আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গে কল্যাণ নেই

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল দিবাগত রাতে রাষ্ট্রের সংরক্ষিত এলাকা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটিতে দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য যখন ট্রলার থেকে নামানো হচ্ছিল তখন ধরা পড়ে। অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তদন্ত, পুনঃতদন্ত, চার্জশিট, সম্পূরক চার্জশিট এবং মামলার যুক্তিতর্ক শেষ করে দীর্ঘ ১০ বছর পর ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিশেষ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান করেছেন। ৩৮ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। ২০০৪ সালে অস্ত্রের চোরাচালানটি ধরা পড়ার পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এবং দেশি-বিদেশি সব ধরনের মিডিয়ায় এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়।

৩০ জানুয়ারি রায় বেরনোর পর খবরটি রীতিমতো টক অব দ্য কান্ট্রি হয়ে যায়। হাই প্রোফাইল, অত্যন্ত সংবেদনশীল এ মামলায় দুজন সাবেক মন্ত্রীসহ ১৪ জন উচ্চপদস্থ অফিসারের ফাঁসির আদেশের আদ্যোপান্ত জানার জন্য মানুষ মিডিয়ার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনাটি ২০০৪ সালে যখন সংঘটিত হয় তখন ক্ষমতায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত সরকার। ওই সরকারের শিল্পমন্ত্রী জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ১৪ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন। সঙ্গত কারণেই এ রায়ের বহুমুখী তাৎপর্য আছে।

প্রথমত, ১৯৭৫ সালের প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ পক্ষ ক্ষমতায় এসে বিচারহীনতার যে অপসংস্কৃতি চালু করেছিল সেই পথ ধরে ২০০৪ সালের এ ঘটনার ভাগ্যেও একই পরিণতি হতে যাচ্ছিল। যারা ট্রলার থেকে অস্ত্র ট্রাকে উঠানোর তদারকি ও দায়িত্বে ছিলেন তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে ২০০৪ সালে নিয়োজিত তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট দিয়েছিলেন কিছু কুলি-মজুরের নামে, যাদের চোরাচালানের হোতারা ডেকে এনেছিলেন নিছক কুলিগিরি করার জন্য। উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ ৫ উলফা সদস্যকে প্রাথমিকভাবে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই অস্ত্র চালানটি ধরা পড়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখা পুলিশের সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ও হেলাল উদ্দিনকে ওই সময়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিয়ে দুজনের ওপরই সীমাহীন নির্যাতন চালানো হয়, বছরের পর বছর জেলে আটক রাখা হয়।

বলা হয় ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ৩০ লাখ শহীদের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার যে যাত্রা শুরু হয়, সেই পথের অগ্রায়নে ৩০ জানুয়ারির রায় ছিল আরও একটি পদক্ষেপ। রায়ের মাধ্যমে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রখর দৃষ্টির রোষানল থেকে বাংলাদেশ নিষ্কৃতি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, রায়ের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পেরেছে ব্যক্তি যত বড় বা উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাশালী হোন না কেন, রাষ্ট্রের আইন তার থেকেও অনেক বড় এবং লম্বা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে।

এই যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করার জন্য ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হয়েছে। এই সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় দর্শন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্মিত পথের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের মানস কাঠামোর সামঞ্জস্যতা না থাকলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভুলপথে ধাবিত হবেন এবং নিজেদের জীবন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবেন। এই নির্মোহ উপলব্ধিটি মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে এই রায়ের মাধ্যমে, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় পত্রপত্রিকা এবং সব ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদন ও সংবাদ ভাষ্যের মাধ্যমে। চতুর্থত, রায় বের হওয়ার পর পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী দল থেকে সে দেশের সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে যাতে এই দণ্ডাদেশ কার্যকর না হয়, ঠিক যেমনটি তারা করেছিল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর। এতে আরেকবার প্রমাণ হলো বাংলাদেশের জামায়াত পাকিস্তানের জামায়াতেরই একটি বর্ধিতাংশ এবং বাংলাদেশের জামায়াত নেতারা ক্ষমতায় বসে বাংলাদেশের পক্ষে নয়, পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগী।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহুবিধ কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন আগেও ছিল, এখনো চলছে। কিন্তু এত বড় একটি অস্ত্রের চালান একসঙ্গে কোনো দেশ থেকে সরবরাহের নজির এর আগে বিশ্বের কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায় না। আলোচিত অস্ত্রের চালানটি পাঠানো হচ্ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ উলফার জন্য।

এ ঘটনার দ্বারা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা যে কত বড় ভয়ানক হুমকির মুখে পড়েছিল তার উল্লেখ এখানে আবশ্যক। এক. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত এ ঘটনাকে ভারত তার জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবেই গণ্য করবে সেটাই স্বাভাবিক।

