর ১০৪/৫ এর উপরে হবে। সামনে টেনে নিলো। খুব কষ্ট করে অস্পষ্ট গলায় বলল, সত্যিই আমি কি এ দুনিয়ার আলো দেখতে পারবো? বন্ধুদের সাথে গ্রামের মেঠো পথে ঘুরে বেড়াতে পারব? এরুপ কিছুু বলেছে ধারণা করলাম। সাথে সাথে আমি বললাম তোমার বয়স আর কি হয়েছে? তুমি বাড়ি ফিরে যাবে, মায়ের পছন্দে বিয়ে করবে নাকি নিজেই পছন্দ করে রেখেছো? ছেলেটি অস্ফুট একটি হাসি দিলো।

আমার হাতটি সে ধরেই রাখল। এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়ল না। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে তার চিৎকার থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। একটু পর পর হাস্যরস করছিলাম। কারণ, এ মুহূর্তে রুগির জন্য স্বাভাবিক থাকা অত্যান্ত জরুরি।

গল্প করতে লাগলাম, ওর মার সাথে। খুব চঞ্চল ছেলেটি আমার, হঠাৎ বলল, মাথাটা ঘুরাচ্ছে। আমি তেমন গুরুত্ব দেইনি। পরদিন এমনিতেই সেরে গেল। প্রতিদিনের মত সেদিনও স্কুল থেকে ফিরল দেরী করে।

ওর একটা আলাদা ভুবন ছিল। পড়াশুনা খেলাধুলা সব কিছুতেই ছিল সবারচে অগ্রগামী, তাই বন্ধু মহলে ওর বেশ নাম ডাক ছিলো। আমার ছেলে হিশেবে নয় বরং গ্রামের সবাই বলে ওর মতো দ্বিতীয় আরেকটি ছেলে হয় না। একদিনের ঘটনা বললে বুঝবে, ওর বাবা অসুস্থ, তাই আমাদের বাড়িতে মন্দাবস্থা চলছিল। আমি এ বাড়ি ও বাড়ি কামলা খেটে সংসার চালাচ্ছিলাম।

খুব কমই দু'বেলা খাবার জুটতো। আমি প্রায় মিথ্যে বলে, নিজে ক্ষুধার্ত থাকতাম। একদিন আমার ও বিষয়টি বুঝতে পেরে, বায়না ধরল। ওকে খাইয়ে দিতে হবে, দু লোকমা না খেতেই বলে কি পেট ভরে গেছে। আমাকে বলল, মা তুমি তো আমাকে খাইয়ে দিলে, এবার আমি তোমাকে খাওয়াবো, না করবে না।

সেদিন যেনো আমার পেটে অন্ন নয় অমৃত পড়ছিলো। এভাবে রোজ এই বিষয়টা চলতে থাকে, পরে আমি বুঝতে পারলাম আসলে আমাকে খাওয়ানোর জন্য নিজে ক্ষুধার্ত থাকে। ছোট মনের এতো বিশালতায় আমার বুকটা ভরে যায়, অন্তর থেকে দোয়া করি। তার মাঝে আমি আমার আগামি দেখতে পাই। প্রত্যেকের নয়নমনি ছিল আমার এই ছেলেটি, গ্রামের ছোট বড় সকলকে সেবা করা ছিল তার অপার ধর্ম।

তার চাঞ্চল্যতায় পুরো গ্রাম ছিলো উজ্জীবিত, প্রাণোচ্ছল। কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে তার মাথা ব্যথা বেড়েই চলছে। গ্রামের স্বাথ্যকেন্দ্রে ওকে নিয়ে যাই, তারা কিছু ব্যথার বরি দিয়ে বলে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সেগুলো কোন কাজে আসেনি। পরে ওর চিৎকার সইতে না পেরে গ্রামের চেয়ারম্যান মনসুর আলি চাচার কাছে যাই।

তিনি খুবই অমায়িক লোক, আমাকে কিছু টাকা দিয়ে সদরে পাঠালেন ছেলের চিকিৎসা করাতে। সেখান থেকে তারা ঢাকা মেডিকেলে আনার পরামর্শ দেয়। এখানে ডাক্তাররা পরিক্ষা নিরিক্ষা করে বলে ওর ব্রেন টিওমার হয়েছে, দ্রুত চিকিৎসা না করালে বাঁচবে না। গ্রামের ভিটে বাড়ি যা ছিলো সবই বিক্রি করে দিয়েছি। আজ ওর অপারেশন ছিল, কিন্তু ডাক্তার সাহেব বলেছেন, আরো অনেক টাকা লাগবে।

বুঝলে বাবা গরিবদের বেঁচে থাকা বড় দায়! আজ টাকা জোগাড় না করতে পারায় ওর অপারেশন করা যায়নি, আর ওর ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। জানি না কাল কি হবে? আমি বললাম, মা আপনি কাঁদবেন না। ওর কিছু হবে না। ওতো ভাল হয়ে যাবে, আপনার সাথে বাড়ি ফিরে আপনার দুঃখ কষ্ট মোচন করবে। আমি জানতাম ছেলেটি বাঁচবে না।

কারণ, বাঁচার কোন আলামত তার মধ্য ছিলো না। তারপরও সান্ত্বনা দিলাম। আমার কথায় ছেলেটি এতটাই আত্মবিশ্বাসী হলো যে, সে উঠে বসল। মিটি মিটি করে চোখ খুলে আমায় দেখলো। ওর চোখে রক্ত জমে আছে।

মনে হয় এক্ষুণি রক্ত বের হয়ে পরবে। ওর মাকে ইশারা করলাম কিছু খাওয়াতে। মা ছেলের পছন্দের খাবার গুড় আর রুটি দিল। একটু খেয়ে, মার আনন্দ আর ধরে না। প্রায় দু'দিন যাবৎ পানি ছাড়া কিছুই খায়নি।


আমি বললাম কি হয়েছে? বলল, ভাইয়া তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, তাই শেষবারের মত চোখ দুটো মেলে তোমাকে দেখছিলাম। দূর বোকা কি বলছিস। এতো অল্প সময়ে ছেলেটি আমাকে পৃথিবীতে সবচে আপন ভাবতে লাগল, অথচ আমি তো তার জন্য কিছুই করতে পরবো না সেও জানে। হে আল্লাহ তোমার কুদরত বোঝা বড় দায়! আজও ওর হাত ধরে রাখার ঐ কথা স্মরণ এলে আমি গোপনে কাঁদি। মানুষ বড় বৈচিত্রময়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.