আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ জাফরুল আহসান তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ব্্িরটিশ ঔপনিবেশিকবাদের শিকল ভেঙে ১৯৪৭ সালে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে জন্ম নেয় দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র। পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান আবার দু’টি অংশে বিভক্ত। ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান আর ৪৪ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আবাস পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে দূরত্ব ১২০০ মাইল।

১২০০ মাইল দূরে হলেও পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যক্রম পরিচালিত হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ অর্থাৎ বাঙালি জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও ন্যায্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হাতে হাতে এক সময় উপলব্ধি করেছিল দাবি আদায়ে হতে হবে সোচ্চার। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ গণ-আন্দোলন বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল স্বাধিকার আদায়ে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির সাধারণ নির্বাচনে (জাতীয় সংসদে) একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতায় বসাতে পারেনি বাঙালি জাতি। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নির্যাতন আর নিপীড়নের স্টিমরোলার চালিয়েছে বাঙালির ওপর।

নিরীহ বাঙালির ওপর নির্বচারে গুলি চালিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। পরাজয় মানতে শেখেনি বাঙালি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি গর্জে উঠল স্বাধীনতার প্রশ্নে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হলো রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বদলে গেল বিশ্ব মানচিত্র।

পাকিস্তানের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল দীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় শ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর ঐতিহাসিক বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় শেষে একটি স্বাধীন জাতিসত্তার বিনম্র উপস্থিতি আঁচ করতে পারে বিশ্ববাসী। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় বাঙালিকে দিয়েছে পাহাড়সম অহঙ্কার, সার্বভৌম আবাসভূমি আর লাল সবুজের পতাকা।

এমনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া নানা পেশার মানুষÑ লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, শ্রমিক, কবি, গাল্পিক, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর তথা সর্বস্তরের জনগণের সম্মিলিত বিজয়ের ফসল এই বাংলাদেশ। স্বাধীনতার বয়স এখন ৪১ বছর। অর্থাৎ ৪১ বছর আগে বাঙালি অংশ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে? কেউ কেউ বলেন যথেষ্ট। আবার ভিন্ন মতাবলম্বীরা বলেন, প্রত্যাশার তুলনায় সামান্য।

যে যাই বলুক, আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চেয়েছি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা কবিতায় কবিরা কিভাবে মুক্তযুদ্ধকে কবিতায় তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন, পঞ্চাশের দশকের কবিদের হাতেই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার হাওয়া বইতে শুরু করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা কবিকণ্ঠকে সচকিত করেছে সেই সাথে প্রবল আত্মবিশ্বাসের অসঙ্কোচ প্রকাশ ভঙ্গি কবিতার শরীরকে করেছে সমৃদ্ধ। উদাহরণ হিসেবে নিম্নের উদ্ধৃতাংশ দেখা যাক : ০১. পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে নতুন নিশান উড়য়ে দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। [শামসুর রাহমান/তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা] ০২. কোনখানে কেউ বিমর্ষ নয় শোকে মৃত্যুর ভয়ে বিচলিত কেউ নয় জনতার জয় সে কার সাধ্য রোখে মৃত্যু পেরিয়ে হাসে মৃত্যুঞ্জয়।

[মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান/ জার্নাল ১৯৭১] ০৩. এক ঝাক বুলেট ওর বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে ছুটে গেল এবং তখন লুণ্ঠিত সোনালি হৃদপিণ্ডের পতাকা পিচের উপর ঝলকে পড়া রাশ রাশ আপন রক্তের মধ্যে হাত ডুবিয়ে প্রাণপণে উঠতে উঠতে কাঁপতে কাঁপতে আঙুলে লিখল কাচের দেয়ালে অবাক বর্ণমালা বা-ং-লা-দে-শ। [্আলাউদ্দিন আল আজাদ/স্বাধীনতা ওগো স্বাধীনতা] প্রবল আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় অঙ্গীকারের আমোঘ বাণী উচ্চারিত হতে দেখি কবিতায়। মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযুদ্ধার হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, স্বাধীনতা তোমাকে আসতেই হবে, অর্থাৎ বাঙালির সামনে স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব ছিল বলেই কবির আগাম বার্তা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। আসলে কবি যে আগাম বার্তারই রূপকার। পঞ্চাশের দশকের কবিদের পাশাপাশি ষাটের দশকের কবিদের কবিতায় প্রচলিত রীতি-নীতিকে অগ্রাহ্য করার মানসিকতা সুস্পষ্ট।