তাই ভারতের মতো একটা বৃহৎ ও বিশ্ব অঙ্গনে প্রভাবশালী রাষ্ট্র, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি, সেই ভারত যদি পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নিত তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা কি ভয়ানক হুমকির মুখে পড়ত না? আশির দশকে নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিয়ে বিচার করেছিল আত্দরক্ষার অজুহাতে এই বলে যে, নরিয়েগা আমেরিকার অভ্যন্তরে ড্রাগ পাচারে জড়িত, যা আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। দুই. ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ একটা ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে বের হয়ে আসে। সেই শান্তি চুক্তি বলবৎ আছে, তবে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো বাকি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেকটি সংগঠন ইউপিডিএফ ওই শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এখনো বিচ্ছিন্নভাবে শান্তি চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বিদেশী কোনো সমর্থন না থাকায় বিপজ্জনক কিছু করতে পারছে না।

বাংলাদেশ যদি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে যায় এবং আলোচিত ঘটনার মতো কোনো কার্যকরণে লিপ্ত হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তিকে কি পুনরায় হুমকির মুখে ফেলা হয় না? তিন. এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, আঞ্চলিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে অস্ত্র আদান-প্রদান ও চোরাচালানের একটা সংযোগ ও সম্পর্ক আছে। আলোচিত অস্ত্র চালানের একটি অংশ যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জঙ্গি সংগঠন যেমন- জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) এবং অন্যদের হাতে পড়েনি তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ওপর যে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার সঙ্গে এই অস্ত্র চালানের ভেতরে পাওয়া গ্রেনেডের মিল রয়েছে। একটি শান্তিকামী রাষ্ট্র হিসেবে অন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় এমন কার্যক্রম পরিচালনা করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। অথচ আলোচিত ঘটনাটির উদ্দেশ্যই ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করা। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশেরই কিছু চিহ্নিত ও স্বঘোষিত জ্ঞানী ব্যক্তি এই অবৈধ কার্যক্রমের পক্ষে সাফাই গাইছেন এই বলে যে, চাপ প্রয়োগের (coercive diplomacy) কূটনীতিতে এমন কার্যকলাপ নাকি অনুমোদনযোগ্য।

চাপ প্রয়োগের কূটনীতির বহু রকমফের আছে। বর্তমান সময়ে চাপ প্রয়োগের কূটনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমেরিকা ও ইরান। বিগত ৩৪ বছর ধরে আমেরিকা অন্যান্য পশ্চিমা বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ইরানের ওপর অবরোধের পর অবরোধ চাপিয়ে দিচ্ছে, যাতে ইরানের কট্টর ইসলামপন্থি রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্তিশালী না হতে পারে। অন্যদিকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে এবং যে কোনো মূল্যে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে এগোচ্ছে, যাতে ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা তার ভাইটাল মিত্রদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইরানের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে আগ্রহী হয়। প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় দেওয়ার কৌশল হলো সর্বশেষ পন্থা, যার মধ্যে থাকে চরম ঝুঁকি এবং তা করা হয়ে থাকে নিজেদের রাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক্যাল ও সর্বোচ্চ কোনো আদর্শিক স্বার্থ রক্ষার খাতিরে, শেষ অবলম্বন হিসেবে।

যেমন- গত শতকের আশির দশকে আফগানিস্তানের তালেবানদের পক্ষে সম্মিলিতভাবে সমর্থন দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান তৎকালীন সোভিয়েত দখলদারির কবল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করার জন্য। কোনো দেশের সশস্ত্র বিদ্রোহীরা প্রতিবেশী দেশ থেকে সমর্থন পায় প্রধানত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ওই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের নৃতাত্তি্বক বা জাতিগত সম্পর্কের যদি মিল থাকে। আর সমর্থনের দ্বিতীয় কারণ হলো বিদ্রোহীদের আদর্শ ও দর্শনের সঙ্গে যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আদর্শগত মিল থাকে। যেমন- উত্তর আয়ারল্যান্ডের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিকে আয়ারল্যান্ড (দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড) সমর্থন দিয়েছে জাতিগত সম্পর্কের কারণে। ১৯৬৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কলাম্বিয়াতে ফার্ক (FARC) অর্থাৎ কলাম্বিয়ান রেভিউল্যুশনারি আর্মড ফোর্সকে পাশর্্ববর্তী দেশ ভেনিজুয়েলা এবং অন্যান্য বামপন্থি সরকার সমর্থন দিচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শগত কারণে।

শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের প্রথমদিকে ভারত সমর্থন দিয়েছিল ভারতের দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর জাতিগত ও সংস্কৃতিগত মিল থাকার জন্য। পরবর্তীতে স্ট্র্যাটেজিক কারণেই ভারত তামিল বিদ্রোহীদের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং উল্টো ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাঠায় শান্তিরক্ষী হিসেবে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। ভারতের সেই শান্তি মিশনও ব্যর্থ হয় এবং ১৯৯১ সালের ২১ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে তামিল আত্দঘাতীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের মিন্দাও প্রদেশের মুসলিম বিদ্রোহী, মরো লিবারেশন ফোর্স ও মরো ইসলামিক লিবারেশন ফোর্সকে মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সমর্থন দেয় ধর্মীয় জাতিগত সম্পর্কের কারণে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তি্বক বা জাতিগত এবং ধর্মীয় কোনো মিল নেই, আর বিদ্রোহীদের আদর্শের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শেরও কোনো মিল নেই।

