আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরাজিতের অন্তিম দান

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

কষা , নিমতেতো বিকালে ক্ষুব্ধ মন নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠতে হলে অবশেষে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা শান্তিলতা । খুব নিচু স্বরে কাঁদতে আরম্ভ করলো যেন পাশের ঘর থেকে কেউ ছুটে না আসে । সেই ঘরে থাকা উপস্থিতজনেরা এই কান্না দেখে ফেললে তা মৃত্যুসম যন্ত্রণার মতো মস্তিষ্কের প্রতিটি গ্রন্থিতে ক্রমাগত আঘাত হানতে থাকবে । এই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারবেনা ।

আত্মসম্মানবোধের এই অসহায় অনিবার্য পরাজয় সে মেনে নেবেনা ।

ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় যখন তার শরীরের আগে ‘ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ‘ শব্দটি জুড়ে দেওয়ার পালাপর্ব শুরু হয়েছিলো সেদিন বিকালে জানালা খুলে দিলে বসন্তের একরাশ তাজা বাতাস অনেকদিন পর তাকে দ্রবীভূত করতে শুরু করেছিলো । কিন্তু কে জানতো সেই বাতাসে ওয়ারড্রবের উঁচু থেকে একটি ছোট কাগজ উড়ে এসে তার মুখের উপর আসবে ? কে জানতো সেই এক টুকরো চিঠিতে এমনই এক গল্প লেখা আছে ঘুণাক্ষরেও যা আগে কখনো টের পায়নি ? চিঠিটা পড়ে অনেকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণের বন্ধু কল্যাণীর কথা মনে পড়েছিলো । তার ডাকাবুকো বান্ধবীটা প্রতিদিনই অসম্ভব ভীড়ের মাঝেও বাসে উঠতে ভুল করতোনা । শরীরে একটু নোংরা স্পর্শ পেলেই তৎক্ষনাৎ ফোঁস করে উঠতো আর কালপ্রিটের সাথে লড়াই শুরু করে দিতো ।

আর প্রতিদিনই অফিস শেষে হোস্টেলে এসেই বিছানায় কতক্ষণ ফুলে ফুলে কাঁদতো । শান্তিলতা অনেকদিন তার কোন অর্থ খুঁজে পায়নি । এমন অসীম সাহসী মেয়ে প্রতিদিন হোস্টেলে এসে নিয়ম করে কাঁদবে কেন , কাঁদবার কথা ছিলো তো তার মতো ভীতু কারো । সেই বসন্তের বিকালে সেই এক টুকরো চিঠি পড়ে ফেলার পর কল্যাণীর কান্নার মানে খুঁজে পেয়েছিলো ।

ততক্ষণে শান্তিলতার কান্নার আয়ু ফুরিয়ে গেছে ।

ঠিক যেন তার রুপের মতো । এদিকে পাশের ঘর থেকে শ্যামল আর শেফালীর প্রাণবন্ত হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে । যেন ক্রমাগত হাসির শব্দ বেড়েই চলেছে । শান্তিলতার মনে হলো যেন রাস্তায় মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের একের পর এক গুলি এসে তার বুকে বিঁধছে । ছোট ভাই নিখিলের কথা মনে পড়লে স্মৃতির শিশিরে নোংরা কাঁদার দাগ লেগে গেলো ।

পুলিশের গুলিতে এফোঁড় – ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিলো ভাইটা তার । অথচ সেই বয়সে কি তার ভাইয়ের রাতের অন্ধকারে গুলি খেয়ে মরবার কথা ? কোনভাবেই নয় , তবুও মরেছিলো । তার শান্তশিষ্ট ভাইটা আশ্চর্যজনকভাবে কোনকালেই দমার পাত্র ছিলোনা বলেই সম্ভবত মরেছিলো । সাধারণ মানুষের কাছে চিরন্তন অধরা সময়ের যেই বৃহৎ প্রেক্ষাপট সেটা প্রায়শই তাদের মতো “ জন্মেছিলাম , বেঁচে আছি , একসময় কাউকে না জানিয়েই মরে যাবো “ মানুষদের অভিজ্ঞতার সাথে সাথে বয়স অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় । নাইলে নিখিলের যেই মৃদুভাষিণী প্রণয়িনী ছিলো শিখা নামের সে কেন নিখিলের খুন হবার পরেও প্রায়ই শান্তিলতার কাছে এসে ঘন্টাখানিক চুপচাপ বসে থেকে সেভাবেই চলে যেতো ? নিখিলের কাছ থেকে বিদ্রোহের যেই ব্যাটনটা শিখার হাতে এসে গিয়েছিলো সেটা সে আজও ধরে রেখেছে বলে জানে শান্তিলতা ।

শিখা বছর পাঁচেক হলো একটা আদিবাসীদের বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায় । শিখা প্রতিদিন দাঁতে দাঁত চেপে জীবনপ্রবাহ পার করে করে রাতেরবেলায় কবিতা পড়ে নিজেকে মানসিকভাবে শান্ত করে নেয় এমন একটা চিত্র তার চোখে ভেসে আসলো ।


এমনভাবে অন্যদের কথা বহুদিন যাবত ভাবেনি । আজকেই হুড়মুড় করে একেকটি পরিচিত কাছের মানুষদের স্মৃতি মাথায় এসে পড়ছে । বালিশের নিচে থাকা নিজের লেখা ডাইরীটা খুলে প্রথম পাতা পড়া আরম্ভ করতেই ‘ মা ‘ শব্দটায় চোখ আটকে সেখানেই স্থির হয়ে গেলো ।