নৈরাজ্য আর অবিশ্বাস কুরে খায় ষাটের কবিদের। পারিপার্শ্বিক সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা কবিতায় প্রতিফলিত হতে দেখি। আগুন আর বিদ্রোহে উত্তপ্ত রাজপথের আঁচ লাগে কবিতায়। দেখা যাক ষাটের কবিদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ০১. অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে আঠিল জল হৃদয়ে লাগিল দোলা জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসৌর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনাল তার অমর কবিতাখানি [নির্মলেন্দু/ স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল] ০২. একজন মুক্তিযোদ্ধার এই ডায়রিতে আমি বঙ্গোপসাগরের কলধ্বনি শুনি শুনি অপূর্ব লালিত্যময় কণ্ঠে গাওয়া আমার সোনার বাংলা একজন মুক্তিযোদ্ধার সমগ্র ডায়েরি জুড়ে আমি লেখা দেখি শেখ মুজিবের নাম। [মহাদেব সাহা/ একজন মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরিতে] ০৩. তবুও তোমার কাছে আত্মসমর্পণে সুখ আছে কিন্তু, সাবধানে কোথাও কখনো যদি তোমার সঙ্গে বঙ্গবীর সিদ্দিকীর দেখা হয়ে যায়, প্লিজ পায়ে পড়ি এ কথাটি ভুলেও বলবে না কেননা ন’মাসে আমরা তাঁর কাছে ‘হ্যান্ডস আপ’ করা কখনো শিখিনি। [রফিক আজাদ/ একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসর্মপণ] ০৪. অথচ তোমাকে আজ আমি সেই কারাগারে সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে মানুষকে ভালোবাসা-ভালোবাসি বলে যদি কোন দিন আসে আবার দুর্দিন, যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে ভেঙে সেই কালো কারাগার আবার প্রনয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার। [হেলাল হাফিজ/ অস্ত্র সমর্পণ] তার পরও কি ধরে নেব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি খুব একটা হয়নি, যা হয়েছে তা প্রত্যাশার তুলনায় যৎসামান্য। শিল্প সাহিত্য সত্যি কি মুক্তিযুদ্ধ যথাযথ প্রতিফলিত হয়নি? এ প্রসঙ্গ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর বক্তব্য তুলে ধরছি আরো স্বচ্ছতার জন্য।

“পৃথিবীর বিখ্যাত বিপ্লবগুলো অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে মহৎ সৃষ্টির পেছনে। ফরাসি বিপ্লব অথবা রুশ বিপ্লবের রয়েছে এক বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার। পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়নি; কিন্তু একটি সীমিত ভূগোল তোলপাড় তুলেছে, তেমন জাতীয় রাজনৈতিক ঘটনাবলওি জন্ম দিয়েছে ধ্রুপদ সাহিত্যের, প্রাণস্পর্শী শিল্পের। আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা প্রাপ্তি, লাতিন আমেরিকার বামপান্থী বিপ্লব অথবা ষাটের দশকে ইউরোপে দ্রুত ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক আদর্শিক পট পরিবর্তনের উদাহরণ আমাদের জীবনকাল থেকে সংগৃহীত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে যদি সেই নিরিখে বিচার করি আমরা, তাহলে এর বিশালতাকে ওই ঘটনার বহিঃস্থ একজন প্রত্যক্ষদর্শীও স্বীকার করে নেবেন।

কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী শিল্প-সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কেন উপস্থিত নয়, যতটা থাকা উচিত ছিল, অন্তত অনেক পাঠক সমালোচক যা মনে করেন, সেই প্রশ্নটি অবধারিতভাবে উচ্চারিত হয় এবং আমাদের একটি শূন্যতা সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। ’ [সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম/ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি/ দৈনিক জনকণ্ঠ ২৬ মার্চ ২০০০ বিশেষ সংখ্যা] তবে এ কথা বলা যায় পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিদের চেয়ে সত্তর দশকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের সরব উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। কেননা সত্তরের কবিতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল। বিষয় বৈচিত্র্য, কবিতার দর্শন ও কবিতার নন্দনতত্ত্ব সত্তরের কবিতাকে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে। সত্তরের কবিরা ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে অথবা বলা যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে।

স্বভাবতই সত্তরের কবিরা সময়ের দাবি মিটিয়েছেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক সাথে এত কবির আবির্ভাব অন্য দশকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখানে মাত্র ক’জন কবির কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো। ০১. লাখো ঠোঁটে মুখে দুই হাত তুলে তাই সেøাগানে কাঁপাই আকাশের পুরোটাই রাত পোহানোর শেষে আজ ফিরে চাই আগুনে পাকানো ভোরের সূর্যটাই [আতাহার খান/ চাই] ০২. আমি শুধুমাত্র বিজয়ের কথা বলি মহানন্দপুর শালবন, তার অলিগলি আর ভাঙা স্কুলের ফোকর দিয়ে বিজয় আমাকে চিনিয়েছে স্বাধীনতা, পায়ে গ্রেনেড খাওয়া খোকার চোখে ছিল স্বাধীনতা আমি সেই আলো পেয়েছিলাম আমার হৃদয় ছিল বিজয়ের গান। [মাহবুব হাসান/বিজয় আমার স্বাধীনতা] ০৩. এখানে ওখানে, বনে ও বাদাড়ে জলে ও ডাঙায় লাশের বহর আকাশ বিহারী শকুন-শকুনীর মহোৎসব কঠিন হৃদয় শোকের পতাকা পুড়িয়ে ফেলেছে আজ তার যুদ্ধযান সাহসী পা পঙ্গুতা ও ঘুণপোকার শিকার [মুজিবুল হক কবীর/মুক্তিযোদ্ধার গল্প] ০৪. বাংলাদেশ তুমি এক অত্যাশ্চর্য ফুল লক্ষ প্রাণ রক্ত ঢেলে ঢেলে সতেজ করেছে এই পাপড়িগুচ্ছ পতাকায়ও রক্তসূর্য ঝলোমলো দীপ্যমান এই পর্বে ঝরেছে অনেক প্রাণ লেগেছে সময়।

[হাসান হাফিজ/অদম্য অপরাজেয়] সত্তর পরবর্তী আশির দশকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তা বলতে গেলে স্বীকার করে নিতে হয় যে আশির দশকের কবিরা সত্তরের নির্মিত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদেরকে আলাদা করে চিনতে শিখেছে। অহেতুক স্লোগান সর্বস্ব বক্তব্য থেকে দূরে সরে গেছে। আশির দশকের কবিরা খুব সহজেই প্রচারের মোহ ত্যাগ করতে পেরেছিলেন, পাশাপাশি ছন্দ্ব নিয়ে আশির দশকের কজন কবি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থেকেছেন, সর্বত্রই ব্যতিক্রমধর্মী কিছু একটা করার মানসিকতা তাদের পেয়ে বসেছিল। আশির দশকের কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে বেলাল পালোয়ানের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। “আমরা জানি যে, মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা মহান ঘটনার বিশাল ছায়াপাত ঘটিয়েছে বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের উপর।