ভারতের আসাম এবং অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করার মতো চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে বাংলাদেশের কোনো স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ হাসিলের কি কোনো জায়গা আছে? ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কতকগুলো পুরনো সমস্যা রয়েছে, যেমন সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের সমস্যাগুলো এর মধ্যে অন্যতম। পূর্বের লেগাসির কথা এখানে না আনলেও ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের বিএনপির সরকার এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদের জামায়াত-বিএনপির সরকার এই ১০ বছরে ওই তথাকথিত চাপ প্রয়োগের কূটনীতি দ্বারা ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত কোনো সমস্যার কি সমাধান করতে পেরেছে? এটা ঠিক ১৯৯১-৯৭ পর্যন্ত আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর কার্যকলাপ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর সশস্ত্র বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে এক ধরনের Tit for Tat পলিসিতে উভয় দেশ লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের অভিযোগ ছিল ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি বাহিনীকে সহায়তা করছে, আবার ভারতের অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করছে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পর উভয় দেশ এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের সময় ভারতের পক্ষ থেকে পুনরায় প্রবল অভিযোগ আসতে থাকে যার সত্যতা পাওয়া যায় ২০০৪ সালের এই আলোচিত অস্ত্র চোরাচালানটি ধরা পড়ার মাধ্যমে।

এটি তো এখন সবার কাছে দৃশ্যমান যে, বিএনপি-জামায়াত পূর্ণ দুই মেয়াদে তথাকথিত চাপ প্রয়োগের কূটনীতির মাধ্যমে ভারত থেকে কোনো সুবিধাই আদায় করতে পারেনি এবং কোনো সমস্যারও সমাধান হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৮-২০১৩) শান্তিপূর্ণ শক্তিশালী কূটনীতির মাধ্যমে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে গঙ্গার পানি চুক্তি, তিনবিঘা করিডর বাংলাদেশিদের ব্যবহারের জন্য স্থায়ীভাবে খোলা হয়েছে, ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি এবং বাংলাদেশি গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতের মার্কেট উন্মুক্ত করতে পেরেছে। বিনিময়ে ভারত তার নিজস্ব পণ্য এবং অবকাঠামো উন্নয়ন সরঞ্জামাদি পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুট ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। অর্থাৎ উভয় দেশের মধ্যে একটা পরিপূর্ণ আস্থা ও উইন-উইন সমঝোতামূলক পরিবেশ ফিরে এসেছে। এটা এখন পরিষ্কার, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো রকম সহায়তা প্রদানের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ নেই।

যা হয়েছে তা হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধর্মীয় উন্মাদনার মাধ্যমে সস্তা ভারতবিরোধী ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের ধারণায় আবিষ্ট হয়ে তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকার উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারত-পাকিস্তানের চির বৈরিতা ও অঘোষিত চলমান যুদ্ধের সমীকরণে পাকিস্তানের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তারই পরিণতিতে আজ রাষ্ট্রের এতগুলো উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক অফিসার ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এ ঘটনার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের শামিল কোনো কার্যকলাপ রাষ্ট্রের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, বরং রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের ভ্রান্তনীতি আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী স্তরের কর্মকর্তারা বিপদগ্রস্ত হন। একটি সহজবোধ্য বিষয় হলো- ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাত্রা যত তীব্রতর হবে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক্যাল অবস্থান ততই শক্তিশালী হবে। এখানে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ নেই।

ইসলাম, সেনাবাহিনী এবং চিরশত্রু ভারতকে ধ্বংস করার মূলমন্ত্রে চালিত ট্রাইপড বা ত্রিমাত্রিক দর্শন পাকিস্তান সেই পঞ্চাশের দশক থেকে অনুসরণ করে আজ পর্যন্ত ভারতের কিছু করতে পারেনি, তবে ইসলামের পবিত্রতাকে বিনষ্ট করেছে এবং এই ভ্রান্ত ত্রিমাত্রিক নীতির পরিণতিতে একাত্তরে একবার দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, পুনরায় বহুখণ্ডিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শিক্ষণীয় ছিল বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হলে বাংলাদেশকে একটি শান্তিকামী, অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোনো রকম ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি যেন অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা না রাখতে পারে। স্বাধীনতার পর এই নীতিতে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু পঁচাত্তরের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সব কিছু আবার উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে।

পরপর দুজন সামরিক শাসকের সময়ে এবং বিএনপি-জামায়াতের দুই মেয়াদে (১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬) প্রত্যাখ্যাত সেই পাকিস্তানের ট্রাইপড নীতিতে বাংলাদেশ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যার কারণেই আজ আমরা ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মতো ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দেখতে পাই।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল :sikder52@gmail.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.