তাদের দুই ভাই-বোনকে বড় করতে করতে নিজের মননের রুপ-লাবণ্যকে অনায়াসে জলাঞ্জলি দিয়ে দিলো তবুও সেই নিয়ে কনামাত্র অভিযোগ করেনি কখনো । আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশীরা সর্বদাই মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো । বলতো “ তোর মায়ের মতো সহনশীল মানুষই হয়না । “ শান্তিলতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভেবেছে মায়ের কারণে নিজেরা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিতে পেরেছে বলেই মায়ের সম্পর্কে এমন মেঠো মেঠো কথা বলে । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বশিক্ষিতা শান্তিলতা্র মনে হতো সহনশীলতা এমন একটি অনবদ্য গুণ যা দীর্ঘদিনের অনুশীলনের ফলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই অর্জন করে নিতে হয় ।

মায়ের মৃত্যুর অনেক বছর পর এসে আবিষ্কার করেছিলো আত্মীয়স্বজনেরা নিজেদের সঙ্কীর্ণ চিন্তার কারণে মাকে সহনশীল বললেও আসলে ভুল বলেনি । কেবল উচ্চারিত গুণাবলীর মর্ম অনুধাবণ করতে সমর্থ ছিলোনা এই যা । এক ধরণের অন্ধকারে ঢিল লেগে যাবার মতো । শান্তিলতার চোখের দৃষ্টির সাথে সাথে ডাইরীর পাতা এখনো সেই ‘ মা ‘ শব্দটিতেই স্থির হয়ে আছে ।

এদিকে পাশের ঘরে এখন অন্য এক নাটক শুরু হয়েছে ।

খিলখিল হাসির শব্দ থেকে এখন সেই চিত্র গিয়ে দাঁড়িয়েছে অনিবার্য অন্তরঙ্গতায় । “ না , এখানে কোনভাবেই না । তুমি কি পাগল হলে ? শান্তিলতা টের পেলে অনেক কষ্টে থাকবে বোঝো ? এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেলে শ্যামল “ ধরণের বাক্যমালা শুনতে পেলো শেফালীর মুখ থেকে । অপরদিকে শ্যামল কি ফিসফিস করে কি বললো তা না শুনতে পেলেও সেকেন্ড চারেক পরেই দুইজনের সম্মিলিত হাসির শব্দে সেই ঘরটি আবারো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । শান্তিলতার নিজের লম্পট , দুশ্চরিত্র বাপের কথা মনে হলো ।

তার মাকে প্রায়শই রাতে বিছানায় বিকৃতিভাবে কামন করতো লোকটা । কলেজে থাকতে একদিন হঠাৎ বিষয়টা আবিষ্কার করতে পেরে নিজের ঘরে রাগে , ক্ষোভে থরথর করে কেঁপে উঠেছিলো । সেই ঘটনারও বছর আটেক পরে যখন জেনেছিলো ছোট চাকরীতেও একের পর এক বঞ্চনার শিকার হতে হতে বাবা অনেক আগেই সিনিকাল হয়ে গিয়েছিলো তারপর থেকে বাবাকে আর তীব্রভাবে ঘৃণা করতে পারেনি । যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামকরা শিক্ষার্থী ছিলো একসময় ৪ বছর যাবত সেই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত পড়াশোনার ফলে অর্জিত জ্ঞানের কারণে অনেক বৃহৎ পরিসরে তাদের পরিবারের ভঙ্গুর গড়নকে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছিলো আসলে তাদের পরিবারের প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন জাহাজের নিঃসঙ্গ নাবিক । কেউই কারো জাহাজের খোঁজ পায়নি কখনো ।



শান্তিলতা আর নিতে পারেনা । পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীর নিয়ে তাও দিনানিপাত করে যাচ্ছিলো । কিন্তু চোখ বুঁজে শ্যামলের এই হিপোক্রেসি সহ্য করার কোন অর্থ হয়না । জেনেবুঝে এক পরাজিত মানুষের সাথে কেবলমাত্র স্কাউন্ড্রেলের পক্ষেই প্রতারণার খেলা খেলে যাওয়া সম্ভব । শান্তিলতা আর দেরী করলোনা ।

তার ঘরে দরজাটা ভিজিয়েই দেওয়া আছে । খুব দ্রুত একটা ছোট চিঠি লিখে অনায়াস দক্ষতায় সেটা তার দরজার নিচ দিয়ে বের করে দিয়েই তার কাছে কেরোসিনের যেই ছোট বোতল ছিলো সেটা বিছানার চারপাশে ঢেলে দিয়ে তারপর ম্যাচের কাঠিটা জ্বালিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো ।

এদিকে পাশের ঘর ততক্ষণে সম্পূর্ণই নির্লজ্জ হয়ে উঠেছে । ঠিক সেই মুহূর্তেই শান্তিলতা যখন মুগ্ধ হয়ে তার চারপাশে আগুনকে ধেয়ে আসতে দেখছিলো । ঠিক তখনই তার ঘরের দেয়াল ঘড়িটা জোরে আওয়াজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো বিকাল ছয়টা বেজেছে ।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।