যার পথ ধরেই দেশপ্রেম, রাজনীতি, সমাজধারণা, রাষ্ট্রকাঠামোর যে সমকালীন নবনাব্যতা তার সুস্রোত ও কাদালিপ্ততার ভাব-প্রভাব, থেকে আমরা যে কবিতা লিখেছি বা লিখছি তা মুক্ত থাকতে পারেনি। স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকে আরম্ভ করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালের ব্যক্তি ও জাতীয় মনন যে রকম নতুনত্বের ধাক্কায় অনেকটা বেসামাল ছিল, শিল্পস্রোত সে নবত্বের ছায়াতল থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারেনি। ’ [আশির দশকের কবি ও কবিতা/ বেলাল পালোয়ান/ মাহমুদ কামাল সম্পাদিত সাহিত্যের কাগজ ‘অরণি’ জানুয়ারি-জুন ২০১১ সংখ্যা/পৃষ্ঠা ৩৮৪] এখন দেখার বিষয় আশির দশকের কবিরা কিভাবে তাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ তুলে ধরেছেন। ০১. একাত্তরে বেঁচে থাকবে কল্যাণ একাত্তরে বেঁচে থাকবে শিশুরা একাত্তরে বেঁচে থাকবে স্বপ্নেরা একাত্তরে বেঁচে থাকবে অতীত একাত্তরে বেঁচে থাকবে আগামী আমাদের আবার দাঁড়াতে হবে এইখানে একাত্তরে। [গোলাম কিবরিয়া পিনু/এইখানে] ০২. আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেলো মূল্যবোধ, মানবিকতা ভাসমান লাশের মিছিলে যোগ হলো প্রতিহিংসার ধ্রুপদ আগুন তারপর শুধু ইতিহাস এ ইতিহাস বিজয়ের।

[নূরুল হক/মুক্তিযুদ্ধ] ০৩. আমি এক মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি যুদ্ধে যার একটি পা খোওয়া গেছে এখন এক পায়ে লাফিয়ে চলে আগে তাকে দেখলে কষ্ট হতো আমাদের স্বাধীনতা তার একটি পা নিয়েছে বর্তমানে সে মুক্তিযুদ্ধো। [মজিদ মাহমুদ/ মুক্তিযোদ্ধা] ০৪. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, চরমপত্র থেমে গিয়েছিল, আর সম্মুখ সমর, আত্মদান স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকলো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে-শেখ মুজিবুর রহমান। [খালেদ হোসাইন/স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকলো] আশির দশকের কবিতার পাশাপাশি যদি আমরা নব্বই দশকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা করি তাহলে দেখব নব্বই দশকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ অনেকটা বর্ণনাধর্মী। আশাবাদী তারা। সম্ভবত নব্বই প্রজন্ম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারাটাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেয়ার পাশাপাশি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ঘৃণাবোধ থেকেই প্রচলিত বিশ্বাসে অনীহা এবং মূল্যাবোধের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকট হয়ে উঠতে দেখি। ০১. আমাদের স্বপ্নের ভেতর বেজে উঠল সেই অহঙ্কার আমরা পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিলাম জেগে উঠলো একটি নতুন ভূগোল একটি চির শ্যামল শিহরণ প্রকৃতির সমস্ত সবুজ বেটে মেখে দিলাম আমাদের পতাকায় অতঃপর একটি রক্তিম সূর্য উড়িয়ে নাম লিখে দিলাম বাংলাদেশ। [জাকির আবু জাফর/একটি যুদ্ধ] ০২. রক্তে কেনা বাংলাদেশ, অসুন্দর নাচে তার ঘাড়ে সেখানে দিয়েছে হানা জলজ্যান্ত বাঘ ও কুমীর আমি তো কুড়াই সুর মাঠে মাঠে নদীর কিনারে জলে ও ডাঙায় বাড়ে বহুমুখী শ্বাপদের ভিড়। [তপন বাগচী/মুক্তিযুদ্ধের কবিতা] ০৩. মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজ কত গল্প! কত অনুমান। কত অবরোহ; একাত্তরের ৯ মাস আমি যুদ্ধ করেছিÑ আমার শিশুমনের সাথে যুদ্ধ করছি এখনওÑ প্রতিপক্ষ একাত্তরের বাংলার মতো ক্ষত আমারই যৌবন-উত্তীর্ণ দিল।

আমি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি। [আমিনুল ইসলাম/আমার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা না পরার গল্প] ০৪. আমাদের ইচ্ছেরাও এক দিন ছুঁয়ে যাবে আকাশের তারা আপন ঐতিহ্যে রাঙা জনপদে বসিয়েছি বাঘের পাহারা চাঁদের মাটিতে ওরা এইভাবে রুয়ে দেবে আমাদের চাকা বায়ান্ন ও একাত্তর এক ট্রেনে বয়ে আনে আমার পতাকা। [জামসেদ ওয়াজেদ/ বায়ান্না ও একাত্তর] নব্বই দশকের কবিতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতা নব্বই দশক প্রবন্ধে মামুন মুস্তাফা লিখেছেনÑ “বাংলাদেশের কবিতার উত্তোরোত্তর পথ পরিক্রমায় নব্বই দশক অত্যন্ত তাৎপর্যময়, কেননা এই সময়ের নবীন কবিদের মধ্যে আমরা লক্ষ করি শুরু থেকেই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার আকাক্সা সৃজনের আত্মমুগ্ধতা এবং কবিসুলভ তার অহংবোধ। শতাব্দী সংক্রান্তির অস্থিরতায় বিশ্ব পুঁজিবাদ, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বহির্চাপ এবং দেশীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অন্তর্চাপে এ সময়ের তরুণ মানস সঙ্গত কারণেই ক্রমাগত অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছে। এই অন্তমুখিতার স্বভাবধর্ম যেকোনো সময়ের চেয়ে স্বতন্ত্র।

প্রচলিত বিশ্বাসে অনীহা, সমাজ-রাজনীতি ও রাষ্ট্রের কূটচরিত্রে অনাস্থা, মূল্যবোধের প্রচলিত স্তম্ভগুলোর প্রতি অবিশ্বাস এবং অগ্রজের কৃতী ও কীর্তির প্রতি সীমাহীন অশ্রদ্ধায় এই প্রজন্মের মনোলোক বিদীর্ণ ও রক্তাক্ত। ’ [মাহমুদ কামাল সম্পাদিত ছয় মাসের সাহিত্যের কাগজ অরণি-জানুয়ারি-জুন ২০১১ সংখ্যা পৃষ্ঠা ৫৪২] কবিতার কাল বিচারে নানামনির নানামত থাকতেই পারে। আমার দেখার বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ কিভাবে কবি চিত্ত আলোড়িত করেছে। কবিরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। আমাদের কাব্যকলার বিস্তীর্ণ ভূভাগজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শতধারায় উৎসারিত।

বাংলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এখন তারা বিশাল ক্যানভাসের কতটুকুই বা তুলে ধরা যায় এই সীমিত পরিসরে। শ্রদ্ধার সাথে বলছি সামান্য ক’জন কবির কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরেছি মাত্র। কেবলমাত্র নিবন্ধের সীমাবদ্ধতার কারণে; উদ্ধৃতির বাইরে রয়ে গেল বিশাল কবি সম্প্রদায়। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করার সময় আরো অজস্র কবির কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরা সম্ভব হবে। সবশেষে বলতে হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির সময় তো ফুরিয়ে যায়নি।

আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের লেখালেখি নিয়ে বিষদ আলোচনা-পর্যালোচনা করবেন সেই আশাবাদ, রইল। সহায়ক গ্রন্থ : জাফরুল আহসান ও জাকির আবু জাফর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.